১.০৪ জন্ম-রহস্য

জন্ম-রহস্য

জনসাধারণের অজ্ঞতা

মানবজন্ম রহস্য চিরকাল মানব মনকে বিস্ময়ে অভিভূত করিয়া আসিয়াছে। এ সম্পর্কে নানা মতবাদ ও ভুল ধারণার ছড়াছড়ি নানা দেশে ও নানা যুগে চলিয়া আসিতেছে। জন্ম রহস্তোব বিস্তৃত আলোচনা আমরা এই পুস্তকের দ্বিতীষ খণ্ডে করিয়াছি। এখানে মোটামুটি একটা ধারণা মাত্র দেওয়া যাইতেছে। জীবজগতে যৌন-আচরণের মূল উদ্দেশ্যই বংশবিস্তার। সুতরাং ঐ বংশবিস্তারের সঠিক প্রক্রিয়া সম্বন্ধে সর্বপ্রথমেই পাঠক-পাঠিকাকে অবহিত করা উচিত।

বংশবিস্তারের সহজ প্রক্রিয়া

জীবজগতে নানা বিচিত্র উপায়ের জন্ম প্রক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়। প্ৰায় পাঁচ লক্ষাবিক জীবজন্তুর নামের তালিকা ইতিমধ্যেই জীব-বিজ্ঞানীরা করিয়া ফেলিয়াছেন—আরও নূতন নূতন জীবজন্তুর আবিষ্কার হইয়াই চলিয়াছে।

এই সমস্ত বিভিন্ন শ্রেণীর প্রত্যেকেই নিজ নিজ আকৃতি প্ৰকৃতি বিশিষ্ট জন্ম দিয়া চলিয়াছে। যেন বৈচিত্র্যের অবধি নাই।

জীবজন্তুর শরীরের সূক্ষ্মতম অংশের নাম জীবকোষ (Cell)। জীবকোষ এত সূক্ষ্ম হইয়া থাকে যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ব্যতিরেকে উহা দেখা প্ৰায় অসম্ভব। বেশীর ভাগ জীবকোষই এত ক্ষুদ্র যে উহাদের প্রায় ১০০ গুণ বর্ধিত প্ৰতিকৃতি অনুবীক্ষণ যন্ত্রে নজরে পড়ে।

অনুবীক্ষণ যন্ত্রে বর্ধিত প্ৰকৃতির জীবকোষ দেখিতে ততটা কৌতুহলোদ্দীপক নয়। উহা যৎসামান্য নরম পরিষ্কার জেলীর মত দেখা যায়–কখন কখন চারিপাশে খানিকটা বেষ্টনীর মত, কিন্তু সকল ক্ষেত্রেই মধ্যভাগে একটু ঘন বিন্দুর মত দৃষ্টিগোচর হয়। এই মধ্যভাগের ঘন অংশই জীবকোষের মূলকেন্দ্র (Nucleus)

জীবকোষ নানা আকার ও প্ৰকাবেব হইয়া থাকে। ৪নং চিত্রে কয়েক রকমের জীবকোষ দেখুন। মানুষ, হাতী বা বানবের মত জীব ও জন্তুরা দেহ এইরূপ কোটি কোটি জীবকোষের সমষ্টি। অন্যদিকে আবার অসংখ্য জীবাণু শুধুমাত্র একটি জীবকোষ লইয়াই গঠিত। ইহাদিগকে এককোষবিশিষ্ট (Unicellular Organism) জীব বলে। এমিবা (Amoeba) is প্রকারের একটি জীবাণু। ইহা খাওয়া-দাওয়া চলা-ফেরা এবং বংশবিস্তাব সমস্ত শরীরটুকু দিয়াই করে। ইহার বংশবিস্তাবের পদ্ধতি সরল ও বৈচিত্ৰ্য বিহীন। আন্তে আস্তে? সমস্ত দেহটিকে প্ৰসাবণ করিতে করিতে ইহা দ্বিধাবিভক্ত হইয়া দুইটি বিভিন্ন এমিবোয পরিণত হয়। ৫নং চিত্রে এই বিভাগ পদ্ধতি দেখুন। এই পদ্ধতিতে মূল জীবটির মৃত্যু হয় না। উহা সন্তান-সন্ততির মাধ্যমে চির বিরাজমান। কেবল মাত্র যে এককোষবিশিষ্ট জীবের বেলায়ই এই ধরনের বংশবৃদ্ধি হয় তাহা নয়। বহুকোষবিশিষ্ট নানা সামুদ্রিক জীব (Sea anemones) এবং পোকাও (Worms) এইভাবে বংশবিস্তার করে। অপর এক পদ্ধতিতে জীবের দেহের খানিকটা মাত্র নূতন জীবের আকার ধারণ করে। ইহাতে মূল জীব তাহার, স্বাতন্ত্র্য হারায় না—কিন্তু কিছুকাল পরে তাহার মৃত্যু হয়। তাহার দেহাংশ মাত্র নূতন জীবে বিরাজ করে।


আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় এমিবার মত নিম্নস্তরের জীবানুর বংশবৃদ্ধির ব্যাপার যৌন-সম্পর্ক-বিহীন। সুবিধাজনক পরিবেশে তাহাই বটে, তবে কখনও কখনও দেখা যায় যে ক্রমে দ্বিধাবিভক্ত হইয়া বংশবিস্তারের প্রবণতা স্তিমিত হইয়া আসে। তখন দুইটি জীব পাশাপাশি আসিয়া বা একে অপরের সন্নিবিষ্ট হইয়া প্রাণবস্তুর বিনিময় করে। তাহার পরে হইতেই আবার উভয়ে উদ্দীপিত হইয়া বংশবিস্তার করিতে আরম্ভ করে। দুইটি জীবাণুর এইরূপ সংযোগই যৌন সম্পর্কের সূচনা কিনা তাহা বলা কঠিন কিন্তু উচ্চস্তরের জীব জন্তুর মধ্যে যৌন সমাবেশের বৈচিত্ৰ্যময় লীলা দেখা যায়।

পক্ষীর বংশ-বিস্তার প্রণালী

স্ত্রী-পক্ষীর ডিম্বকোষে ডিম সঞ্চিত থাকে। ইহার সঙ্গে সংযুক্ত একটা সরু এবং ক্ষুদ্র নল অন্ত্রের শেষ প্ৰান্তে-যেখানে বাহ্যদ্ধার অবস্থিত তার আতি, সন্নিকটে প্রবিষ্ট হইয়াছে। পক্ষীর বয়োবৃদ্ধিব সঙ্গে সঙ্গে এই ডিম্বগুলিও পূর্ণতা প্ৰাপ্ত হইতে থাকে এবং কালক্রমে অঙ্কুরিত হইবার মত পঙ্ক হইয়া উঠে।

পুরুষ পক্ষীর জীবনে জন্মদানেব শুভ মুহুর্তোব আবির্ভাব নানাভাবে সুচিত হয়, যথা-সুন্দব পালক-সজ্জা এবং সঙ্গীতেব নেশা। স্ত্রী পক্ষীর সঙ্গে মিলিত হুইবার একটা দুৰ্দ্ধমনীষ আকাঙ্ক্ষা তখন পুরুষ পক্ষীর মধ্যে জাগ্রত হইয়া উঠে। যৌবনাগমের একটা জাগ্ৰত চেতনায উদ্ধৃদ্ধ হইয়া পক্ষীকুল তখন যেন মিলন প্রতীক্ষায় উদ্‌গ্ৰীব হইয়া থাকে এবং বাসা নির্মাণে মনোযোগ দেয়। স্ত্রী পক্ষী সেখানে ডিম পাড়ে। এই ডিম কোথা হইতে আসে?

পুরুষ পক্ষীর শুক্রকীটের সংস্পর্শে আসিয়া স্ত্রী পক্ষীর ডিম্ব প্রাণবন্ত এবং অঙ্কুরিত হয়। প্রকৃতি সকল জীবের মধ্যে বংশরক্ষা ও দৈহিক মিনজাত আনন্দলাভের একটা সহজাত সংস্কারের জন্ম দিয়াছে। এই সংস্কারের বশবর্তী হইয়া স্ত্রী ও পুরুষ পক্ষী এমনভাবে মিলিত হয় যে, পুরুষ দেহ-নিঃস্থত শুক্ৰকীট স্ত্রী পক্ষীর ডিম্বের সংস্পর্শে আসিবার সুযোগ পায়।* ফলে যথাসময়ে স্ত্রী পক্ষী ডিম পাড়ে। ক্ৰমাগত উত্তাপ দান করিতে করিতে নিদিষ্ট সময়ে এই ডিম হইতে পক্ষী শাবক ফুটিয়া বাহির হয়।

————-
* সাধারণতঃ পুরুষ পক্ষীর লিঙ্গ থাকে না। পুরুষ ও স্ত্রী পক্ষীর মলদ্বার, মূত্রদ্বার, শুক্রপথ ও যোনিমুখের একই মাত্র ছিদ্র (cloaca) ঘর্ষিত হইলেই শুক্রকীট স্ত্রীদেহে প্রবেশ করে।
————–

মুরগির ডিম ও ছানা

মোরগ ও মুরগী গৃহপালিত পক্ষী। সচরাচর উহাদিগকে দেখিবার সুযোগ আমাদের খুবই ঘটে। মুরগীর ডিম্বাশয়ে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য ডিম অবস্থিত থাকে। এই ডিম্ব ক্ৰমে পরিপক্ক হইয়া ডিম্ববাহী নলের ভিতর দিয়া একটি একটি করিয়া বাহির হইয়া আসে। আঙ্গিক মিলনের ফলে মোরগের শুক্রকীট মুরগীর ডিমগুলিকে প্রাণবন্ত করে। ৬নং ছবিতে ডিম্বের ক্ৰম-পক্কতা ও একটির পর একটির বড় হইয়া বাহির হইয়া আসিবার দৃশ্য দেখানো হইয়াছে।


মুরগীর ডিমের খোসা প্ৰথমে নরম থাকে। বাহিরের আলো বাতাসের সংস্পর্শে আসিলেই উহা কঠিন হইয়া যায়। ডিমের বিশেষত্ব এই যে উহাতে ভবিষ্যৎ ছানার গ্রহণোপযোগী সকল মাল-মসলাই পুরোপুরিভাবে থাকে। পিতা-মাতার সাহায্য ব্যতিরেকেও উহা হইতে মুরগীর ছানা জন্মিতে পারে। ইনকিবেটর (Incubator) যন্ত্রে এক সঙ্গে বহু ডিম্ব নিয়মিত ও পরিমিত ভাবে উত্তাপ দিয়া ফুটানো যায়। ৭নং ছবিতে মুরগীর ডিমের ভিতরকার ক্রম-পরিবর্তন ও ছানার রূপ-পরিগ্রহণ ইত্যাদি দেখানো হইয়াছে। অপরাপর জীবজন্তুর মধ্যে বিভিন্ন প্ৰকাবের জন্মপ্রকরণ চিত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা আমি আমার ‘মাতৃমঙ্গল’ পুস্তকে কারিয়াছি। এখানে দীর্ঘ আলোচনার অবকাশ নাই।

মানব-জন্ম-প্রকরণ

সাধারণ জ্ঞানের দ্বারা সবাই বুঝিতে পারে যে মানবজাতির মধ্যে নারী ও পুরুষের সমবায়ে বংশবৃদ্ধি হয়। মনু নানা জৈবিক পদাৰ্থ মিলাইয়া নর ও নারী স্বজন করিয়া বা খোদা আদম ও হাওয়াকে সৃষ্টি করিয়া উহাদের যৌনসম্পর্কে মানবজাতির বংশবৃদ্ধির ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছেন, এরূপ অলীক কাহিনী আজিও প্রচলিত আছে। জীব-বিজ্ঞানীরা কিন্তু মানবজাতির মধ্যে অপরাপর জীবজন্তুর মত একই পদ্ধতির সন্ধান পান–বিশেষ কোনও সুবিধাজনক বিকল্প ব্যবস্থা খুঁজিয়া পান না। নর ও নারীর যে দুইটি বিশিষ্ট জীবকোষের সংযোগে সন্তানের উৎপত্তি হয় তাহাদের নাম—শুক্রকীট ও ডিম্ব। নারীই সন্তানের আধার এই হিসাবে নারীর অবদানের কথাই আমরা আগে বলিব।

নারীর অবদান

নারীর ডিম্ব শুক্রকীট তুলনায় বহুগুণ বড় হইলেও আকারে উহারা এত ছোট যে উহা নজরেই পড়িবে না। নারীর ঋতুস্রাবের সঙ্গে ডিম্বস্ফোটনের সম্বন্ধ আছে। সাধারণত নারীর ঋতুস্রাবের মধ্যেবর্তী সময়েই ডিম্বস্ফোটন হইয়া থাকে। ঊনবিংশ শতাব্দীর পূর্বে ধারনা ছিল যে, মাসিক স্রাবের পরের ডিম্বস্ফোটন হয় এবং গর্ভধারণের উপযোগী উর্বরকাল আরম্ভ হয়।

এই ডিম্বই সন্তানের প্রথম উপাদান। নারীর ডিম্বের অস্তিত্ব সম্বন্ধে প্রাচীনকালের লোকদের ধারণাই ছিল না। ১৭৫২ খ্রীষ্টাব্দে ভন হেলার (Von Haller) ভেড়ীর উপর পরীক্ষা চালাইয়া এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, ডিম্বকোষ (ovary) হইতে কোনও একটা কিছু জরায়ুতে আগমন করিবার ফলেই তথায় ভ্রূণের সৃষ্টি হয়। ইহার পর ১৮২৮ খ্ৰীষ্টাব্দে ভন বেয়ার (Von Baer) সর্বপ্রথম নারীর ডিম্ব আবিষ্কার করেন।

নারীর ডিম্ব এত ক্ষুদ্র যে তাহা সহজে দৃষ্টি হয় না। ৮নং চিত্রে নারীর ডিম্ব হাস এবং মুরগীর ডিম্বের পরিণত আকারের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কত ক্ষুদ্র তাহা ই তুলনামূলকভাবে দেখানো হইয়াছে।

নারীর ডিম্বের গঠন ও প্ৰতিকৃতি ৯নং চিত্রের সাহায্যে বুঝা যাইবে। মনে রাখিতে হইবে চিত্রটি প্রকৃত আকারের ___ বর্ধিত। ডিম্বের ব্যাস প্রায় এক ইঞ্চির ১২০ ভাগের ১ ভাগ।

নারীর ডিম্ব কোথায় উৎপন্ন হয় এবং কি ভাবে বাহির হইয়া আসে সে সম্বন্ধে ধারণা করিতে হইলে আভ্যন্তরীণ স্ত্রী-জননেন্দ্ৰিয়-সমূহের অবস্থিতির কথা জানিতে হইবে। ২৪নং চিত্রে ইহাদের প্রতিকৃতি দেখুন।


নারীর জরায়ুর (৯নং চিত্র) ঊর্ধ্বাংশে দুই কোণে ফ্যালোপিয়ান নল (Fallopian Tubes) আছে। এতদ্ব্যতীত জরায়ু্র দুই পার্থে প্রশস্ত বন্ধনীদ্বয়ের পশ্চাদ্ভাগে দুইটি ডিম্বকোষ (Ovary) অবস্থিত। এক একটি ডিম্বকোষে শিশুর জন্মের সাহিতই প্ৰায় দুই লক্ষ করিয়া ফলিক্‌ল (Follicle) অর্থাৎ ডিম্ব ও উহার পার্শ্বে একটি বেষ্টনী-কোষ অতি প্ৰাথমিক অবস্থায় থাকে। যৌবন আগমনের সময় ৭৫০০ হইতে ১৮০০০ পর্যন্ত থাকে। ৪৫-৫০ বৎসর বয়সে ঋতু একেবারে বন্ধ (ঋতুসংহার) হইবার পর প্রায় সবগুলিই নষ্ট হইয়া যায়।


সাধারণতঃ প্রতি ২৮ দিনে দক্ষিণ ও বাম ডিম্বকোষের একটি ডিম্ব পরিপুষ্ট হয়। তখন তাহার উপরিস্থিত আবরণ ফাটিয়া যায় এবং ডিম্ববাহী নলের ঝালর সদৃশ মুখ ডিম্বকোষের উপর পতিত হইয়া পরিপুষ্ট ডিম্বটি গ্রহণ করে। (১১নং চিত্র)। ঐ ডিম্বা ডিম্বনলোয় মধ্য দিয়া জরায়ু অভিমুখে চলিতে থাকে। ৯নং চিত্রে একটি ভিন্ন কি কারিয়া বাহির হইয়া আসে তাহা দেখানো হইয়াছে। যদি পথের মধ্যে পুরুষের শুক্রকীট দ্বারা প্ৰাণবন্ত না হয় তবে উহা জরায়ুর ভিতর আসিয়া যোনিপথে বাহির হইয়া যায়। আর যদি তাহা হয় তবে গর্ভাধান (একটি ভ্রূণের জন্ম) হয়। ৯নং চিত্রের ব্যাখ্যা দেখুন। ১০নং চিত্রে শুক্রকীট ডিম্বে প্ৰবিষ্ট হইতেছে (খুব বড় করিয়া) দেখানো হইয়াছে। গর্ভস্থ সন্তান পুরুষ অথবা স্ত্রী হইবে তাহা ও সেই মূহুর্তেই নির্দিষ্ট হইয়া যায়। কারণ পুরুষসৃষ্টি-কারী শুক্রকীট ডিম্বে প্ৰবিষ্ট হইলে পুরুষ জন্মায়, আর স্ত্রী-জন্মদানকারী শুক্রকীট ডিম্বে প্রবিষ্ট হইলে স্ত্রী জন্মায়। পরে আর কোনও প্রকারেই ভ্রূণের লিঙ্গ পরিবর্তিত হয় না। পূর্বে মনে করা হইত যে, এক মাসে একটি ডিম্বকোষ হইতে এবং অপর মাসে অপরটি হইতে পৰ্যায়ক্রমে ডিম্ব বাহির হয়। কিন্তু এখন জানা গিয়াছে যে, এই পর্যায়ক্রমতার কোনও নিশ্চয়তা নাই। কখনও কখনও একই ডিম্বকোষ হইতে কয়েক মাস পৰ্যন্ত ডিম্বস্ফোটন হইতে পারে। আবার নাও হইতে পারে।


পুরুষের অবদান

পুরুষের শুক্ৰকীট নারীর ডিম্বকে প্ৰাণবন্ত করিয়া তোলে। শুক্রকীট পুরুষের শুক্রের তরল অংশে ভাসিয়া বেড়ায়। শুক্ৰ শ্বেতবর্ণ-ঘন, আঠালো রস বিশেষ। শুক্র সম্বন্ধে আধুনিক অভিমত এই যে, উহা অণ্ডকোষ, শুক্রকোষ, প্রষ্টেট গ্রন্থি, কাউপার গ্রন্থি এবং অন্যান্য কয়েকটি গ্রন্থিনিঃসৃত রস ও শুক্ৰকীটের সমষ্টি। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে এক বিন্দু শুক্র পর্যবেক্ষণ করিলে দেখা যায় যে, তাহাতে ভাসমান অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কীট বিদ্যমান। ইহার এক একটি কীট প্রায় ১/৫০০ ইঞ্চি লম্বা। কীট-দেহ মস্তক, মধ্যভাগ ও লেজ, এই তিনভাগে বিভক্ত। ইহারা দেখিতে কতকটা বেঙাচির মত। লেজটিই সমস্ত কীটের ৯|১০ ভাগ। শরীরের অনুপাতে বেঙাচির মাথা অপেক্ষা শুক্র কীটের মাথা সরু এবং তাহার লেজ বেঙাচির লেজ অপেক্ষা লম্বা।


উহারা লেজের সাহায্যে চলিয়া থাকে। পুরুষেয় এক-একবারের স্খলনে গড়ে প্ৰায় তিন ঘন সেণ্টিমিটায় (চা-চামচের প্রায় এক চামচ) পরিমাণ বহির্গত হইয়া থাকে। প্ৰত্যেক শুক্রস্খলনে ২০ হইতে ৫০ কোটি শুক্রকীট বহির্গত হয়। শুক্ৰকীটের অবস্থিতি আধুনিক বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার। প্রাচীন ধৰ্মপ্রবর্তকেরা, পণ্ডিতেরা ও চিকিৎসাবিদগণ ইহার বিষয় অবগত ছিলেন না।

শুক্রকীট অণ্ডকোষের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে উৎপন্ন হইয়া উপরের দিকে ধাবিত হয় এবং শুক্রকোষে গিয়া সঞ্চিত থাকে। ১৩নং চিত্র দেখুন। বীর্ষ স্খলনের সময় শুক্রকোষ হইতে প্ৰষ্টেট গ্রন্থির ভিতর দিয়া মূত্রনালী বাহিয়া উহারা চলার পথে শুক্ৰকোষ, প্ৰষ্টেট গ্রন্থি, কাউপার গ্ৰন্থি প্ৰভৃতি নিঃসৃত রসের সহিত মিলিয়া বাহির হইয়া থাকে। শুক্রকীট ঐ সকল বস-সমষ্টিতে ভাসমান অবস্থায় চলে।

পূর্বেই বলিয়াছি, পুরুষের শুক্রকীট এবং নারীর ডিম-এই উভয়ের মিলনে সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে। এই মিলন নর বা নারীর ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর মোটেই নির্ভর করে না। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অসংখ্য শুক্ৰকীট কি করিয়া জরায়ু এবং ফ্যালোপিয়ান নলে বিচরণ করিতে থাকে, ১০ নং চিত্রে তাহা দেখানো হইয়াছে।


পুরুষের শুক্র নারীর জরায়ুমুখে পতিত হইলে শুক্ৰকীটগুলি লেজ নাড়িয়া চলিতে চলিতে জরায়ুতে প্ৰবেশ করে। সাধারণতঃ উক্ত নলের (এবং খুব কম ক্ষেত্রে জরায়ুর) মধ্যে শুক্ৰকীট ডিম্বের সহিত মিলিত হইলেই ভ্রূণ উৎপন্ন হয়। শুক্রকীট ও ডিমের সাক্ষাৎ হইলেই শুক্রকীটগুলি ডিম্বকে ঘিরিয়া ফেলে। এই সমস্ত শুক্র কীটের মধ্যে সর্বাগ্রগামী শুক্রকীট ডিম্বগাত্রে মাথা প্ৰবেশ করাইয়া দেয়। (১৪নং চিত্র) বীৰ্যমধ্যস্থ হায়ালিউরানিডেজ (Hyaluronidase) নামক জারক রসে (enzyme-) ডিম্বাণুর গাত্রাবরণটি গলাইয়া শুক্ৰকীটের প্রবেশেব সুবিধা করিয়া দেয়। কীটের লম্বা লেজটি বাহির হইয়া থাকে। ক্রমে ঐ লেজটি নিস্তেজ ও অচল হইয়া লোপপ্ৰাপ্ত হয়। এই সংযোগ হইয়া গেলেই ডিম্বের চারিদিকে একটি আবরণ জন্মায় এবং অন্য শুক্ৰকীট আর উহাতে প্ৰবেশ করিতে পারে না। ৯নং চিত্র দেখুন।

পুরুষের শুক্রকীট ও নারীর ডিম্ব এই উভয়ের সংস্পর্শেই সন্তান জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে। সাধারণতঃ যৌনমিলনে এই সংস্পর্শের সুযোগ হয়।

গর্ভধাণ

প্ৰত্যেক নারী সাধারণতঃ প্ৰতি ২৮ দিনে একটিমাত্র ডিম্ব স্খলন করিয়া থাকে। ডিম্ব ও শুক্রকীট-স্খলনের মধ্যে পার্থক্য এই যে, পুরুষের শুক্ৰকীট যৌন-আবেগের সময় শুক্রের সহিত নিঃসারিত হইয়া থাকে, কিন্তু নারীর ডিম্বশ্বলনের সহিত রতিক্রিয়ার ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ নাই। ডিম্বকোষস্থ যে ডিম্বটি যখন পরিপক্ক ও পরিপুষ্ট হয় তখনই সে ডিম্বটি ফ্যালোপিয়ান নলের ভিতর দিয়া পূৰ্ববতী ১০নং চিত্রে প্রদর্শিত পথে জরাযুতে প্ৰবেশ করে।

কোষ-বিভক্তি প্রক্রিয়া

শুক্রকীট ও ডিম্ব একত্রে মিলিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে ডিম্বটি বহিরাবরণের মধ্যেই দুইভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। ঐ দুইভাগ চারিভাগে, চারিভাগ ষোলভাগে এবং এইভাবে (জ্যামিতিক বিভাগক্রমে)। ডিম্বটি অসংখ্য ভাগে পরিণত হয়। এইভাবে বিভক্ত হইতে হইতে, ১৫নং চিত্রে প্রদর্শিত মতে, ডিম্বটি ডিম্ববাহী নলের মধ্য দিয়া প্ৰায় এক সপ্তাহকালের মধ্যে জরায়ুর মধ্যে আসিয়া পড়ে। ততদিনে ইহা প্ৰায় শতশত কোষের সমষ্টিবদ্ধ একটি ক্ষুদ্র পিণ্ডের মত হইয়া পড়ে। শুধু ইহা বহুধা-বিভক্তই হয় না; ইহার কোষগুলি আপনা-আপনিই বিন্যস্ত হইয়া গিয়া (১৬, ১৭, ১৮নং চিত্ৰে প্ৰদৰ্শিত মতে) একটি বিশিষ্ট আকার ধারণ করে।


জরায়ুর মধ্যে আসিয়া ইহা জরায়ুর গাত্রে প্রোথিত হইয়া যায় এবং ইহার কোষগুলি বিভিন্ন কোষবিশিষ্ট অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের রূপপ্রাপ্ত হয় এবং ক্রমে ভ্রূণটি মানবদেহে পরিণত হয়।


এখানে জন্ম রহস্যের মাত্র মোটামুটি একটা বিবরণ দেওয়া গেল। এ সম্বন্ধে বিস্তারিত আলোচনা এই পুস্তকের দ্বিতীয় খণ্ডে এবং আমার অপর পুস্তক ‘মাতৃমঙ্গলে’ করা হইয়াছে।

জীবজগতে জন্ম রহস্য যে কত বড় রহস্য তাহা এই সামান্য আলোচনা হইতেই পাঠক-পাঠিক বুঝিতে পারিবেন।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2