উপক্রমণিকা – ত্রিদিবনাথ রায়

জীবের প্রথম প্রবৃত্তি বা প্রেরণা হইতেছে জীবনধারণ বা ক্ষুন্নিবৃত্তি এবং দ্বিতীয় প্রবৃত্তি বংশরক্ষা। জীবের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মনূষ্য। মানুষের জীবনের লক্ষ্য হইতেছে মূলতঃ তিনটি, যথা – (1) ধর্ম, (2) অর্থ (3) কাম। এই তিনটিকে ত্রিবর্গ বলা হয়। ইহজীবনে সাফল্যলাভ করিতে হইলে এই তিনটির আবশ্যক। মৃত্যুর পর পরলোকের কাম্য হইতেছে মোক্ষ অর্থাৎ পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণের নিবৃত্তি। সাধারণত লোকে ইহজীবনে সাফল্যলাভ করিতে চাহে। একজন সফলকাম ব্যক্তি পরিবারের মেরুদন্ড, সমাজে অভিনন্দিত জাতির একজন। চতুবর্গে সাফল্যলাভ করিয়া ভারতীয় আর্যগণ প্রাচীন কালে প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছিলেন। ভারতের দর্শন সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করিয়াছিল এবং মূমূক্ষূগণকে মোক্ষলাভের উপায় নির্দেশ করিয়াছিল। মনু প্রভৃতি স্মৃতিকারগণের পান্ডিত্যপূর্ণ বিধান সংসারী মানুষকে তাহার পালনীয় ধর্মের পন্থা দেখাইয়া দিয়াছিল। বৃহস্পতি, কৌটিল্য প্রভৃতি মনীষীর অর্থশাস্ত্র অর্থোপার্জন সামাজিক জীবনযাপনের নির্দেশ দিয়াছিল। সর্বশেষে কামশাস্ত্রের সূক্ষতর বৈশিষ্ট্য অনুধাবন করিয়াছিলেন। প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা কালচক্রেরনিষ্ঠুর আবর্তনে বিলুপ্ত হওয়ায় বিপুল ভারতীয় সাহিত্যের অধিকাংশ বিস্মৃতির অতলগহবরে চলিয়া গিয়াছে। সুতরাং প্রায় দুই হাজার বৎসরের বিলুপ্তপ্রায় ভারতীয় সাহিত্যের একটা ধারাবাহিক ইতিহাস রচনা করা অসম্ভব। যাহ্য হউক, আমরা প্রাচীন ভারতের কামশাস্ত্রের একটা সংক্ষিপ্ত ইতিহাস দিবার চেষ্টা করিব। আরব্য উপন্যাসের অনুবাদক স্যর সামুয়েল রিচার্ড বার্টন প্রাচ্যের যৌনশাস্ত্র সম্বন্ধে অনেক গবেষণা করেন। বারাণসীতে তিনি কামশাস্ত্র সোসাইটি নামে একটি প্রতিষ্ঠান স্থাপন করিয়াছিলেন। কল্যানমল্লের অনঙ্গরঙ্গ অনুবাদকালে তিনি বাৎসায়নের নামের সহিত পরিচিত হন। তাঁহার ধারনা হয় বাৎসায়নের কামসূত্র না থাকিলে কোন সংষ্কৃত গ্রন্থাগার সম্পূর্ণ বলিয়া গণ্য হইতে পারে না। সে সময়ে কামসূত্রের কোন সম্পূর্ণ পুথি সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য ছিল। বোম্বাই হইতে তিনি সে পুথিটি পাইয়াছিলেন তাহা ভ্রমপূর্ণ। সুতরাং বারাণসী, কলিকাতা জয়পুর হইতে পুথি সংগ্রহ করিয়া এবং কয়েকটি পুথি মিলাইয় তিনি একটি সম্পূর্ণ সঠিক কামসূত্র পাইয়া পন্ডিতদিগের সাহায্যে যশোধরের জয়মঙ্গলা টীকার অনুসরণে মূল কামসূত্রের একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত করেন। ইহার প্রথম সংষ্ককরণটি আমাদের হস্তগত হয় নাই, তবে ইহার একটি পুনমুদ্রণ পাইয়াছি তাহাতে তারিখ আছে ১৮৮৩ খ্রীস্টাব্দ। ইহার উৎসর্গ-পত্রে লিখিত আছে- 'Dedicated to that small portion of the British public which takes enlightened interest in studying the manners and costume of the olden east.' ইহার পর ১৮৮৫ খ্রীস্টাব্দে Isidore Liseux প্যারি হইতে এই ইংরেজী অনুবাদেরই একটি ফরাসী অনুবাদ প্রকাশিত করেন। তাহার অনেক পরে ১৯২০ খ্রীস্টাব্দে Richard Schmidt নামক এক জার্মান পন্ডিত জয়মঙ্গলা টীকা সহ সম্পূর্ণ কামসূত্রের একটি বিশদ অনুবাদ জার্মান ভাষায় প্রকাশ করেন। ইহাই ইউরোপীয় ভাষায় লিখিত টীকা সহ কামসূত্রের একমাত্র প্রামাণ্য অনুবাদ। ১৭৮৮-৮৯ খ্রীস্টাব্দে বারাণসীর অধিবাসী ভাস্কর নরসিংহ শাস্ত্রী নামক একজন পন্ডিত রাজা ব্রজলালের আনুকূল্যে সূত্রবৃত্তি নামক কামসূত্রের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন। বাঘেলা রাজবংশের রাজা বীরভদ্র দেব ১৫৭৭ খ্রীস্টাব্দে পদো কন্দর্প-চূড়ামণি নামে কামসূত্রের একটি টানা ব্যাখ্যা running commentary রচনা করিয়া ছিলেন, তাহা ১৯২৬ খ্রীস্টাব্দে লাহোর বনারসীদাস সুন্দরলালের সংস্কৃত পুস্তকালয় হইতে প্রকাশিত হইয়াছিল। এতদ্ব্যতীত কাস্মীরের সুবিখ্যাত কবি ক্ষেমেন্দ্র বাৎস্যায়ন সূত্রসার নামক কামসূত্রের একটি টীকা বা ব্যাখ্যা রচনা করেন তাহা এখন বিলুপ্ত। বর্তমানে (সন ১৩১৩ সালে) মহেশচন্দ্র পালের সম্পাদিত 'কামসূত্রই' একমাত্র সম্পূর্ণ  বঙ্গানুবাদ। সন ১৩৩৪ সালে বঙ্গবাসা কার্যালয় হইতে পন্ডিত পঞ্চানন তর্করত্ন কর্তৃক সম্পাদিত একটি বঙ্গানুবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহা অসম্পূর্ণ। তাহাতে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কেবলমাত্র মূলের বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইয়াছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তাহাও দেওয়া হ্য় নাই। যথা সাম্প্রযোগিক অধিকরণটি সম্পূর্ণই অনুবাদ করা হয় নাই, তবে জয়মঙ্গলা টীকাটি দেওয়া হইয়াছে। ১৯২১ খ্রীষ্টাব্দে K.Rangaswami Iyengar লাহোরের The Panjab Sanskrit Book Depot হইতে কামসূত্রের একটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছিলেন। ইহা কেবল মূলেরই অনুবাদ। ১৯৪৩ খ্রীস্টাব্দে কলিকাতা হইতে Medical Book Company কর্তৃক কামসূত্রের একটি ইংরাজী অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছিল, তাহার অনেকগুলি সংষ্করণ বা পুনমুদ্রণ হইয়াছিল। এই অনুবাদ আক্ষরিক অনুবাদ নহে, টানা অনুবাদ বলা যাইতে পারে। বর্তমানে পুনা বোম্বাই হইতে কয়েকটি ইংরেজী অনুবাদ প্রকাশিত হইয়াছে। ফ্রান্স হইতে E.Lamairesse নামক এক ব্যক্তি Kama Soutra Regles DL Amour de Vatsyayana  এই নামে একটি পুস্তক প্রকাশ করেন। তাহাতে প্রকাশকের নাম বা প্রকাশের তারিখ নাই। ইহাতে মূলতঃ সাম্প্রযোগিক অধিকরণের কিংদংশ অনুবাদ করিয়া প্রত্যেক প্রকরণের শেষে পরিশিষ্ট জুড়িয়া তাহাতে বিভিন্ন ইউরোপীয় কামশাস্ত্রকারের গ্রন্থ হইতে উদ্ধৃতি সন্নিবেশিত হইয়াছে, সুতরাং ইহাকে কামসূত্রের অনুবাদ বলা যায় না। আমাদের বর্তমান সংস্করণটি মহেশচন্দ্র পাল সম্পাদিত করিয়াছিলেন, কিন্তু বঙ্গানুবাদ করিয়াছিলেন গঙ্গাচরণ বেদান্ত বিদ্যাসাগর। এখন দেখা যাউক কামসূত্র হইতে প্রাচীন ভারতীয় কামশাস্ত্র সম্বন্ধে আমরা কি জানিতে পারি। বাৎসায়নের কামসূত্র হইতে আমরা জানিতে পারি। বাৎসায়নের কামসুত্র হইতে আমরা জানিতে পারি, নন্দী এক সহস্র অধ্যায়ে প্রথমে একটি কামশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন। ইহাকে বাৎসায়ন মহাদেবের অনুচর নন্দী বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন, কিন্তু তাহা কল্পনামাত্র। আমরা নন্দী সম্বন্ধে কিছুই জানি না, হয়ত নন্দী নামে রক্তমাংসের কোন ব্যক্তি ছিলেন, যিনি আদি কামশাস্ত্র কারের নাম পাই। গোণিকাপুত্রের সহিত তাহার নামের উল্লেখ থাকায় ইনিই যে প্রাচীন কামশাস্ত্রকার নন্দী তাহা অনুমান করা যাইতে পারে। এই এক সহস্র অধ্যায়ে রচিত কামশাস্ত্র উন্দালকেরা পুত্র শ্বেতকেতু সংক্ষিপ্ত করিয়া পাঁচশত অধ্যায়ে রচনা করেন। এই শ্বেতকেতু সঙ্ঘন্ধে মহাভারতে (আদি ১২২অঃ) একটি কাহিনী প্রচলিত আছে। অতি প্রাচীনকালে যখন স্ত্রী-পুরুষের আনুষ্ঠানিক বিবাহপ্রথা প্রচলিত ছিল না, সেই যুগে একদা শ্বেতকেতু পিতা উন্দালক মাতার সহিত একস্থানে অবস্থান করিতেছিলেন। তখন একজন ব্রাক্ষ্মন আসিয়া উন্দালকের নিকট ইহতে শ্বেতকেতুর মাতাকে লইয়া যান। শ্বেতকেতু তাঁহার পিতাকে ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলে তিনি বলিলেন, তোমার মাতার উপর আমার বিশেষ কোন অধিকার নাই। সুতরাং যে কেহ তাহাকে লইয়া গিয়া সহবাস করিতে পারে। ইহাতে শ্বেতকেতু ক্রদ্ধ হইয়া বয়ঃপ্রাপ্ত হইলে স্ত্রী-পুরুষের বিবাহপ্রথা প্রচলিত করেন এবং স্ত্রীজাতির সতীত্ব রক্ষার ব্যবস্থা করেন। শ্বেতকেতু সম্বন্ধে আরও কাহিনী ছান্দোগ্যোপনিষৎ , বৃহদারণ্য কোপনিষৎ, তৈত্তিরিয়সংহিতা প্রভৃতিতে আছে। সুতরাং নিৎসন্দেহে বলা যাইতে পারে তিনি একজন ঐতিহাসিক ব্যক্তি- তবে তিনি যে পাঁচশত অধ্যায়ে কামশাস্ত্র রচনা করিয়া ছিলেন তাহা অতিশয়োক্তি বলিয়া মনে হয়। বাৎসায়ন তাঁহার কামসূত্রে কয়েকটি স্থানে (//২৫,//৩১, //৩১, //৩১-৩৪) ঔন্দালকির নামোল্লেখ-এমনকি তাঁহার মতেরও উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি ঔন্দালকির পাঁচশত অধ্যায়ে লিখিত গ্রন্থ সম্ভবতঃ চাক্ষুষ করেন নাই। চাক্ষুষ করিলে তিনি আরও বিশদভাবে কামসূত্র রচনা করিতে পারিতেন। তবে তাঁহার সময়ে ঔন্দালকির অনেক মত পূর্বাচাষদিগের মধ্যে প্রচলিত ছিল। বাভ্রব্যের গ্রন্থ হইতে তিনি তাহা সংগ্রহ করিয়া থাকিবেন। ঔন্দালকি শ্বেতকেতুর পর পাঞ্চালের অধিবাসী বাভ্রব্য ) সাধারণ, ) কন্যা-সংপ্রযুক্তক, ) ভাষাধিকারিক, ) পারদারিক, ) বৈশিক, ) সাম্প্রযোগিকও ) ঐপনিষদিক নাকম সাতটি অধিকরণে দেড়শত অধ্যায়ে সংক্ষিপ্ত কামশাস্ত্র প্রণয়ন করেন। বাৎসায়ন এই গ্রন্থ অষ্যয়ন করিয়াছিলেন এবং তদনুসারে সেই সাতটি অধিকরণে তাহার কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন। তাহার পূর্বে সমগ্র কামশাস্ত্রের উপদ্ষ্টো বাভ্রব্য ব্যতীত আর কোন আচার্য প্রাদুর্ভূত হন নাই। বাভ্রব্যের এই সাতটি অধিকরণের এক একটি লইয়া এক একজন আচার্য এক একটি গ্রন্থ প্রণয়ন করিয়াছিলেন। চারায়ণ সাধারণ, ঘোটকমুখ কন্যাসংপ্রষূক্তক, গোনদীয় ভাষাধিকারিক, গোণিকাপুত্র পারদারিক, দত্তকবৈশিক, সুবর্ণনাভ সাম্প্রষোগিক এবং কুচুমার ঔপনিষদিক অধিকরণ পৃথক পৃথক বিশদভাবে রচনা করেন। বাৎস্যায়ন সকল পৃথকভাবে রচিত গ্রন্থগুলির সহিত পরিচিত ছিলেন। কিন্তু কামশাস্ত্রের সামগ্রিকভাবে আলোচনা না করায় বিভিন্ন অধিকরণের উপর লিখিত এই সকল শাস্ত্রের আদর ক্রমশ কমিয়া যায় কালক্রমে একে একে সেগুলি বিলুপ্ত হইয়া যাইতেছিল এবং বাভ্রব্যের শাস্ত্র বৃহৎ, তাহার অধ্যয়ন দুষ্কর, এই সকল বিবেচনাপূর্বক সকল শাস্ত্রার্থ সংক্ষেপ করিয়া বাৎসায়ন অল্প আকারে সাত অধিকরণে, ছত্রিশ অধ্যায়ে চৌষট্টি প্রকরণে এই কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন। সূত্রাকারে রচিত হওয়ায় স্মরণ রাখার পক্ষে ইহা সুবিধাজনক। বাৎসায়নের প্রাদুর্ভাবকাল লইয়া বহুমতভেদ আছে। আমাদের বর্তমান গ্রন্থের রচয়িতা মহেশচন্দ্র পাল মূল পুস্তকের প্রথমে কয়েকটি শ্লোক জুড়িয়া দিয়াছেন, তাহা অন্য কোন পুথিতে নাই। এই শ্লোকগুলি টীকাকারে যশোধরের লিখিত বলা হইয়াছে। ইহার মধ্যে তৃতীয় শ্লোকে দ্বিবেদাক্ষিস্রন্টুঃ পরিমিত ইহৈক প্রতিনিধিঃ এই উক্তি দ্ব্যরা ২৪২৪ কল্যব্দে অর্থাৎ খ্রীষ্ট জন্মের ৬৭৬-৭৭ বৎসর পূর্বে ইহা রচিত হইয়াছিল বুঝায়- কিন্তু পন্ডিতগণ ইহা সমীচীন বলিয়া মনে করেন না। এবং এই শ্লোকগুলি প্রক্ষিপ্ত বলিয়া সিদ্ধাশ্ত করেন। কামসূত্রের টীকাকার যশোধর সম্ভবতঃ খ্রীস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন খুব বিচক্ষণ ব্যক্তি ছিলেন। তিনি যে দুই হাজার বৎসর পূর্বে লিখিত পুস্তকের তারিখ নির্ণয় করিবেন এরূপ দুঃসাহসী ছিলেন বলিয়া মনে হয় না। History of Classical Sanskrit Literature এর রচয়িতা শ্রীযুত কৃষ্ণমাচারিয়ার অন্ধ্র রাজবংশের ত্রয়োদশ নৃপতি কুন্তল সাতকর্ণীর, মৎস্যপুরাণ কলিধুগরাজ, বৃত্তান্ত অনুসারে, রাজ্যকাল ধরিয়া বাৎসায়নকে তিন বা চারশত খ্রীস্টপূর্বে ফেলিয়াছেন। ইহার বিপরীত মতে K.G.Sankara Iyer (Journal of the Mythic Society VIII P291)  কামসূত্রের রচনাকাল ৩৫০ খ্রীষ্টাব্দ ধরিয়াছেন। প্রফেসর জলি কৌটিল্যকে খ্রীস্টীয় তৃতীয় এবং বাৎস্যায়নকে চতুর্থ শতকে নির্দেশ করিয়াছেন। অধ্যাপক হারানচন্দ্র চাকলাদার তাহার সুচিন্তিত প্রবন্ধ সম্বলিত গ্রন্থে আপস্তম্বের কামসূত্রের বরণবিধান প্রকরণ এবং কামসূত্রের কন্যাসম্প্রযুক্তক অধিকরণে বরণবিধান প্রকরণের মধ্যে অভূত সাদৃশ্য দেখিয়া মনে করেন বাৎস্যায়ন আপস্তম্বের নিকট ঋনী। এতদব্যতীত তিনি আরও বহুস্থলে এই উভয় শাস্ত্রকারের উক্তির সাদৃশ্য দেখাইয়াছেন। বৌধায়নের ধর্মসূত্রে গান্ধর্ব বিবাহ সম্বন্ধে যাহা লিখিত আছে কামসূত্রের কন্যাসংপ্রযুক্তক অধিকরণেও তাহাই লিখিত আছে- বিবাহিত দপ্ততির বিবাহের ফল হইতেছে অনুরাগ। সেইজন্য সমস্ত প্রকার বিবাহের মধ্যে গান্ধব বিবাহ মধ্যম হইলেও অনুরাগাত্মক বলিয়া ইহা আদৃত। কারণ ইহাতে সম্বন্ধ করিবার ঝঞ্ঝাট নাই, অনুরাগভরেই এই বিবাহ সম্পন্ন হইয়া থাকে। তাহার পর কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হইতে বাৎস্যায়ন অনেক উক্তি গ্রহণ করিয়াছেন। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র আনুমানিক ৩০০ খ্রীস্টপূর্বে রচিত হইয়াছিল, সুতরাং বাৎসায়ন ৩০০ খ্রীস্টপূর্বের পর প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন। পতঞ্জলির মহাভাষ্য হইতে বাৎসায়ন অনেক উদ্ধৃতি করিয়াছেন। ইহা হইতে বাৎসায়নের প্রাদুর্ভাবকাল খ্রীস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের মেধার্ধে গিয়া পড়ে। কামসূত্রে অহল্যা, অবিমারক শকুন্তলার কাহিনীর উল্লেখ আছে। রামায়নে, অম্বঘোষের বদ্ধচরিত্র অহল্যার উল্লেখ আছে। ভাসের নাটক অবিমারক সে সামাজিক চিত্র আছে তাহার  সহিত কামসূত্রে বর্ণিত সামাজিক চিত্রের অনেক মিল আছে। তাহা হইতে অধ্যাপক চাকলাদার মনে করেন, বাৎসায়ন নাটক হইতে অবিমারকের কাহিনী জানিতে পারিয়াছেন, সুতরাং বাৎসায়ন ভাসের পরবর্তী। এদিকে মালবিকাপ্নিমিত্রম্ নাটকে কালিদাস ভাসকে পূর্বসূরী বলিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। অভিজ্ঞানশকুন্তলম, নাটকে দুষ্যন্ত কর্তৃক শকুন্তলাকে বিস্রন্ডণ, শকুন্তলার পতিগৃহে যাত্রার সময় কাশ্যপ তাহাকে যে উপদেশ গিয়াছেন তাহাতে অপ্নিবর্ণের রতিলীলা বর্ণনায় ইত্যাদি বহুস্থলে কামসূত্রের প্রভাব লক্ষিত হয়। সুতরাং কালিদাস সুবন্ধুর ন্যায় বাৎসায়নের নামউল্লেখ না করিলেও কামসূত্রকে অনুসরণ করিয়াছেন, অতএব তিনি বাৎসায়নের পরবর্তী। কিন্তু অধ্যাপক মহাশয় ভাবিয়া দেখেন নাই যে, বাৎসায়ন পূর্বাচার্যদিগের শাস্ত্র অনুসরণ করিয়া তাহার কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন। বাভ্রব্যের কামশাস্ত্র বহুদিন পর্যন্ত সুলভ ছিল। সুতরাং যে কালিদাস বাভ্রব্যের কামশাস্ত্রের সহিত পরিচিত ছিলেন না তাহা কে বলিবে? এখন দেখা যাউক কালিদাস কখন প্রাদুর্ভুত হইয়াছিলেন। অধিকাংশ ঐতিহাসিকই কালিদাসকে গুপ্তযুগের কবি বলিয়া স্থির করিয়াছেন। কিন্তু দীর্ঘকাল হইতে প্রচলিত কিংবদন্তী অনুসারে কালিসাদ উজয়িনীর রাজা বিক্রমাদিত্যের সভাসদ কলিয়া কথিত হইয়া আসিতেছেন। যদিও বিক্রমাদিত্যের রাজসভার নবরত্নের মধ্যে তাঁহার নাম আছে, নবরত্নের সব রত্নগুলি একই সময়ে বর্তমান ছিলেন না। গুপ্ত সম্রাটগণের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। উজয়িনীতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত একটি জয়স্কন্ধবার স্থাপন করিয়াছিলেন। অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন ইহা তাঁহার দ্বিতীয় রাজধানী ছিল, তাহাদের সেই অনুমান ভ্রাপ্ত। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রৌপ্য মুদ্রা শকনপতিদিগের অনুকরণে উজয়িনীতে মুদ্রিত হইয়াছিল বলিয়া উজ্জয়িনীকে দ্বিতীয় রাজধানী বলা চলে না। কালিদাস তাঁহার মেঘদূতে মেঘকে উজ্জয়িনীর উপর দিয়া লইয়া গিয়াছেন, কিন্তু পাটলিপুত্রের উপর দিয়া লইয়া যান নাই। কালিদাস যদি দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সভাসদ হইতেন তাহা হইলে মেঘকে নিশ্চয়ই পাটলিপুত্রের উপর দিয়া লইয়া যাইতেন। মেরুতুঙ্গ নামক একজন জৈন পন্ডিত লিখিয়াছেন যে উজয়িনীতে নভোবাহন নামক এক নৃপতি রাজত্ব করিতেন। তাঁহার পর তাঁহার পুত্র গর্দভিল্ল রাজা হন। তিনি ১৩ বৎসর রাজত্ব করার পর শ্রীকালিকাচার্য নামক এক ব্রাক্ষ্মনের ভগিনী সরস্বতীর উপর বলাৎকার করায় তিনি শকদিগের সাহায্যে গর্দভিল্লকে রাজ্যচ্যুত করেন। চার বৎসর পরে গর্দভিল্লর পুত্র শকগনকে পরাজিত রাজ্য পুররুদ্ধার করিয়া বিক্রমাদিত্য নাম লইয়া সিংহাসন আরোহন করেন এবং বিক্রমসংবতের প্রবর্তন  করেন। গুপ্তরাজগণের সমস্তলিপিতে গঙ্গযমুনার সঙ্গম স্থলকে প্রয়োগ বলা হইয়াছে। অথচ কালিদাস এই স্থানকে প্রতিষ্ঠানপুরী বলিয়াছেন। প্রতিষ্ঠানপুরী প্রয়োগের প্রাচীনতর নাম। অভিজ্ঞানশকুন্তলমে রাজা দুষ্যন্তের রাজসভায় যে বিচারের বিবরণ আছে তাহা হইতে কালিদাসের যুগেরফৌজদারী দেওয়ানী আইন সম্বন্ধে যাহা জানা যায় তাহা হইতে নাটকের রচনাকাল সম্বন্ধে বেশ একটি ধারনা হয়। শকুন্তলা রাজা কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হইয়া যাইবার পর ষষ্ঠ অঙ্কে রক্ষিগণ দুইজন ধীবরকে চোর বলিয়া রাজসভায় লইয়া আসিল। ইহাদের নিকট রাজার নামাঙ্কিত মনিখচিত একটি সুবর্ন অঙ্গুরী পাওয়া গিয়াছে। তৎকালে মনি চুরি অপরাধের জন্য প্রাণদন্ত হইত। রাজা অঙ্গুরী দেখিয়া শকুন্তলাকে প্রদত্ত তাহার অঙ্গুরী বলিয়া চিনিতে পারিলেন  ওধীবরগণকে মুক্তি দিয়া পুরষ্কৃত করিবার আদেশি দিলেন। তাহার পর আর একটি ঘটনা হইল-প্রতিহারী অমাত্য লিখিত একটি পত্র রাজাকে দিল- ইহাতে অমাত্য জানাইয়াছেন- ধনমিত্র নামক একজন ব্যবসায় সমুদ্রে জাহাজডুবি হওয়ায় মারা গিয়াছেন। সেই হতভাগ্যের কোন সন্তান নাই, সুতরাং তাহার বিপুল সম্পত্তি রাজার বাজেয়াপ্ত করা কর্তব্য, অমাত্য সেই সম্বন্ধেরাজার উপদেশ চাহিতেছেন। রাজা বলিলেন, সে যদি বিপুল সম্পত্তির অধিকারী হয়তাহা হইলে তাহার নিশ্চয় একাধিক পত্নী থাকিবে। অনুসন্ধান করা হউক, তাহার কোন পত্নী সন্তানসম্ভবা কিনা। গর্ভস্থ সন্তান পিতার সম্পত্তির উত্তরাধিকারী। তাহা যদি না হয় তবে রাজা সেই সম্পত্তি অধিকার করিবেন। অমাত্য অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন যে শেষ্ঠীর একজন স্ত্রী সন্তানসম্ভবা, সেই উত্তরাধিকরিনী হইবে যাবৎ না সন্তান ভুমিষ্ঠ হয়। ইহা হইতে বুঝা যায় কালিদাস যে যুগে জন্মিয়েছিলেন তখন মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে নিঃসন্তানা বিধবার অধিকার ছিল না, কালক্রমে বিধবা স্ত্রীর স্বামীর অধিকার সাব্যস্থ হইয়াছে। এইভাবে শকুন্তলা নাটকটি মনু, আপস্তব, বৌধায়ন নারদের স্মৃতির পরে রচিত এবং নারদ, কাত্যায়ন, গৌতম, বৃহস্পতিশঙ, লিখিত, যাজ্ঞবল্ক্য ব্যাসের স্মৃতির পূর্বে রচিত। মণিচুরির অপরাধের দন্ড প্রাণদন্ড হইতে দৈহিক শাস্তি বা অর্থদন্ড পরিণত হয়। অনেক ঐতিহাসিক অশ্বঘোষের বুদ্ধ্যরিতের শ্লোকসমূহের সহিত কালিদাসের কাব্যের শ্লোকের সাদৃশ্য দেখিয়া মনে করেন কালিদাস যখন খ্রীস্টীয় চতুর্থ শতকের কবি তিনি খ্রীস্টীয় প্রথম শতকের কবি অম্বঘোষকে অনুকরণ করিয়াছেন, গোপাল রঘুনাথ নন্দাগিকর তাহার সম্পাদিত রঘুবংশে বুদ্ধচরিত রঘুবংশ বদ্ধচরিত কুমার সম্ভব হইতে পাশাপাশি বহু শ্লোক উদধৃত করিয়া দেখাইয়াছেন, অম্বঘোঘের একমাত্র কাব্য বৃদ্ধচরিতের অনুকরন করিবেন কেন? এই সমস্ত প্রমাণ দ্বারা কালিদাস যে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতক বা তৎপূর্বে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন তাহা কতকটা নিৎসন্দেহে বলা যাইতে পারে। কালিদাস তাহার অভিজ্ঞানশকুন্তলম, মালবিকাপ্নিমিত্রম, বিক্রমোবশীযম প্রভৃতি নাটকে, রঘুবংশম, কুমারসম্ভবম্ কাব্যে যে কামশাস্ত্রের বিষয় বর্ণনা করিয়াছেন, তাহা তিনি ঘোটকমূখ গোনর্দ, গোণিকাপুত্র বাৎসায়নেরকামশাস্ত্র হইতে গ্রহণ করিয়াছিলেন। কালিদাস খ্রীষ্টপূর্ব  প্রথম শতকে আবির্ভূত হইয়া থাকিলে বাৎসায়নকে আমরা অনায়াসে খ্রীষ্ট পূর্ব দ্বিতীয় বা তৃতীয় শতাব্দীর শাস্ত্রকার বলিয়া ধরিয়া লইতে পারি। বাৎসায়নের কামসূত্রকে অবলম্বন করিয়া কয়েকটি কামশাস্ত্র পরবর্তীকালে রচিত হইয়াছিল। তাহার মধ্যে কাশ্মীরের বিখ্যাত কবি ক্ষেমেন্দ্র বাৎসায়নসূত্রসার নামে কামসূত্রের একটি সংক্ষিপ্তসার রচনা করিয়াছিলেন। দুঃখের বিষয় এই মূল্যবান গ্রন্থটি এখন আর পাওয়া যায় না। যশোধর, যশোধরেন্দ্রপ্রভ বা যশোধরেন্দ্রপাদ নামক এক ব্যক্তি কামসূত্রের টীকা জয়মঙ্গলার রচয়িতা বলিয়া কথিত হইয়া থাকে। কেহ কেহ শঙ্করায বা শঙ্করাচার্য নামক কোন ব্যক্তিকে এই টীকার রচয়িতা মনে করেন। কারণ কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, কামন্দকের নীতিসার ভট্টিকাব্য সাংখ্যসপ্তশতী প্রভৃতির টীকা শঙ্করার্য নামক এক ব্যক্তি রচনা করিয়াছিলেন। তাঁহারা বলেন, যশোধর একজন পূথি লেখকের নাম। কিন্তু তাহা সম্ভব নহে। একজন পুথি লেখকের নামে জয়মঙ্গলার মতো টীকা চলিতে পারে না। জয়মঙ্গলা অতি বিশদ টীকা, ইহাতে রচয়িতর বহুশাস্ত্রে পান্ডিত্য প্রদর্শিত হইয়াছে। এই টীকার রচনাকাল সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না, তবে ইহা কোক্কোকের রতিরহস্যের পরে রচিত হইয়াছিল। বাঘেলা রাজবংশের নৃপতি রামচন্দ্রদেবের পুত্র রাজা বীরভদ্রদেব কন্দপচূড়ামণি নামে কামসূত্রের একটি পদ্যময়ী ব্যাখ্যা অথবা পদ্যানুবাদ রচনা করিয়াছিলেন, তাহার রচনাকাল ১৬৩৩ সংবৎ বা ১৫৭৭ খ্রীস্টাব্দ। কাশীর সর্বেশ্বর শাস্ত্রীর শিষ্য ভাস্কর নৃসিংহ শাস্ত্রী নামক এক পন্ডিত কোন রাজা ব্রজলালের অনুকূল্যে ১৭৪৪ সংবতে বা ১৭৮৯ খ্রীস্টাব্দে সূত্রবৃত্তি নামক কামসূত্রের একটি টীকা রচনা করিয়াছিলেন। মল্লদেব নামক একজন পন্ডিত কামসূত্রের একটি টিকা রচনা করিয়াছিলেন, তাহা আমাদের হস্তগত হয় নাই। পঞ্চসায়ক নামক কামশাস্ত্রে মূলদেব নামক একজন কামশাস্ত্রকারের উল্লেখ আছে, তিনিইহয়ত  তথাকথিত মল্লেদেব হইতে পারেন। বাৎসায়ন কামসূত্রে ওন্দালকি, গোণিকাপুত্র, গোনর্দীয়, সুবর্ণনাভ প্রভৃতি পূর্বাচার্যগণের মতের উল্লেখ করিয়াছেন। তাহা হইতে বুঝা যায় তিনি তাঁহাদের শাস্ত্র গুলির সহিত পরিচিত ছিলেন, কিংবা যে বাভ্রবাক্যে তিতিন অনুসরণ করিয়াছিলেন তাহার গ্রন্থে ঐস কল পূর্বাচার্যদিগের শাস্ত্র হইতে উদধৃত উক্তি চাক্ষুষ করিয়াছিলেন। বাৎসায়নের কামসূত্রের পর আমরা যে সকল কামশাস্ত্র পাই, সেগুলির মধ্যে দামোদর গুপ্তের কুট্টনীমতম্ বা শম্ভলীমতম্ প্রাচীনতম। দামোদর গুপ্ত কাশ্মীরের কটি বংশীয় নৃপতি জয়পীড়ের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। কুট্টনীমতম ১০৬০ টি আর্যাছন্দে রচিত শ্লোকে কাব্যাটি গ্রথিত। দুর্বল প্রকৃতি ধনীর পুত্রগণকে বারাঙ্গনাগণ কামকলায় প্রলুব্ধ করিয়া তাহাদের সর্বস্ব অপহরণ করে তাহা দেখাইয়া তাহাদিগকে সাবধান করিয়া দিয়াছেন। এই কাব্যে কবি তাহার বিবিধ বিষয়ে অসাধারণ বুৎপত্তি প্রদর্শন করিয়াছেন। অন্যান্য কবির উদধৃতি হইতে বুঝা যায় দামোদর গুপ্ত আরও কয়েকটি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। দামোদরগুপ্তের পর আমরা নাগরসর্বস্বম্ এর রচয়িতা পদ্মশ্রী বা পষ্মশ্রীজ্ঞানের নাম পাই। ইনি একজন বৌদ্ধশ্রমণ। ইহার গ্রন্থে ইনি দামোদর গুপ্তের নামোল্লেখ করিয়াছেন। পক্ষান্তরে শাঙ্গধরপদ্ধতিতে পষ্মশ্রীর কয়েকটি শ্লোক উদ্ধৃত করা হইয়াছে, সুতরাং ইনি খ্রীষ্টীয় দশম বা একাদশ শতাব্দীতে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন বলিয়া অনুমান করা যায়। ইহার পরেই আমরা  কোক্কোকের নাম করিতে পারি। রতিরহস্য সর্বাপেক্ষা সুপ্রচারিত কামশাস্ত্র। ইহার রচয়িতা কোক্কোকের নাম হইতে লোকে তাঁহার রচিত গ্রন্থকে কোক্কোশাস্ত্র বলে। ইহা অনঙ্গরঙ্গ প্রভৃতি পরবর্তী কামশাস্ত্রগুলির আদর্শ পুস্তক। কোক্কোকের প্রাদুর্ভাব কাল সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না। কোক্কোকের পিতার নাম গদ্য বিদ্যাধর বা বৈদ্য বিদ্যাধর এবং পিতামহের নাম তেজোক। পারিভদ্র নামক এক পন্ডিত ছিলেন ইহার পূর্বপুরুষ। কামসূত্রের টীকা জয়মঙ্গলায় রতিরহস্যের একটি শ্লোক উদধৃত করা হইয়াছে তাহা হইতে বুঝা যায় রতিরহস্য জয়মঙ্গলার পূর্বে রচিত হইয়াছিল। পদ্মশ্রী যে কোক্কোকের পূর্ববর্তী তাহার কোন প্রমাণ না, কিন্তু পন্ডিতগণ মনে করেন কোক্কোক পদ্মশ্রীর পরে প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন। রতিরহস্যের পর্যন্ত চারটি টীকা আবিষ্কৃত হইয়াছে ) কাঞ্চনাথকৃত টীকা দীপিকা, ) অবঞ্চ রামচন্দ্রকৃত টীকা, ) কবি প্রভুকৃত টীকা এবং ) হরিহরকৃত টীকা শৃঙ্গারসবন্ধপ্রদীপিকা। বিজয়নগর বা বিজিয়ানগরম্ এর নৃপতি ইম্মাদী পৌঢ়দের রায় রতিরত্বপ্রদীপিকা নামক একটি কামশাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছিলেন, তাহা রতিরহস্যেরই অনুকরণে লিখিত একরকম পদ্যে লিখিত টীকাই বলা যাইতে পারে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে এই গ্রন্থের যে অংশটি পাওয়া গিয়াছে তাহা খন্ডিত। ভাষাধিকারিক, পারদারিক, বৈশিক ইত্যাদি অধ্যায়গুলি ইহাতে নাই যাহারা ইহা মুদ্রিত প্রকাশিত করিয়াছেন তাঁহারা কেন যে এই ত্রুটিটি লক্ষ্য করেন নাই তাহা বুঝিলাম না। এইস ময়ে বলা উচিত গীতগোবিন্দ কাব্যের রচয়িতা জয়দেব একটি ক্ষুদ্র রতিশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন, তাহার নাম রতিমঞ্জরী। জয়দেব সেন বংশীয় রাজা লক্ষণ সেনের সভাসদ ছিলেন। এতদ্ব্যতীত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কামশাস্ত্র রচিত হইয়াছিল, যথা স্মরদীপিকা, কামসমূহ ইত্যাদি। অতিবীর রামপন্ডিয়ন নামক একজন তামিল পন্ডিত তামিল ভাষায় কোক্কোকের রতিরহস্যের অনুবাদ করিয়াছিলেন এবং সেই গ্রন্থের নাম দিয়াছিলেন কোক্কোকম্ এই তামিল অনুবাদটি সিংহলের একজন ডক্টর অফ লিটারেচার যতোধর্মস্ততোজয়ঃ এই ছন্দনামে অনুবাদ করিয়া ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে কলম্বো হইতে প্রকাশ করেন। এইইং রেজী অনুবাদের ভূমিকায় তিনি ১৯ টি বিষয়ের উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু তাহার গ্রন্থের শেষে রতিরহস্যের কন্যাবিস্রম্ভণ পারদারিকাধিকার অধ্যায় বাদ দেওয়া হইল বলিয়া জানাইয়াছেন। এই অধ্যায় দুটি মূলত তামিল অনুবাদেইবাদ  দেওয়া হইয়াছে বা এই ইংরেজী অনুবাদে বাদ দেওয়া হইল তাহা বুঝা যায় না। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে জ্যোতিরীশ্বর ঠাক্কুর নামক এক পন্ডিত পঞ্চসায়খ নামে একটি কামশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন। তাহার তারিখ ঠিক জানা যায় না, তবে তিনি পূর্বাচার্যদিগের মধ্যে ক্ষেমেন্দ্ররনাম উল্লেখ করিয়াছেন। জ্যোতিরীম্বর বিখ্যাত বৈষ্ণব কবি বিদ্যাপতির প্রপিতামহ এবং তাঁহার নিবাস ছিল মিথিলায়। বিদ্যাপতি চতুর্দশ শতাব্দীর মাঝামাঝি প্রাদৃর্ভুত হইয়াছিল। রতিরহস্যের পর উল্লেকযোগ্য বিখ্যাত কামশাস্ত্র হইতেছে অনঙ্গরঙ্গ। স্যার রিচার্ড বার্টন ইহার ইংরেজী অনুবাদ করিয়াছিলেন। পরে ১৯০৭ খ্রীষ্টাব্দে চালর্স ক্যারিংটন প্যারি হইতে ইহা পুনমুদ্রিত প্রকাশিত করিয়াছিলেন। কল্যানমল্ল নামক একজন রাজপুত্র পন্ডিত লাড়খা নামক লোদীবংশীয় একজন প্রাদেশিক শাসনকর্তার আনুকূল্যে এই কামশাস্ত্র প্রণয়ন করিয়াছিলেন। লাড় খাঁকে আহমদ খাঁ লোদীর পুত্র বলা হইয়াছে। আমরা ওয়াকিয়াৎ--মুশ্তাকি নামক ঐতিহাসিক গ্রন্থ হইতে জানিতে পারি সুলতান সিকান্দার লোদীর শাসনকালে জুমাল খাঁ লোদী সারংখানির পুত্র আহমদ খাঁ লোদী জৌনপুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত হইয়া ছিলেন। তিনি সিকান্দার লোদীর ৪৪ জন সামন্তের অন্যতম এবং এটওয়ার নায়েব ছিলেন। লাড় খাঁ তাহার এক পুত্র হইতে পারেন। অনঙ্গরঙ্গ ফার্সী ভাষায় অনুদিত হইয়াছিল। লিব্জৎ-অলনিসা বা রমনীগণের আনন্দ এইনা মে ইহার একটি উর্দু অনুবাদও হইয়াছিল। মদনমোহন দে নামক এক ব্যক্তি কলিকাতা হইতে ১২৫৮ বঙ্গাব্দে সম্ভোগ রত্নাকর নামে কবিতায় ইহার একটি অসম্পূর্ণ অনুবাদ প্রকাশ করিয়াছিলেন। সমস্ত ভারতবর্ষে এবং হয়ত ভারতের বাহিরে চীন ওজাপানেও ইহার অনুবাদ প্রচারিত হইয়াছিল। অনঙ্গরঙ্গের অনুকরণে কামপ্রবোধ নামক একটি কামশাস্ত্র বিকানীরের রাজা কর্ণের পুত্র অনপসিংহের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাস জনার্দন নামক এক পন্ডিত রচনা করেন। ইহাকে অনঙ্গবঙ্গের আক্ষরিক অনুকরণ বলা যাইতে পারে। এতদব্যতীত অনন্ত নামক এক পন্ডিত ১৪৫৭ খ্রীষ্টাব্দে কামসমূহ নামকএকটি  কামশাস্ত্র রচনা করিয়াছিলেন। হরিহর নামক এক ব্যক্তির রচিত রতিরহস্যের উল্লেখ তাহা হইতে উদ্ধৃতিও আমরা দেখিতে পাই। রুদ্র বা কদ্র রুদ্রের স্মরদীপিকা এই রূপ একটি কামশাস্ত্র। আমরা এইরুপ বহু প্রাচীন অর্বাচীন কামশাস্ত্রের উল্লেখ পাই, তাহার অধিকাংশই এখন বিলুপ্ত। অধ্যাপক চাকলাদার বাৎসায়নকে দক্ষিণ পশ্চিম ভারতের অধিবাসী বলিয়া অনুমান করেন। আমাদের মনে হয়, তাহার অনুমান ঠিক। তিনি বলেন, বাৎসায়ন অল্প বিস্তর সমস্ত ভারতবর্ষ সম্বন্ধে পরিচিত ছিলেন, কিন্তু দক্ষিণ- পশ্চিম ভারত সম্বন্ধে তাঁহার অভিজ্ঞতা অধিক ছিল। তিনি অবন্তী, মালব, অপরান্ত, লাট, সৌরাষ্ট্র, বিদভ, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি দেশ এবং বিদর্ভের বংসগুল্মক, অন্ধ্র, আভীর জাতির বার বার উল্লেখ করিয়াছেন, অথচ উত্তর পশ্চিম ভারতের সিন্ধু পাঞ্জাবের অধিবাসী বাহলিকদিগের আচার সম্বন্ধে একবার এবং দক্ষিণাপথের দ্রাবিড়দিগের চোলদিগের সম্বন্ধে এক বার এবং দক্ষিনাপথের দ্রাবিড়দিগের চোলদিগের সম্বন্ধে একবার মাত্র উল্লেখ করিয়াছেন। পূর্ ভারতের লোকদিগকে প্রাচ্যদেশীয় বলিয়াছেন এবং একবার মাত্র অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গের উল্লেখ করিয়াছেন। মগধের নামএকবারও  করেন নাই, তবে সাম্প্রযোগিক অধিকরণের নবম অধ্যায়ে ২৭ সূত্রে নাগরককাঃ শব্দ আছে, যশোধর যে তাহার ব্যাখ্যা করিয়াছেন পাটলিপুত্রকাঃ তাহা ঠিক কিনা বুঝা যায় না, কারণ অন্যত্র পাটলিপুত্র নগরের নাম করিয়াছেন। তবে এস্থলে কেবল নাগরক শব্দটি ব্যবহার করিলেন কেন? অধ্যাপক চাকলাদার মনে করেন ইহা একটি প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের অধিবাসীগণকে বুঝাইতেছে। রাজপুতানার জয়পুর রাজ্যের মধ্যে নগর নামক একটি বৃহৎ প্রাচীন নগর ছিল, তাহার ধ্বংসাবশেষ এখনও দেখা যায়। চিতোরের প্রায় এগারো মাইল উত্তরে আরএকটি  প্রাচীন শহর ছিল তাহারনাম অম্ববতী নগরী, তাহাকে পতজলির মধ্যমিকা বলিয়া পন্ডিতগণ মনে করেন। ইহা বাৎসায়নের নগর হইতে পারে না, কারণ ইহা খৃস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীতেও মধ্যমিকা মঝমিকা নামে পরিচিত ছিল। এইরুপ কোন একটি নগরের নাম হইতে নাগরী অক্ষরের নামকরণ হইয়া থাকবে। মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বাৎসায়নকে মগধের অধিবাসী বলিতে চাহিয়াছেন। অধ্যাপক চাকলাদার তাহার যুক্তি খন্ডন করিয়াছেন। বাৎসায়নের একযার মাত্র মধ্যদেশের উল্লেখ করিয়াছেন এবং সৌরসেন সাকেত অহিচ্ছত্রের নাম মাত্র একবার করিয়া উল্লেখ করিয়াছেন। আমরা কামসূত্র হইতে যে যুগের প্রাচীন ভারতের সামাজিক জীবনের একটি সুন্দর চিত্র পাই। যদিও মূলতঃ ইহা কামশাস্ত্র, তথাপি ইহা ভারতীয় সমাজের অনেক অনুঘাটিত দিকের উপর আলোকপাত করে, যাহা অন্য কোন গ্রন্থ হইতে জানা যায়না। ধর্মশাস্ত্রগুলিতে কথিত বর্ণাশ্রমধর্ম অনুসরণ করিয়া সমাজ চলিত। বাৎসায় বলিয়াছেন, শতায়ুবৈপুরুষ অর্থাৎ পুরুষের আনুমানিক আয়ু একশত বৎসর। এই এশত বৎসরকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করিয়া বাল্য, যৌবন বার্ধক্যে ত্রিবর্গেরই সেবা করিবে। বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষা সেই সঙ্গে অর্থোপার্জনের উপায় শিক্ষা করিবে। বিদ্যালাভ হওয়া পর্যন্ত ব্রক্ষ্মচর্যের সেবাই কর্তব্য। তাহার পর বিবাহ করিয়া গার্হস্থ্য জীবনযাপন কামের সেবা করিবে এবং বার্ধ্যক্যে ধর্মও মোক্ষ অর্থাৎ ধর্মচর্চা করিয়া মোক্ষলাভের উপায় চিন্তা করিবে। বয়ো বিভাগ সম্বন্ধে টীকাকর বলিতেছেন- আষোড়ণাদ ভবেদৃবালো যাবৎ ক্ষীরানুবর্তক। মধ্যম সম্পতি যাবৎ পরতো বৃদ্ধ উচ্যতে। অর্থাং ষোল বৎসর বয়স পর্যন্ত বালক বলা হয়, সত্তর বৎসর বয়ষ পর্যন্ত মধ্যম এবং তাহার পর বৃদ্ধ। এই মধ্যম শব্দে যৌবনকাল পৌঢ়ত্বকে একত্র ধরা হইয়াছে, তাহার কারণ পুরুষ সত্তর বৎসর পর্যন্ত কামসেবা সন্তান উৎপাদনে সমর্থ। কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে লেখা আছে, দ্বাদশবর্ষা স্ত্রী প্রাপ্তব্যবহারা ভবতি। ষোড়শবর্ষ পুমান অর্থাৎ যে স্ত্রীর দ্বাদশ বৎসর বয়স অতিক্রান্ত হইয়াছে, সে প্রাপ্ত ব্যবহারা, অর্থাৎ সাবালিকা হয় এবং পুরুষ ষোল বৎসরে সাবালক হয়। ধর্মশাস্ত্র কৌটিল্যের অর্থাশাস্ত্রে আট প্রকাশ বিবাহের উল্লেখআছে যথা- ) যে বিবাহে কন্যাকে অলঙ্কৃত করিয়া বরের হস্তে প্রদান করা হয়, তাহার নাম ব্রাক্ষস বিবাহ।

) যে বিবাহে কন্যা বর একসঙ্গে মিলিত হইয়া ধর্মাচরণ করিবে বলিয়া প্রতিশ্রুত হইয়া পরিনীত হয়, তাহার নাম প্রাজাপত্য বিবাহ।

) যে বিবাহে বরের দিকট হইতে দুইটি গাভী গ্রহণ করিয়া কন্যা প্রদত্ত হয়, তাহার নাম আর্ষ বিবাহ।

) যে বিবাহে যজ্ঞবেদিমধ্যে স্থিত ঋত্বিকের নিকট কন্যা প্রদত্ত হয়, তাহার নাম দৈব বিবাহ।

) যে বিবাহে বর কন্যা নিজেচ্ছায় পিতামাতার অভিমত না লইয়া অন্যোন্যকে গ্রহণ করে, তাহার নাম গান্ধর্ব বিবাহ।

) যে বিবাহে বর কন্যার পিতাকে বা কন্যাকে শুল্কধন দিয়া কন্যা গ্রহণ করে, তাহার নাম আসুর বিবাহ।

) যে বিবাহে বলাৎকারে কন্যা গ্রহণ করা হয়, তাহার নাম রাক্ষস বিবাহ।

) যে বিবাহে সুপ্তা কন্যানেক হরণ করিয়া নিয়া বিবাহ করা হয়, তাহার নাম পৈশাচ বিবাহ।

কৌটিল্য বলেন, ইহার মধ্যে প্রথম চারিটি বিবাহ ধম্য অর্থাৎ ধর্মানুকুল বলিয়া বিবেচিত হয়। কারণ এগুলিতে পিতার অনুমোদন থাকে। আর অবশিস্ট চারিটি বিবাহও ধর্মানুগত মনে করা যায়, যদি এগুলিতে পিতা মাতা উভয়ের অনুমোদন লাভ করা যায়। বাৎসায়ন বলেন দেশাচার অনুসারে ব্রাক্ষ্ম, প্রাজাপত্য, আর্ষ দৈব-ইহার যে কোন প্রকার বিধানে যথাশাস্ত্র কন্যার পালিগ্রহণ করিবে। বাৎসায়ন কন্যাসংপ্রযুক্তক অধিকরণের শেষে মন্তব্য করিয়াছেন-

কুঢ়ানাং হি বিবাহানামরাগ ফলং যতঃ
মধ্যমোহপিহিদ্ যোগো গাধর্বস্তেন পুজিত।
সুখত্বাদবহক্লেশাদপি চাবরণাদিহ।
অনুরাগাত্মকত্বাচ্চগান্ধর্বঃ প্রবরো মতঃ

অর্থাৎ, সমপ্ত বিবাহের মধ্যে গান্ধর্ব বিবাহ মধ্যম হইলেও অনুরাগাত্মক বলিয়া ইহা সাধারণের আদৃত কারণ সকল বিবাহেই অনুরাগ ফলস্বরূপ। সংসারে গান্ধর্ব বিবাহ সুখের কারণ-ইহাতে সম্বন্ধ করিবার বা ঝামেলা সহ্য করিতে হয় না। অনুরাগ ভরেই এই বিবাহ সম্পন্ন হইয়া থাকে। কাজেই যাহারা দাম্পত্যসুখ আকাঙ্খা করে তাহাদের পক্ষে গান্ধর্ব বিবাহ শ্রেষ্ঠ। ধর্মশাস্ত্রগুলির ন্যায় বাৎসায়নের কামসূত্রে আমরা দেখিতে পাই, ভারতীয় সমাজের সমস্ত লোক চারিবণে বিভক্ত এবং প্রত্যেক লোকের জীবনযাত্রা চারটি আশ্রমে বিভক্ত। কোন নাগরিক অর্থাৎ সম্পন্নগৃহস্থ যদি সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে চায় তাহা হইলে তাহাকে অর্থোপার্জন করিতে হইবে। বাৎসায়ন চারিটি উপায়ে অর্থ সংগ্রহের কথা বলিয়াছেন- ) প্রতিগ্রহ অর্থাৎ দানগ্রহন, )জয় অর্থাৎ বলপূর্বক অধিকার, ) ক্রয অর্থাৎ ব্যবসা, ) নির্বেশ কাজ করিয়া দিবার জন্য পারিশ্রমিক। শিক্ষা সম্পূর্ণ করিয়া গৃহস্থজীবনযাপনের পূর্বে ব্রাক্ষণ যাগ-যজ্ঞ করিয়া রাজা ধনী ব্যক্তিদিগের নিকট হইতে যে অর্থ দানস্বরূপ পাইবেন তাহাই তাহার আয়। ক্ষত্রিয় বৃদ্ধ করিয়া যে সম্পত্তি বা অর্থ লাভ করিবেন। তাহা তাহার আয়। বৈশ্য বা বণিকগণ ব্যবসা হইতে যাহা উপার্জন করিবেন, তাহা তাঁহার আয় আর শুদ্রকায়িক পরিশ্রম দ্বারা যাহা উপার্জন করিবেন, তাহা তাহার আয়। ইহার সহিত উত্তরাধিকারসূত্রে যাহা পাইবেন, তাহাও তাঁহারসম্পত্তি। কামসূত্রে বহুস্থানে ব্রাক্ষণের উল্লেখ আছে। ব্রাক্ষ্মণকে দান করিলে দীর্ঘজীবন যশঃলাভ হয়। কোন ধনী রমনী যদি ব্রাক্ষণকে সহস্র গোদান করে, তাহা হইলে তাহা মহাপুন্যের কাজ বলিয়া পরিগণিত হইত। সেকালে ব্রাক্ষণগণ গণিকার নিকট হইতে দান গ্রহণ করিতেন না। সেইজন্য কোন ধনশালিনী গণিকা যদি এইরূপ দান করিত, তাহা হইলে তাঁহারা অন্যব্যক্তির হাত হইতে তাহা গ্রহন করিতেন। রাজার অন্তঃপুরে কোন পুরুষের প্রবেশ নিষিদ্ধ, কিন্তু ব্রাক্ষ্মণগন সেখানে প্রবেশ করিয়া তিরস্করিনীর আড়াল হইতে মহিলাদিগের সহিত আলাপ করিতেন। ব্রাক্ষণগণ বিবিধ ধর্মীয অনুষ্ঠানকরিতেন, তাহাদের সেইজন্য বিবিধ নাম ছিল। যেমন শ্রোত্রিয় ব্রাক্ষ্মণের গৃহে প্রতিদান যজ্ঞ হইত সেইজন্য সর্বদাই আপ্নি প্রজ্বলিত থাকিত। বিবাহেচ্ছদ্দ দম্পতি শ্রোত্রিয়ের বাড়ি হইতে আপ্নি সংগ্রহ করিয়া আগ্নিসাক্ষী করিয়া বিবাহ করিতেন। ইহা ব্যতীত ব্রক্ষচারী, দীক্ষিত, ব্রতী, লিঙ্গী, ইত্যাদি বহু বিভিন্ন বৃত্তির ব্রাক্ষণের উল্লেখ পাই। বাৎসায়নের যুগে রাজা সমাজে একটা বিশিষ্ট স্থান অধিকার করিতেন। রাজা হইলেই যে তিনি জাতিতে বা বর্ণে ক্ষত্রিয় হইতেন তাহা মনে হয় না। বাৎসায়ন ক্ষত্রিয় শব্দটি মাত্র একবার উল্লেখ করিয়াছেন। সেখানেও বলিয়াছেন, আভীর রাজাদিগের অন্তঃপুর ক্ষত্রিয় জাতির রক্ষীদিগের দ্বারা রক্ষিত হইত। ইহাতে বোঝা যায় আভীরগণ ক্ষত্রিয় ছিলেন না। বাৎসায়ন বৈশ্য শুদ্রদিগকে স্পষ্টত উল্লেখ করেন নাই, কিন্তু তাহাদের জাতিগত বৃত্তিসমূহের উল্লেখ করিয়াছেন। যথা- দৈবজ্ঞ, বৈদ্য, মালাকার, গান্ধিক, রজক, নীলিকুসুম্ভরঞ্জক, নাপিত, সৌন্ধিক, তাম্বুলিক, সুবর্নকার, মণিকার, বৈকতিক, কুশীলব, গায়ন। অনেক বৃত্তিজীবী নিজ নিজ বৃত্তি অনুসারে এক একটি জাতির অন্তর্গত ছিল, কিন্তু সকল বৃত্তিজীবীই এক শুদ্রবর্ণের অন্তর্ভূক্ত ছিল। কামসূত্রে দৈবজ্ঞ বা বৈদ্য বলিয়া কোন পৃথক জাতির উল্লেখ নাই। বাৎসায়ন অনেক রাজকর্মচারীর উল্লেখ করিয়াছেন, কিন্তু তাহাদের জাতির বা বর্ণের সম্বন্ধে উল্লেখ করেন নাই। বাৎসায়ন ব্রক্ষচর্য গার্হস্থ্য আশ্রম সম্বন্ধে অনেক কিছু বলিয়াছেন, কিন্তু বাণপ্রস্থ যতি আশ্রম সম্পন্ধে বিশেষ কিছু বলেন নাই। তিনি লিঙ্গী অর্থাৎ যাহার নিজ নিজসম্প্রদায়ের চিহ্ন ললাটে বহন করেন, এইরূপ সন্ন্যাসী এবং প্রব্রজিতা, শ্রমণ্য ক্ষপনিকা, তাপসী ভিক্ষুকী মুন্ডা ইত্যাদি সন্নাসিনী দিগের উল্লেখ করিয়াছেন। ইহারমধ্যে শ্রমণা হইতেছেন বৌদ্ধ সন্ন্যাসিনী এবং ক্ষপনিকা জৈন সন্ন্যাসিনী বা সাধ্বী। তাপসী সম্ভবত সনাতন বৈদিক বা ব্রাক্ষণ্যধর্মের সন্ন্যাসিনী। কামসূত্রে বানপ্রস্থআশ্রমের কোন উল্লেখ নাই। কারণ বনবাসী তাপসদিগের সহিত কামের কোন সম্পর্ক ছিল না। অধিকন্তু মনে হয়, সে যুগে বানপ্রস্থ আশ্রম সমাজে অপ্রচলিত হইয়া গিয়াছিল। বৈখানস ধর্মসূত্র হইতে আমরা জানিতে পারি, কেবলমাত্র ব্রাক্ষ্মণগনই চারিটি আশ্রম পালন করিতেন। ক্ষত্রিয়গণ তিনটি বৈশ্যগন দুইটি ব্রক্ষচর্য গার্হস্থ্য এবং শুদ্রগণ সারাজীবন গার্হস্থ্যধর্মই পালন করিতেন। শিক্ষা সমাপ্ত না করিয়া বাৎসায়নের যুগে কোন লোক বিবাহ করিত না। সাধারণতঃ লোকে সবর্ণেই বিবাহ করিত। অসবর্ণ বিবাহও অপ্রচলিত ছিল না। আভিজাত্য সম্পন্ন মাতৃপিতৃবতী নিজ বয়স হইতে অন্তত তিন বৎসরের কম বয়সের, সৎকুলজাতা, কোনরকম দৈহিকত্রুটি যাহার নাই এইরুপ কুমারীকে বিবাহ করা উচিত, ইহাই বাৎসায়ন উপদেশ দিয়াছেন। তবে সববয়স্কা বা বয়সে বড় কন্যার সহিতও বিবাহ হইত। এই সকল বিবাহ প্রনয়ঘটিত বিবাহ গান্ধর্ব বিবাহের রীতিতেই সম্পন্ন হইত। বাৎসায়ন বলিয়াছেন, যে নারী তোমাকে সুখী করিবে  তাহাকেই বিবাহ করিবে। বিবাহোপযুক্তা কন্যা বাল্য, যুবতী বা প্রৌঢ়াও হইতে পারে। পাত্রের মিত্রগণ ঘনিষ্ঠ আত্নীয়গণ পাত্রী পছন্দ করিতেন, অথবা স্বয়ং পাত্রই পাত্রীকে পছন্দ করিতেন। যে কন্যাকে দেখিলে মন চক্ষুর প্রীতি উৎপাদন হয় তাহাকে বিবাহ করিলে ধর্ম, অর্থ কাম লাভ হইয়া থাকে। বাৎসায়ন তাহার কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন নগরের সৌখীন লোকদিগের জন্য যাহাদিগকে তিনি নাগরক আখ্যা দিয়াছেন। যে ব্যক্তি শিক্ষা সমাপনান্তে গার্হস্থ্যআশ্রম অবলম্বন করিয়া পৈত্রিক অর্থ সম্পত্তি এবং নিজ বৃত্তি এবং নিজ বৃত্তি দ্বারা উপার্জিত অর্থে সাংসারিক জীবন যাপন করিতে চাহে, বাৎসায়ন তাহাকে কোন নগরে বাস করিতে উপদেশ দিয়াছেন। সেই নগর ছোট বা বড়ই হউক না কেন অন্তত যেন বহু সৎ এবং অভিজাত ব্যক্তির বাসস্থান হয়। যথা- নগর, পত্তন বা খর্বট। সেই স্থানে সে নিজের বিদ্যাবুদ্ধি, শিল্পকৌশল দ্বারা রাজা বা কোন ধনী নাগরিকের অনুগ্রহ অথবা কোন নাগরিকগোষ্ঠী বা সমিতিতে শ্রেষ্ঠী শিল্পীদিগের সমবায়ে নিয়োজিত হইতে পারে। নাগরকের গৃহ সম্বন্ধে বাৎসায়ন যাহা বলিয়াছেন, তাহাতে তাহার সৌন্দর্যের রুচি প্রীতি সূচনা করে এবং তাহার গৃহের সাদাসিধা অথচ বাছাই-করা আসবাবপত্র অলঙ্করণ হইতে তাহার চারুকলা বহুমুখীকৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। নাগরিক কোন জলাশয়ের নিকটে গৃহ নির্মাণ করিবে, যাহাতে কদাচ জলাভাব না ঘটে। গৃহটি দুইভাগে বিভক্ত হইবে। ভিতরের অংশটি অন্তঃপুর অর্থাৎ মহিলাদিগের জন্য এবং গৃহস্বামী তাহার কার্য করিবেন অতিথি অভ্যাগতদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিবেন বলিয়া বাহিরের অংশ তাহার জন্য নির্দিষ্ট। প্রত্যেক অংশে বিভিন্ন কার্যের জন্য কয়েকটি কক্ষ থাকিবে। একটি বৃক্ষবাটিকা থাকিবে খোলা জায়গা থাকিবে সেখানে নানাপ্রকার ফল ফুলের গাছ থাকিবে, শাকসব্জী প্রভৃতি জন্মাইবার জন্য পৃথক স্থান থাকিবে। নাগরকের বহিবাটির একটি কক্ষে দুইটি পালঙ্ক থাকিবে। একটিতে শুভ্রধৌত বস্ত্রাচ্ছাদিত সুকোমল শয্যা থাকিবে , এই শয্যা নিন্দ্রা যাইবার জন্য। অপর পালঙ্কটিতেও ঐরূপ শয্যা পাতা থাকিবে, তাহা সম্প্রযোগ্যর্থ। শয্যার মাথার দিকে একটি কুর্চাসনে, সম্ভবতঃ কুলুঙ্গীতে, ইষ্টদেবতার মুর্তি স্থাপিত থাকিবে। শয্যার সংলগ্ন একটি কাষ্ঠের বেদী অর্থাৎ চৌকী থাকিবে, চৌকিটি পালঙ্কের সমান উচ্চ এবং প্রস্তার একহাত মাত্র তাহাতে রাত্রিতে ব্যবহারের জন্য অনুলেপন, মোমের কৌটা, গন্ধদ্রব্য রাখিবার পাত্র, মাতুলুঙ্গ বা কমলালেবুর খোসা, পানের ডিবা ইত্যাদি থাকিবে। ঘরের মেঝেতে পতদগ্রহ অর্থাৎ পিকদানী থাকিবে। ঘরের দেয়ালে নাগদন্তে অর্থাৎ ব্রাকেটে বীনা, চিত্রফলক, তুলি রংয়ের পত্র কোন পুস্তক কুরন্টফুলের মালা ইত্যাদি থাকিবে। গৃহকুট্টিমে শয্যার অনতিদূরে পিঠওয়ালা গোল আসন থাকিবে। আকর্ষফলক দ্যতফলক, অর্থাৎ দাবা  পাশাখেলার ছক থাকিবে। বাহিরে পোষাপাখির খাঁচা থাকিবে। বাড়ির উঠানে বা উদ্যানে গাছের ছায়ার তলে দোলা পুষ্পাস্তীর্ণ পাঠিকা থাকিবে। নাগরক প্রভাতে শয্যা হইতে গাত্রোখান করিয়া নিত্যকর্ম সম্পাদনপূর্বক দন্তধাবন করিয়া কিঞ্চিৎ অনুলেপন লইয়া সুরভিত ধুপের ধোঁয়ায় বস্ত্র সুবাসিত করিয়া মুখে মোম আলতা দিয়া, মাথায় বা গলায় মালা পরিয়া তাস্বুল চর্বন করিতে করিতে নিজ কার্য করিবে। সে প্রত্যহ স্থান করিবে, একদিন অন্তর গায়ের ময়লা তুলিবে দুইদিন অন্তর ফেনক ব্যবহার করিবে, তিনদিন অন্তর ক্ষৌরকর্ম করিবে, পঞ্চমদিন কক্ষের দশম দিনে জঘনের লোমশাতন করিবে; সতত কক্ষের ঘর্ম রুমাল দিয়া মুছিয়া ফেলিবে। পূর্বাহ্নে এবং অপরাহ্নে অথবা সায়াহ্নে ভোজন করিবে। পূর্বাহ্নে ভোজনের পর কিছুক্ষণ শয্যায় শুইয়া বিশ্রাম করিবে তাহার পর শুকসারিকে পড়াইবে। লাবক কুক্কুট মেঘদিগকে যুদ্ধ শিক্ষা দিবে এবং পীঠমর্দ, বিট বিদূষকের সহিত দ্যুত আকর্ষক্রীড়াদি করিবে। অপরাহ্নে প্রসাধন করিয়া গোষ্ঠীতে যাইবে। সন্ধ্যাকালে গানবাজনা করিবে। তাহার পর বাসগৃহ সুসজ্জিত সুরভিত ধুপাদি দ্বারা সুবাসিত করিয়া বন্ধুবান্ধবদিগের সহিত শয্যার উপবেশন করিয়া অভিসারিকাদিগের জন্য প্রতীক্ষা করিবে। অভিসারিকার আগমনের বিলম্ব ঘটিলে দূতীদিগকে পাঠাইবে বা নিজেই যাইবে। অভিসারিকা নায়িকা আসিলে সহায় মিত্রদিগের সহিত মিলিত হইয়া মনোহর আলাপে এবং তাম্বুলাদি উপচার দিয়া মনোরঞ্জন করিবে। যদি বৃষ্টিপাতে অভিসারিকার বেশভূষা বিপর্যস্ত হয় তবে নিজে তাহার বেশ পরিবর্তন করিয়া দিবে, অথবা মিত্রদিগের দ্বারা পরিচর্যা করাইবে। এখানে বলিয়া রাখা কর্তব্য যে এই অভিসারিকা হইতেছে কোন গণিকা অথবা গায়িকা বা নর্তকী। সেকালে অবস্থাপন্ন নাগরকগণ নিজ ভার্যগণ ব্যতীত ঐরুপ রমনীগণের সহিত মিলিত হইতেন। নাগরকের মিত্র বলিতে খেলাধুলার সাথী, অর্থ জীবনরক্ষার দ্বারা যে উপকার করিয়াছে, যাহার সমান শীল সমান ব্যসন, সহাধ্যায়ী, তাহার মর্মরহস্য যে জানে সে যাহার মর্মরহস্য জানে, ধাত্রীর সন্তান এবং একত্র সম্বর্ধিত ব্যক্তিকে বুঝায়। এইরূপ ব্যক্তির সহিত সে প্রনয়িনীর সহিত মিলিত হইবে। সে মিত্রতা বংশানুক্রমিকভাবে চলিয়া আসিয়াছে, যাহা স্বার্থপরতা, লোভ, দীর্ঘ সময়ের ব্যবধান, পরস্পরের গৃপ্তকথা প্রকাশ ইত্যাদির দ্বারা ক্ষুন্ন হয় নাই, তাহাই মিত্রসম্পৎ বা উৎকৃষ্ট মিত্রতা। দৈনিক ক্রীড়াদি আমোদ প্রমোদ ব্যতীত অনেকগুলি বিশেষ দিনে তিথিতে নাগরক বন্ধুবান্ধব আত্নীয়স্বজনের সহিত মিলিত হইয়া উৎসব করিবেন। বাৎসায়ন সমান সামাজিক স্তরের ব্যক্তিগিদের সহিত এইসব উৎসবে যোগ দিতে উপদেশ দিয়াছেন। এই উৎসবগুলিকে বাৎসায়নর পাচটি শ্রেনীতে ভাগ করিয়াছেন। ) ঘটানিবন্ধন বা সমাজ, ) গোষ্ঠী, ) আপানক, ) উদ্যানযাত্রা এবং ) সমস্যাক্রীড়া।

) ঘটানিবন্ধন-দেবতার উৎসবের দিনে নাগরিকদিগের সম্মেলন। প্রতিপৎ প্রভৃতি পঞ্চদশ তিথি, চতুর্থী গণেশের, পঞ্চমী সরস্বতীর, অষ্টমী শিবের তিথি। নির্দিষ্ট তিথিতে নাগরক সভ্যগণ সরস্বতীর মন্দিরে উপস্থিত হইয়া উৎসব করিবেন। মন্দিরে নিযুক্তনটগণ সঙ্গীত নৃত্য দ্বারা উপস্থিত সভ্যদিগের মনোরঞ্জন করিবেন। উভয়পক্ষের তিথিতে যদি উৎসব থাকে তবে পক্ষ মধ্যেই ঘটানিবন্ধন হইবে। আর কেবল শুক্রপক্ষেই যদি তাহার ব্যবাহার থাকে, তবে মাসে একবার ঘটানিবন্ধন হইবে। প্রতি দেবতার জন্যই যে প্রতিদিন উৎসব হইবে তাহা নহে, যে প্রদেশে যে দেবতার উৎসব প্রচলিত, সেই দেশে সেই উৎসব হইবে তাহা নহে, যে প্রদেশে যে দেবতার উৎসব প্রচলিত, সেইদেশে সেই উৎসবে ঘটানিবন্ধন হইবে। অন্যস্থান হইতে আগত কুশীলবগণ ইহাদিগকে আনাদিগের নৃত্যগীতনৈপুন্য প্রদর্শন করিবে। উৎসবের পরদিন কুশীলবদিগকে চুক্তিমতো পুরষ্কার দেওয়া হইত এবং হয়ত তাহাদিগকে বিদায় দেওয়া হইত কিংবা দর্শকদিগের ভাল লাগিলে অনুষ্ঠানের পুনরাবৃত্তি করান হইত। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে যখন খুব ঘটা করিয়া উৎসবের ব্যবস্থা হইত, তখন কুশীলবদিগের বিভিন্ন দল একত্র বা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করিয়া নৃত্যগীতাদি করিত। নাগরক যে গণের অন্তর্ভুক্ত সেই গণের সভ্যদিগের কর্তব্য সমাগত বৈদেশিকগণকে আপ্যায়ন করা। দেশাচার অনুসারে বিভিন্ন দেবতার পূজায় এইরূপ সমাজ অনুষ্ঠিত হইত।

) নাগরকের সমান বিদ্যা, বুদ্ধি, চরিত্র, অর্থ বয়সের বন্ধুগণের কোন একজনের বাটীতে বা কোন বেশ্যার আলয়ে গোষ্ঠী বা আড্ডা বসিত। সেখানে দাবা, পাশাখেলা, কাব্যসমস্যা কলাসম্যা হইত। যথা মুখে মুখে শ্লোক রচনা, একটি শ্লোকের পাদপুরণ, শুদ্ধ উচ্চারণ সুরে পুস্তক পাঠের প্রতিযোগিতা ইত্যাদি হইত। সাহিত্যের প্রতিযোগিতা ছাড়া গান-বাজনার প্রতিযোগিতা বা কোন শিল্পকলার প্রতিযোগিতাও হইত। বাৎসায়নের উল্লিখিত এই গোষ্ঠী বৈদিকযুগের সভা বা সমিতিরই পরবর্তী রূপ। পাঞ্চালদিগের এইরূপ একটি সমিতিতে ব্রাক্ষ্মণ শ্বেতকেতু সমিতিরই পরবর্তী রূপ। পাঞ্চালদিগের এইরূপ একটি সমিতিতে ব্রাক্ষ্মন শ্বেতকেতু ক্ষত্রিয়প্রবাহন জৈবালির নিকট পরাজিত হইয়াছিলেন। এইরূপ গোষ্ঠীতে চতুঃষষ্টি পাঞ্চালকলা বা কামকলায় শিক্ষিত কোন ব্যক্তি সভার অন্যান্য সভ্যদিগকে শিক্ষা দিতেন।

) নাগরকগণ পরস্পরের বাড়িতে আপানক বাসুরাপানের আড্ডা করিতেন।

) ইহা ছাড়া নাগরকগণ নগরের নিকটস্থ কোন উদ্যানে পিকনিক বা চড়ুইভাতি করিতেন। পূর্বাহ্নে সাজগোজ করিয়া আম্বারোহনে বেশ্যাদিগকে পরিচারকদিগকে লইয়া কোন উদ্যানে যাওয়া হইত। সেখানে তিত্তির, কুক্কুট মেষদিগের যুদ্ধ অন্যান্য ক্রীড়া প্রদর্শিত হইত। সমস্ত দিন উদ্যানবিহার করিয়া উদ্যানস্থ জলাশয়ে জলক্রীড়া করিয়া বাগান হইতে শাকশব্জী ফলফুল প্রভৃতি লইয়া অপরাহ্নে গৃহে ফিরিতেন।

) আমরা একবার সমস্যাক্রীড়ার কথা বলিব। সমস্যাক্রীড়া বা সবূয়ক্রীড়া ইহা জাতীয় উৎসব। বিভিন্ন দেশে বা প্রদেশে ইহার বৈসাদৃশ্য লক্ষিত হয়। ইহার মধ্যে কতক এযুগে পর্যন্ত চলিয়া আসিয়াছে, যথা যক্ষরাত্রি অর্থাৎ দীপাম্বিতা বা দেয়ালি, কৌমুদীজাগর অর্থাৎ কোজাগরী পূর্নিমা এবং সুবসন্তক অর্থাৎ দীপান্বিতা বা দেয়ালি, কৌমুদীজাগর এবং কোজাগরী পূণিমা এবং সুবসন্তক অর্থাৎ মাঘী পঞ্চমী। এই তিনটিকে মাহিযানী ক্রীড়া বলিত। ইহা সর্বাসাধারণের উৎসব। ইহা ব্যাতীত ব্যাৎসায়ন আরো সতেরোটি ক্রীড়ার উল্লেখ করিয়াছেন। তাহার অনেকগুলি আজও ভারতের গ্রামে প্রচলিত আছে। যথা পুতুলখেলা, রান্নাবান্না করা, কড়িখেলা, ঘুটিংখেলা, জোড়-বিজোড় খেলা, লুকোচুরি খেলা ইত্যাদি। পুরুষ দিগের ক্রীড়ার মধ্যে মল্লক্রীড়া বা কুস্তির উল্লেখ বাৎসায়ন করিয়াছেন, তবে সৌখীন নাগরক নিজে ক্রীড়ায় যোগ না দিয়ে সম্ভবত দর্শক হইতেই ভালবাসিতেন। মৃগয়া একটি ব্যসন ছিল, বাৎসায়ন তাহারও উল্লেখ করিয়াছেন। সাধারণতঃ সে যুগে দরিদ্র বা মধ্যবিত্ত ব্যক্তি একটি বিবাহ করিত। অবস্থাপন্ন ব্যবসায়ী নৃপতি, বহুসম্পত্তির মালিক একাধিক বিবাহ করিতেন। বাৎস্যায়ন নাগরকের পত্নীর জীবনযাত্রার যে চিত্র দিয়াছেন তাহা নাগরকের বিলাসোচ্ছ্বল জীবনের বিপরীত। ধর্মশাস্ত্র সমূহে সাধ্বী স্ত্রীর যে চিত্র আমরা পাই, বাৎস্যায়নের কামসূত্রে তাহা হইতে কোন ব্যতিক্রম দেখিতে পাই না। বরং বিশদভাবে পত্নীর কর্তব্য বিবৃত করিয়াছেন। স্ত্রী পতিকে দেবতার ন্যায় দেখিবে এবং কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলাম নাটকে শকুন্তলার পতিগৃহযাত্রাকালে কম্ব যে উপদেশ দিয়াছিলেন ইহাতে তাহার প্রতিচ্ছবি দেখিতে পাই-

শুশ্রুষস্ব গুরুনকুরু প্রিয়সখীবৃত্তিং সপত্নীজনে
ভর্তুবিপ্রকৃতাপি রোষনতয়া মাস্মপ্রতীপংগমঃ
ভূয়িষ্ঠং ভব দক্ষিণাপরিজনে ভাগ্যেষ্বনুৎসেকিনী
যান্ত্যেবং গৃহিনীপদং যুবতয়ো বামাঃ কুলস্যাধয়ঃ।।

তাহার সমস্ত ব্যবহারের মধ্যে একটা নিয়ন্ত্রণ একটা সংযম দেখিতে পাই। কথাবার্তায় সে সংযত, কখনও উচ্চস্বরে কথা বলে না বা উচ্চহাস্য করে না। শ্বশূর শ্বাশুড়ী তিরষ্কার করিলে প্রত্যত্তর দেয় না। সৌভাগ্যে বড়াই করে না। বেশভূষায় সংযম রক্ষা করে, কোন উৎসবে যোগদান করিলে অল্প অলঙ্কার পরিধান করে, অল্প কয়েকটিসূক্ষ্ম এবং কোমল বসন জামা পরিধান করে। অল্পমাত্রায় গন্ধ দ্রব্যাদি প্রসাধন সামগ্রী ব্যবহার করে শ্বেতবর্ণের পুষ্পে সুসজ্জিত হয়। কিন্তু যখন স্বামীর সহিত মিলিত হইতে যায় তখন সযতনে প্রসাধন করে, পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হইয়া বহুঅলঙ্কার পরিয়া নানাবর্ণের পুষ্পে দেহ অলঙ্কৃত করিয়া নিজেকে সকল প্রকারের চিত্তাকর্ষক করিতে চেষ্টা করে। বাৎস্যায়ন বলিয়াছেন, পতির নিকট একলা যাইলেও কখনও অলঙ্কার না করিয়া যাইবে না। স্বামী প্রবাসে থাকিলে স্ত্রী সকল অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিবে, কেবল যেগুলি আয়তিত্ব চিহ্ন স্বরূপ রাখা আবশ্যক তাহাই রাখিবে। কোন আবশ্যকীয় কার্যে বা বিপদের সময় ব্যতীত আত্নীয়স্বজনের গৃহে যাইবে না এবং কোন উৎসবে যোগ দিলেও প্রবাসবেশ ত্যাগ করিবে না এবং স্বামীর আত্নীয়দিগের সহিত যাইবে অধিককাল সেখানে থাকিবে না। স্বামী প্রবাস হইতে প্রত্যাগমন করিলে সে যে বেশে ছিল সেই বেশেই তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। তাহার পর দেবতাদিগের অর্চনা করিবে বিশেষতঃ কামদেবের। বাড়ির গৃতিনীই গৃহদেবতার দৈনিক পূজার তত্ত্বাবধান করিবে এবং ত্রিসন্ধ্যায় আহ্নিক দান যথাবিহিত ভাবে পালিত হইতেছে কি না দেখিবে। তাহার স্বামীর অংশে যে সকল ব্রত উৎসবাদি পালনের ভার পড়িবে সে তৎসমুদয় পালন করিবে। স্বামী কোন কার্যে কৃতকার্য হইবার বা কোন রোগ হইতে মুক্ত হইবার উদ্দেশ্যে মানক করিলে সে তাহা পালন করিবে। স্বামীর অনুমতি লইয়া স্ত্রী স্বয়ং সমস্ত পরিবারের যত্ন ব্যবস্থাপনার ভার লইবে। সমস্ত বৎসরের আনুমানিক আয়-ব্যায়ের হিসাব প্রস্তুত করিবে এবং বাৎসরিক আয়ের অনুপাতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করিবে। কিরূপে দৈনিক হিসাব রাখিতে হয় তাহা শিক্ষা করিবে দৈনিক আয় ব্যয় যোগ দিয়া রাখিবে। স্বামী যদি অবস্থার অতিরিক্ত ব্যয় করেন বা অন্যায় খরচ করেন, স্ত্রী গোপনে তাহাকে স্পষ্ট করিয়া দেখাইয়া প্রতিবাদ করিবে। সে খরচের জন্য অবশ্যকীয় সকল দ্রব্য মজুত রাখিবে এবং উপযুক্ত সময়ে তাহা পুনরায় পূর্ণ করিবে। সে দাসদাসীর বেতন হিসাব করিয়া তাহাদিগকে দিবে। চাষবাস পরিদর্শন গবাদিপশু তিত্তিরাদি পালিত ক্রীড়া পক্ষীসমূহের পরিচর্যা করিবে। স্বামীর অনুপস্থিতিকালে তাহার কর্তব্যকার্য পরিদর্শন করিবে সযত্নে যাহাতে সে সকল নির্বাহিত হয়, সে বিষয়ে লক্ষ্য রাখিবে। এই সব সময়ে সে যথাসাধ্য ব্যয় কমাইয়া বিন্বস্ত দাস-দাসীর সাহায্যে ক্রয়-বিক্রয় দ্বারা সংসারের আয় বৃদ্ধির চেষ্টা করিবে। রন্ধনশালার তত্ত্বাবধান করিবে এবং সুতা কাটিয়া বা বয়ন করিয়া অবসর বিনোদন করিবে। বহুদরিদ্র রমনী সুতা কাটিয়া তাত বুনিয়া গ্রাসাচ্ছাদন উপার্জন করিত। গ্রামে কৃষক রমনীগণ আযুক্তক নামক রাজকর্মচারীর অধীনে অনেকপ্রকার কার্য করিত- শষ্যক্ষেতে কাজ করিত। এই সকল কার্য তাহারা কেবলমাত্র আহার্যের বিনিময়ে করিত। সেইরূপ ব্রজাঙ্গনাগণ গবাধ্যক্ষের গোপালনের অনেক কার্য পেট ভাতায় করিয়া দিও। গৃহস্থগণের অনেকে একাধিক বিবাহ করিতেন। এই সকল বিবাহ স্ত্রীর জড়তা, দুঃশীলতা, দৌভার্গ্য, বন্ধ্যাত্ব, নিরন্তর কন্যা প্রসব বা স্বামীর চপলতার জন্য ঘটিত। সুতরাং ভক্তি, সুশীলতা বিচক্ষণতা দেখাইয়া পতির অপর পত্নী গ্রহণ যাহাতে না হয় তাহাই স্ত্রীর কর্তব্য। তবে বন্ধ্যান্ত্বেরদোষে সন্তান উৎপত্তি না হইলে, নিজেই স্বামীকে বিবাহ করিতে প্রবৃত্তি দেওয়া উচিত। বাৎস্যায়ন সপত্নীগণের সহিত ব্যবহার সম্বন্ধে বহুউপদেশ দিয়াছেন। তাহা ছাড়্য বহুপত্নীক ব্যক্তিকে কোন পত্নীর প্রতি পক্ষপাতিত্ত্ব করিতে নিষেধ করিয়াছেন এবং কোন স্ত্রীর প্রতি অনাদর বা অবহেলা করিতেও নিষেধ করিয়াছেন। তাহা বলিয়া কোন স্ত্রীর অপরাধও স্বামী না দেখিয়া যেন উপক্ষো না করেন। আমরা পূর্বে বলিয়াছি প্রত্যেক নাগরকের একটা অন্তঃপুর থাকিত। সেখানে পরিবারের স্ত্রীগণ থাকিতেন, তথায় কোন বাহিরের লোক অনুমতি ভিন্ন প্রবেশ করিতে পারিত না। নৃপতিদিগের অন্তঃপুর রক্ষিদিগের দ্বারা সুরক্ষিত থাকিত। অন্তঃপুর বাসিনী রমনীগণ অনুমতিভিন্ন বা কোন উৎসবাদি উপলক্ষে ব্যতীত বাহিরে আসিতে পারিতেন না। কিন্তু সেকালে সকল পুরুষই যে সৎ বা সকল নারীই যে সতী ছিল তাহা মনে করিবার কোন হেতু নাই। গোপনে নায়ক নায়িকা পরস্পরের সহিত নানা উপায়ে মিলিত হইত বাৎস্যায়ন তাহার বিশদ বিবরণ দিয়াছেন। আমরা যে পূর্বে নাগরিকগণের গৃহিনীদিগের হিসাবপত্র রাখার কথা বলিয়াছি, তাহা হইতে অনুমান করা যাইতে পারে সে যুগে স্ত্রীশিক্ষা প্রচলিত ছিল। বাৎস্যায়ন যাহা বলিয়াছেন তাহা হইতে জানা যায়, যে কোন সাধারণ অন্তঃপুরবাসিনী রমনী পত্রহারী দূতীর মারফৎ পুষ্পের মাল্য অলঙ্কারাদির ভিতর লুকাইয়া প্রনয়ীর সহিত প্রেমপত্র আদান-প্রদান করিত। সেইসব পত্র প্রনয়ীকে উল্লেখ করিয়া কবিতা বা গানেও লেখ্য হইত এবং সেইরূপে প্রণয়ীও প্রণয়িনীকে পত্র লিখিত চতুঃষষ্টি কলার মধ্যে মানসী কাব্যক্রিয়া কাব্য সমস্যাপূরণমের উল্লেখ এবং প্রতিমালা নামক ক্রীড়ার উল্লেখ হইতে বুঝা যায় র্সবশ্রেণীর রমণীই মোটামুটি শিক্ষালাভ করিত। যে যুগে বিধবা বিবাহ প্রথা প্রচলিত ছিল। কোন বিধবা রমনী স্বামীর মৃত্যুরপর দ্বিতীয়বার কোন পুরুষকে বিবাহ করিতে যদি ইচ্ছা করিত, তাহা হইলে সে তাহার মনোমত ব্যক্তির সহিত পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হইতে পারিত। সেই পুনবির্বাহিতা বিধবাকে পুনর্ভু বলা হইত। সে সাধারণ বিবাহিতা পত্নী অপেক্ষা অধিকতর স্বাধীনতা উপভোগ করিত। এই বিবাহ বন্ধন সাধারণ বিবাহের ন্যায় সৃদৃঢ় নহে বলিয়া সে কতকটা নায়কের প্রণয়িনীর ন্যাস বাস করিত, তাহার পত্নীগণের উপর মুরুব্বিয়ানা করিত, দাসদাসীদিগের প্রতি দয়া দেখাইত, স্বামীর বন্ধুদিগের সহিত ঘনিষ্ঠভাবে আলাপ করিত, স্বামী যদি কোন অন্যায় কার্য করিত তাহা হইলে তাহাকে তিরষ্কার করিতে দ্বিধা বোধ করিত না। সে অন্য বিবাহিতা পত্নীদিগের অপেক্ষা কলায় অধিকতর অভিজ্ঞতা দেখাইত এবং স্বামীকে চতুঃষষ্টি কামকলায় আনন্দদান করিতে চেষ্টা করিত। উৎসবে, ক্রীড়াদিতে, আপনাকে, উদ্যান-যাত্রায় এবং অন্যান্য সমস্যাক্রীড়ায় যোগদান করিত। সে নায়ককে ত্যাগ করিতে পারিত, কিন্তু যদি স্বেচ্ছায় তাহাকে ত্যাগ করিত, তাহা হইলে নায়কের প্রদত্ত সমস্ত উপহার তাহাকে প্রত্যপন করিতে হইত। তবে পরস্পরকে প্রণয়ের অভিজ্ঞানরূপে প্রদত্ত উপহার প্রত্যর্পন করিতে হইত না। রাজঅন্তঃপুরে পুনবূর স্থান দেবী, অর্থাৎ রাজমহিষী গণের পরে এবং গণিকা নটীগণের উপরে। রাজঅন্তুপুর মহিষী, পুনর্ভু, গণিকা নটীগণের পৃথক পৃথক বাসস্থান থাকিত। অনেক রমনী পুরুষদিগের ন্যায় সন্নাসব্রহ গ্রহণ করিত। এইরূপে বৌদ্ধ সন্নাসিনীকে বলা হইত শ্রমন্য, জৈন সন্নাসিনীকে ক্ষপনিকা এবং ব্রাক্ষ্মন্য ধর্মের সন্ন্যাসিনীকে ত্যুপসী। ইহা ব্যাতীত মুন্ডিতশীর্ষা মুন্ডা রমনীদিগের উল্লেখ কামসূত্রে আছে। এই সকল সন্ন্যাসিনীগণকে প্রব্রজিতা বা ভিক্ষুকী বলা হইত। এই সকল ভিক্ষুকী প্রণয়ব্যাপারে দূতীর কার্য করিত। সেইজন্য সাধারণত সন্নাসিনীগণ যে সম্মান পাইতেন, এই সকল দূতীগণ তাহা হইতে বঞ্চিত হইত। কামসূত্রে আমরা বৈশিক জীবনের একটা মোটামুটি চিত্র পাই। তাহার পূর্বে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজকার্যে নিয়োজিত গণিকাগণের বৃত্তি জীবনযাত্রার এক‍টা চিত্র গণিকাধ্যক্ষ নামক প্রকরণে দেখিতে পাই। ভারতের নাট্যশাস্ত্রে লিখিত আছে যে নারী বিভিন্ন কলার কাল ব্যবহারোপযোগী প্রয়োগ জানে, যে বিবিধ শাস্ত্র কাব্যাদিতে ব্যুৎপন্না, চতুঃষষ্টি কলানিপূন্য, বিশেষত নৃত্যগীত বাদ্যাদিতে উৎকর্ষলাভ করিয়াছে, গুরুজনের প্রতি শ্রদ্ধাশীলঅ, লাবন্য হাবা দিযুক্তা, যাহার মনের বল আছে, উদ্দেশ্যের দৃঢ়তা আছে অথচ নম্রতা মাধুর্যশালিনী, সাধারণ রমনীগনের যে সকল দোষ থাকে তাহা হইতে যে মুক্তা, বক্রোক্তিতে নিপুনা, ভাষার যাহার জড়তা নাই এবং যে সহজে ক্লান্ত না হইয়া মাধুর্যের সহিত কার্য করে তাহাকে গণিকা বলে। (ভরত নাট্টশাস্ত্রম্ ৩৫-৬০-৬২) বাৎসাযন বলিয়াছেন-চতুঃষষ্টিকলায় উৎকর্ষলাভ করিয়া শীল, রূপ গুনাম্বিতা বেশ্যা গণিকা এই সংজ্ঞা লাভ করিয়া থাকে এবং গুনগ্রাহি গণের সমাজে স্থান লাভ করে। রাজা সর্বদা তাহাকে সম্মান করেন, গুনবান ব্যক্তিগণ তাহার স্তুতিবাদ করেন এবং সে সকলের প্রার্থনীয়া, অভিগম্যা লক্ষীভুতা হইয়া থাকে। (কাঃ সূঃ //২০-২১) বারাঙ্গনাগণকে বাৎস্যায়ন ছয়ভাগে ভাগ করিয়াছেন, যথা ) পরিচারিকা, ) কুলটা, ) স্বেরিনী, ) নটী, ) শিল্পকারিকা, ) প্রকাশবিনষ্টা।

) গণিকাদৃহিতার বিবাহ হইলে এক বৎসর তাহাকে সতী থাকিতে হয়- তাহার পর তাহার যেমন ইচ্ছা সেইমত করিতে পারে, কিন্তু একবৎসর পরেও পানিগ্রহীতার আহবানে তাহাকে সেই রাত্রিতে অন্য লাভ ত্যাগ করিয়া পাতর নিকট থাকিতে হয়। এইরূপ পরিচর্যা করিতে হয় বলিয়া বিবাহিতা বেশ্যবৃত্তিরতা বারাঙ্গনা দৃহিতার নাম পরিচারিকা।

) যে নারী পতির ভয়ে গৃহান্তরে গিয়া প্রচ্ছন্নভাবে অন্যের সহিত সংপ্রযূক্ত হয়, তাহাকে কুলটা বলে। কুলটা লক্ষণ, যথা-অনেক পুরুষৈঃ সার্ধসত্যন্তসুরতস্য যস্যাচিত্তে সদা বাঞ্ছাকুলটানায়িকাতুসা। অর্থাৎ যে নারীর অন্তরে অনেক পুরুষের সহিত এবং অত্যন্ত সুরতের সদাবাঞ্ছা অথচ যে আপন গোপন রতি পতিকে জানিতে দিতে চাহে না, তাহাকে কুলটা বলে।

) যে নারী পতিকে গ্রাহ্য না করিয়া তাহাকে তিরষ্কার করিয়া স্বগৃহে বা অন্য গৃহে গিয়া অপরের সহিত সুরতে লিপ্ত হয়, তাহাকে স্বৈরিনী বলে। সন্তানবতী বা সন্তানহিনা যে নারী পতি বিদ্যমান কামবশে অন্য পুরুষের সংসর্গ করে সে প্রথমা স্বৈরিনী। যে স্বামীর মৃত্যু হইলে দেবরাদিকে পাইয়াও তাহাদিগকে ত্যাগ করিয়া কামবশে অপর পুরুষের সংসর্গ করে, তাহাকে দ্বিতীয়া স্বৈরিনী বলে। যে নারী ক্ষুৎপিপাসাতুরা হইয়া বিদেশী ব্যক্তি হইতে অর্থলাভ করিয়া আমি তোমারই এই বলিয়া তাহার সহিত উপগাত হয়, সে তৃতীয়া স্বৈরিনী। যে উৎপন্নসাহসা নারী দেশধর্মাদি অপেক্ষা না করিয়া অন্যকে দেহদান করে এবং গুরুজন যাহাকে বাধা না দিয়ে সম্মতিদান করে, সে চতুর্থা স্বৈরিনী।

) নটপত্নী বা যে নারী নৃত্য-গীতাদি অভিনয়াদি করিয়া জীবিকা-নির্বাহ করে, তাহাকে নটী বলে। ইহারা শিল্পজীবিনী হইলেও বেশ্যাবৃত্তি করে।

) রজক, তন্তুরায় প্রভৃতি শিল্পীর ভার্যা অথবা যে নারী শিল্পকলা দ্বারা জীবিকা উপার্জন করে তাহাকে শিল্পকারিকা বলে। ইহারা পতির অনুমতি অনুসারে অর্থশালী কামীর অভিগমন করিয়া দরিদ্র সংসারে স্বাচ্ছল্য বিধান করে।

) যে নারী পতির জীবন্দশায় অথবা বৈধবাকালে প্রকাশ্যে কামাচার করিয়া থাকে এবং আত্নীয় বন্ধুগণ যাহাকে নির্ধারিত করিতে পারে না, তাহাকে প্রকাশ বিনষ্টা বা নষ্টা স্ত্রী বলে।

এই সকল নারী রূপজীবা শ্রেণীর অন্তর্গত, অর্থাৎ আপনার রূপ যৌবনের দ্বারা জীবিকা উপার্জন করে। গণিকার ন্যায় কলাদিতে উৎকর্ষ বা শীল গুণ নাই। ইহারা সর্বাঙ্গে অলঙ্কার পরিধান করিতে, বাসার্থ অট্টালিকা নির্মান করিতে, বহুমূল্য আসবাবপত্র তৈজসাদি ক্রয় করিতে এবং পরিচারিকাদির দ্বারা গৃহাদি পরিচ্ছন্ন রাখিতে পারিলে লাভ্যতিশয় বলিয়া মনে করে। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হইতে আমরা গণিকাগণের জীবনযাত্রার একটা মোটামুটি বিবরণ পাই। মৌর্যযুগ বা তাহার বহুপূর্ব হইতে গণিকাগণ রাষ্ট্রের একটি প্রয়োজনীয় অংশ বলিয়া বিবেচিত হইত এবং তাহারা রাজা কর্তৃক নিযুক্ত হইরা রাষ্ট্রের সম্পত্তি বলিয়া গণ্য হইত। তাহাদের রক্ষা, শিক্ষা প্রতিপালনের ভার রাজার উপরেই থাকিত। ) আভ্যন্তরিকা, ) নাটকীয়া। আভ্যন্তরিকা বেশ্যাদিগের পৃথক অন্তঃপুর থাকিত তাহারা পুরুষান্তরের নয়নপথের অন্তরালে অবস্থিতি করিত। নাটকীয়া ইহারা অভিনয়াদি নিপুনা এবং সকলের দর্শনাযোগ্যা। ইহাদেরও অন্তঃপুর থাকিত বটে, কিন্তু তাহাআভ্যন্তর বেশ্যাদিগের বহির্ভাগে থাকিত। বেশ্যাদিগের বিবাহ অনুষ্ঠান দুই প্রকার ছিল ) দৈব, ) মানব। কপিথ বৃক্ষ ইত্যাদির সহিত বিবাহকে দৈব বিবাহ বলা হইল এবং গম্য নায়কের সহিত বিবাহকে মানব বিবাহ বলা হইল। গণিকার দুহিতা যৌবনপ্রাপ্ত হইলে তাহার মাতা তাহার রূপ গুনের উপযুক্ত যুবকগণকে নিজ গৃহে নিমন্ত্রণ করিয়া আনিয়া কন্যাকে দেখাইয়া বলিত, যে আমার কন্যাকে এই এই দ্রব্য দিবে, তাহার সহিত আমার কন্যার বিবাহ দিব। তাহার পরে সে কন্যাকে সকল প্রানিপ্রার্থী যুবকগিদের সহিত মিশিতে দিত না। কিন্তু সেই কন্যা গোপনে ধনী নাগরিকদিগের পুত্রগণের সহিত প্রেম করিত। তাহারা প্রত্যেকে মনে করিত কন্যা যখন মাতার নিষেধ সত্ত্বেও গোপনে তাহার সহিত আলাপ করিতেছে, তাহা হইলে সে তাহাকে অত্যন্ত ভালবাসে। তাহার পর যেব্যক্তি মাতার প্রার্থিতমত দ্রব্যাদি দান করিত, গণিকা তাহার সহিত কন্যার বিবাহ দিত। পূর্বে বলিয়াছি যে, এই বিবাহ সংস্কারের পর এক বৎসর বিবাহিতা যুবতীকে তাহার পানিগ্রাহকের পত্নীরূপে, অপরের সহিত না মিশিয়া, বাস করিতে হইত। তাহার পর যে যথেচ্ছ আচরণ করিতে পারিত। কিন্তু এক বৎসরের পরও যখনই সেই পানিগ্রাহক তাহাকে আহবান করিত, তখনই লাভ পরিত্যাগ করিয়া তাহাকে তাহার সহিত রাত্রিবাস করিতে হইত। গণিকাগণ কামীদিগের সহিত কিছুদিনের জন্য তাহার রক্ষিতা হইয়া থাকিবার জন্য চুক্তি করিত। এই চুক্তিকে কলত্রপত্র বলা হইত। প্রাচীন আলঙ্কারিক রুদ্রভট্ট বলিয়াছেন- অনেকে বলেন, সামান্য বণিতা বেশ্যা অর্থই তাহার একমাত্র কাম্য, নিগুণে তাহার বিদ্বেষ নাই, গুনী ব্যক্তির প্রতিও তাহার অনুরাগ নাই, ইহাই তাহাদের অনুরাগিতার কথা শৃঙ্গাররসের বিষয়ীভূত করিয়া বর্ণনা করা হয় কেন? তাহা হইলে তাহাদিগের ব্যাপার শৃঙ্গার না হইয়া শৃঙ্গরাভাস হইবে। সুতরাং তাহাদেরও রাগ বলিয়া কিছু আছে, কিন্তু সাধারণতঃ তাহারা ধনার্জনের জন্য কৃত্রিম ভাবদ্বারা গ্র্যম্যলোককে মোহিত করে। যে সকল ব্যক্তি সুখপ্রাপ্তধন, মুর্খ, পিতৃবিত্তে গর্বিত, অথচ কাম ব্যাপারে নপুংসকোপম, প্রথমেই তাহাদের স্বরূপ বুঝিয়া তাহারা তাহাদিগের ধন আকর্ষন করিয়া পরে তাহাদিগকে ত্যাগ করে এবং তাহাদের সন্তাপের কারণ হয়। কিন্তু কলাকেলি কুশলা এই বেশ্যাদিগের যদি কাম জাগরিত হয়, তাহা হইলে তাহারা পরস্ত্রীর প্রেমকেও বিস্মৃত করিয়া দেয়। এই বলিয়া রুদ্রভ্ট্ট বেশ্যাদিগের প্রশংসা করিয়াছেন-

'ঈর্ষ্যা কুলস্ত্রীষুন নায়কস্য নিঃশঙ্ককেলিন পরাঙ্গনাসু।
বেশ্যাসু চেতদ্বিতয়ং প্রসিদ্ধং সর্বস্বমেতাস্তদহো স্মরস্য।।
কুপ্যৎপিনাকি নেত্রাপ্নিজ্বালা ভস্মীভুতং পুরা।
উর্জ্জীবিতঃ পুনঃ কামো মন্যে বেশ্যা বিলোকিতৈঃ।।
আনন্দরতিষূক্ত্যা তা সেবিতাঘ্নন্তিচান্যথা।
দুর্বিজ্ঞেয়া প্রকৃত্যৈব তস্মাদবেস্যা বিষোপমাঃ।।'

অর্থা‍ৎ কুলস্ত্রীর রতিতে নায়কের ঈর্ষ্যা নাই, কারণ সেই তো তাহার একমাত্র অধিকারী এবং পরাঙ্গনার সহিত কেলিতে নিঃশংকতা নাই, কিন্তু এই দুইই বেশ্যার সহিত রতিতে বর্তমান। সুতরাং তাহারই স্মরের সর্বস্ব। ক্রদ্ধ পিনাকীর নেত্রাপ্নির জ্বালায় পুরাকালে যে কাম ভস্মীভূত হইয়াছিল, তাহা বোধহয় এক্ষনে বেশ্যার কটাক্ষে উজ্জীবিত হইয়া উঠিয়াছে। বেশ্যাগণের মিলনে আনন্দলাভ হয়, আবার বহু সেবনে মৃত্যু হয়। ইহার প্রকৃতি দুর্বিজ্ঞেয় সুতরাং বেশ্যাকে বেয়ের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে, অর্থাৎ বিষ সামান্যমাত্রায় রোগোপহারক কিন্তু মাত্রা বাড়ালেই মৃত্যুদায়ক। অভিমানিকী প্রীতি বেশ্যার বৃত্তি-অনুরূপ না হইলেও বেশ্যাগণ সকল অনূভূতি হীনা নহে। তাহাদেরও প্রাণ আছে, তাহারও অনুরাগিনী হয়। দামোদরগুপ্ত তাঁহার কুট্টিনীমতে বেশ্যাব চাতুরী ধন লুব্ধতার কথা বর্ণনা করিলেও হারলতা উপাখ্যানে গণিকার প্রেমের গভীরত্বের প্রমাণ দিয়াছেন। কাব্যে বেশ্যাপ্রেমের নিদর্শন তো আছেই, বাস্তবেও তাহার অভাব নাই।

যে যুগে স্ত্রী-পুরুষ উভয়েই অলঙ্কার ব্যবহার করিতেন সেই সময়ে স্বর্ণকার বা সুবর্ণিক মণিকারগণ যথেষ্ট অর্থ উপার্জন করতেন। নাগরকগণ যখন গোষ্ঠীতে বা উদ্যানযাত্রায় যাইতেন তখন অলঙ্কার পরিধান করিতেন। নৃপতিগণও যখন অপরাহ্নে মহিষীদিগের সহিত সাক্ষাৎ করিতেন তখন অলঙ্কারে ভূষিত হইতেন। অলঙ্কার না পরিয়া কুলস্ত্রীগণ স্বামী সন্নিধানে যাইতেন না। বাৎস্যায়ন চতুঃষষ্টি কলার মধ্যে রূপ্যরত্নপরীক্ষা, ধাতুবাদ, মণিরাগাকরজ্ঞান ইত্যাদির উল্লেখ করিয়াছেন। সুবর্ণ, রজত, কাংস, তাম্ম লৌহের তৈজসাদির উল্লেখ করিয়াছেন। তাহা হইতে বুঝা যায় শিল্পীগণ বিভিন্ন ধাতুর অলঙ্কার তৈজসাদি প্রস্তুত করিতেন। কাষ্ঠনির্মিত যে সকল আসবাবের উল্লেখ কামসূত্রে আছে তাহা হইতে বুঝা যায়, সেই সময় দক্ষ সূত্রধরেরও অভাব ছিল না। বসনরঞ্জন করা একটি বিশেষ কলা ছিল। মণিকার সুবর্ণকারের ন্যায় রঞ্জকও নাগরকের অন্তপুরে গিয়া অন্তঃপুরিকগণের নিকট হইতেই তাহাদের কার্যের নির্দেশ লইয়া আসিতেন। মিতব্যায়িনী গৃহিনীগণ স্বামীদিগের পরিত্যক্ত বসনাদি ধুইয়া রং করিয়া দাস-দাসীকে দান করিতেন। নাগরকগণকে মালাকারগণ পুষ্পমাল্য, প্রনয়িনীর জন্য পুষ্পের অলঙ্কার সরবরাহ করিত, সৌগন্ধিকগণ গন্ধদ্রব্য সরবরাহ করিত। রজক, নাপিত, মদ্যবিক্রেতা, তাম্বুলিক প্রভৃতির উল্লেখ হইতে বুঝিতে পারি, সে যুগের নাগরিকগণ অত্যন্ত সৌখীন জীবন যাপন করিতেন। বাৎস্যাযনের বর্ণিত নাগরক হইতেছেন সম্পন্ন গৃহস্থ। দরিদ্র শিল্প জীবী, কৃষক ভিক্ষাজীবী লোকেরও তখন অভাব ছিল না। তবে মোটমুটি সকলেই ধার্মিকভাবে জীবন যাপনের চেষ্টা করিত। সমস্ত কামসূত্রে কামের কথা বেশি থাকিলেও ধর্ম অর্থ কামের মধ্যে একটা সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা বাৎস্যায়ন করিয়াছেন। পারদারিকাধিকরণে বাৎস্যায়ন বলিয়াছেন, ধর্মর্থয়োশ্চ বৈলোখ্যান্নচরেং পার দারিকম্ অর্থাৎ ধর্মের প্রতিকুল আচরণ এবং অর্থ ক্ষতিকর পারদারিক কর্ম, অর্থাৎ পরস্ত্রী গ্রহণ কদাচ করিবে না। আরও বলিয়াছেন, এই পারদারিক প্রকরণ মনুষ্যগণের মঙ্গলার্থ আরব্ধ হইয়াছে। প্রজাগণের দুষনার্থ এই বিধানকে গ্রহণ করিবে না। এই পারদারিক প্রকরণে বাৎস্যায়ন পরদারাগ্রহণ কি প্রকারে করা যাইতে পারে তাহা বলিয়াছেন এবং সাধারণ অধিকরণে কোন কোন ক্ষেত্রে তাহা করা যাইতে পারে তাহা বলিয়াছেন। সুতরাং দেখা যাইতেছে কামবশে স্ত্রী-পুরুষ পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হইয়া যে ব্যভিচার করে তাহা সার্বত্রিক সর্বসাময়িক। বিবাহ যে ভাবে হউক না কেন, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে দাম্পত্য প্রীতির অভাব হইলে তাহার বিচ্ছেধ ঘটে। এই প্রীতির অভাব নানা কারণে হইয়া থাকে। বিবাহিতা স্ত্রীর ক্ষেত্রে সংসারে অর্থাভাব, সপত্নী বিদ্বেষ, বিলাসিতা, স্বামীর ন্যূনতা, অহষ্কার, শিক্ষিতা স্ত্রীর মুর্খ স্বামী, বহুপত্নীক ব্যক্তির স্ত্রীর জ্যেষ্ঠা বহুদেবর যাহার আছে, যাহার স্বামী দীর্ঘকাল প্রবাসে থাকে, সমান অবস্থাপন্ন আত্নীয়া যদি ধিক্কার দেয়, নিত্য জ্ঞাতিগৃহবাস, ঈর্ষালুপতি, যাহার স্বামী নিয়ত ঘুরিয়া বেড়ায়, রূপহীন, অঙ্গহীন, বামন, দুর্গন্ধদেহী, মুখাদি অবয়বে দুর্গন্ধযুক্ত পতি, যাহার স্বামী সুরতে তৃপ্তি দান করিতে অক্ষম, ইত্যাদি কারণে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটে এবং রমনী পরপুরুষ কামনা করে। পুরুষের ক্ষেত্রেও ঐরূপ নানা কারণে স্ত্রী যদি বিদ্বিষ্টা হয় স্বামীও তাহার প্রতি বিদ্বেষপরায়ন হয়, স্ত্রী যদি সুরতে অনুভুতিহীনা হয়, কুরূপা, অঙ্গহীনা, দুর্গন্ধ দেহা, মুখাদিতে দুর্গন্ধ যুক্তা হয়, ধনী ব্যক্তির কন্যা বলিয়া স্ত্রী যদি স্বামীর প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করে, ইত্যাদি নানা কারণে এবং কোন অপর রমনীর প্রতি আকর্ষনবশত স্ত্রীর প্রতি অনুরাগ কমিয়া যায় তাহা হইলে দাম্পত্য বিচ্ছেদ ঘটে। কি কি কারণে পরদারা গমন করিলে দোষের হয় না তাহা বাৎস্যায়ন বলিয়াছেন। কিন্তু বলিয়াছেন, এই সকল সাহসিক কর্ম কেবল অনুরাগ বশত কর্তব্য নহে, অর্থাৎ কেবল দুষ্প্রবৃত্তিবশে পরস্ত্রী গমন করা উচিত নহে। কামসূত্র হইতে আমরা জানিতে পারি যে সে যুগের নাগরকগণ যথেষ্ট মানসিক কৃষ্টি সৌন্দর্যবোধসম্পন্ন ছিলেন, কিন্তু সেই সঙ্গে আমরা যাহাকে যৌননৈতিক চরিত্র বলি সে সম্বন্ধে বিশেষ কুষ্ঠাযুক্ত ছিলেন না। যে যুগে ভারত পূর্ব পশ্চিম হইতে বাণিজ্যপ্রসূত অর্থসম্ভারে পরিপূর্ণ তাহারা ছিলেন সেই যুগের মানুষ। কামসূত্রে নাগরকের চরিত্রের সৎ অসৎ উভয় দিকই দেখান হইয়াছে। বাৎস্যায়ন বলিয়াছেন, অনেক লোক আছে যাহারা বলে ধর্মাচরণ করিবার প্রয়োজন নাই, কারণ তাহার ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না এবং যজ্ঞাদি সাধিত হইলেও ফল হইবে কি না সে বিষয় যথেষ্ট সন্দেহ আছে। মূর্খ ভিন্ন কোন ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরহস্তে দেয়? আগামীকল্যকার ময়ুরলাভ অপেক্ষা অদ্যকার লাভ মন্দের মধ্যে ভাল। সংশয়সঙ্কুল শত সুবর্ণমুদ্রা লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহে এক কার্যাপণও মন্দের ভাল। বাৎস্যায়ন অবশ্য এই মতের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখাইয়াছেন। বাৎস্যায়ন যে যুগে বাস করিতেন তাহা সম্পূর্ণরূপে একটা দেহাত্মবাদের যুগ, কিংবা সমস্ত ভারতীয় সমাজ সেই সময়ে এইরূপ ছিল, কিংবা নাগরকের অসংযত নৈতিক চরিত্র সকল ভারতবাসীর চরিত্রের একটি প্রধান বিশেষত্ব ছিল ইহা মনে করা সম্পূর্ণ ভুল। প্রথমত বাৎস্যায়ন নগরের অধিবাসীর একটা মুষ্টিমেয় সংখ্যার চিত্র দিয়া তাহার নাগরককে অঙ্কিত করিয়াছেন। নাগরক যৌবনে যথেষ্ট শিক্ষাপ্রাপ্ত ধনীর সন্তান এবং উত্তরাধিকার সূত্রে বা নিজের চেষ্টায় জীবনযাত্রানির্বাহের উপযুক্ততা লাভ করিয়াছেন, যাহাতে তিনি নগরে সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে বাস করিতে পারেন। তিনি যে শ্রেণীর লোক তাহারা সকল দেশে সকল যুগে আর্থিক স্বচ্ছলতাবশে পৃথিবীর যাহা কিছু ভাল তাহা উপভোগ করিয়া থাকেন। বর্তমান যুগে যে দেশে অর্থের প্রাচুর্য আছে, ভোগ্যবস্ক্তর অভাব নেই- যেমন, আমেরিকান, নিউইয়র্ক, শিকাগো, ওয়াশিংটন, লন্ডন, প্যারী, ভিয়েনা, বার্লিন, টোকিও প্রভৃতিনগরের প্রমোদকক্ষে কিছু পরিবর্তনসহ এই নাগরকেরই প্রতিচ্ছবি দেখিতে পাই। আমাদের ভারতে তাহার উত্তরাধিকারীগণ একেবারে নিশ্চিহ্ন হইয়া যান নাই, তবে ভারতের সে প্রাচুর্য আজ নাই। অপরদিকে কামসূত্রে আমরা যে গৃহিনীর চিত্র পাই তাহাতে নিষ্ঠা, পবিত্রতা, নম্রতা সংযমের যে আদর্শ দেখিতে পাই, তাহা হইতে বুঝিতে পারি যৌন পবিত্রতা সম্বন্ধে সমাজের সাধারণ আদর্শগুলি ধর্মসুত্রের যুগ হইতে তখনও অম্লান রহিয়াছে। সামাজিক জীবনের প্রধান ধারা বিশেষ পরিবর্তিত হয় নাই। ধর্মসূত্রে যে আদর্শগুলি বর্ণিত আছে, এখনও সেগুলি সমাজকে শাসন করিতেছে। সমাজের সমস্ত কাঠামোটা বর্ণাশ্রমের ভিত্তির উপরে স্থাপিত ছিল। শিক্ষা শেষ না হইলে কেহ বিবাহ করিত না। বিবাহ করিয়া সে একজন উত্তম নাগরিকের ন্যায় সংসার ধর্ম করিত, বৃদ্ধ হইলে সাংসারিক কর্ম হইতে অবসর লইয়া সম্পূর্ণভাবে আধ্যাত্মিক বিষয়ে মন সংযোগ করিত। চতুবর্গের মধ্যে ব্রাক্ষ্মণকে সকলে অত্যন্ত শ্রদ্ধা করিত, তাঁহার আশীর্বাদে লোকে যশ দীর্ঘজীবন লাভ করিবে এই বিশ্বাস ছিল। বেদ অন্যান্য ধর্মশাস্ত্রকে শ্রদ্ধা করিতে শিক্ষা দেওয়া হইত। শ্রুতি স্মৃতির বাক্যে সন্দেহ করার কোন যুক্তি নাই। তখনও বৈদিক যজ্ঞাদি অনুষ্ঠিত হইত, সকল যজ্ঞে স্ত্রী-পুরুষ সকলেই যোগদান করিতেন। গৃহে ইষ্টদেবতার জন্য মন্দির নির্মাণ গৃহিনীদিগের একটি পুন্যের কাজ ছিল। বিবাহে শ্রোত্রিয়ের গৃহ হইতে আপ্নি আনিয়া সেই অগ্নিসাক্ষী করিয়া বিবাহ হইত। বাৎস্যায়ন জীবনের যে আদর্শ তুলিয়া ধরিয়াছিলেন তাহা ত্রিবর্গের সমন্বয়- যাহা সমস্ত জগতের লোকের ইহজীবনের কর্মের প্রবর্তক। এই ভূমিকায় সংক্ষেপে কামসূত্র সম্বন্ধে আলোচনা করিলাম।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2