১.০৫ যৌন-ইন্দ্রিয়সমূহ

যৌন-ইন্দ্রিয়সমূহ
(প্রথম খণ্ড – পঞ্চম অধ্যায়)

যৌন-শ্রেণী ও যৌন-ইন্দ্রিয়

প্ৰাণিজগতের প্রায় সমস্ত জাতির মধ্যেই পুরুষ ও নারী এই দুইটি যৌনশ্রেণী বিদ্যমান আছে। এই দুই শ্রেণীর সহযোগিতাতে সৃষ্টিকাৰ্য চলিয়া আসিতেছে। পুরুষ ও নারী চিনিবার উপায় প্রধানতঃ তাহাদের বাহ যৌনইন্দ্ৰিয় সকল। অন্যান্য প্ৰাণীর ন্যায় মানুষের মধ্যেও যৌন-ইন্দ্ৰিয়ের সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান রহিয়াছে। সকলের সুবিধাব জন্য আমরা এই অধ্যায়ে যৌনইন্দ্ৰিয় সমূহের মোটামুটি পরিচয় প্ৰদান করিতেছি।(1)

পাঠক-পাঠিকার এ সকল বিষয়ে নিজস্ব কতকটা জ্ঞান আছে, কিন্তু আভ্যন্তরীণ ইন্দ্ৰিয়সমূহের বিষষে সম্যক জ্ঞান থাকা সম্ভবপর নহে, কারণ, উহারা বাহৃত: দৃশ্যমান নহে।(2)

কেন জ্ঞান আবশ্যক

কথা হইতে পারে, প্রকৃতিই ইন্দ্ৰিয়সমূহ দান করিয়াছে, তাহারা প্রাকৃতিক নিয়মেই নিয়ত আপন আপন কর্তব্য সমাধা করিতেছে, মনুষ্য, গরু, মহিষ, বিড়াল, ইঁদুর সকলেই নিজ নিজ বংশ বিস্তার করিতেছে, তবে আর এ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান লাভের প্রয়োজন কি?

আমরা বলিব, মানুষ নিজের কাৰ্যপরম্পরার বিষয। জানিতে চায়। ইতর জন্তুর চেয়ে তাহার বুদ্ধিই তাহার গৌরবের কারণ। উপযুক্ত জ্ঞানের অভাবেই সে এতকাল অন্ধ কুসংস্কারে ডুবিয়া রহিয়াছে; নানা ভ্ৰান্ত ধারণার বশবর্তী হইয়া অহেতুক বিধিনিষেধের আড়ম্বর করিয়াছে; সুস্থ যৌনজীবন-যাপন ব্যাপারে বহুবিধ বাধা ও কণ্টকের সৃষ্টি করিয়াছে। আমাদের অঙ্গ-প্ৰত্যঙ্গের বিষয়ে সম্যক জ্ঞান থাকিলে আমরা উহাদের স্বাস্থ্যের প্রতি যত্নবান হইতে পারি এবং কোন কারণে কোন ইন্দ্রিয়ের বৈকল্য বা দৌর্বল্য উপস্থিত হইলে চিকিৎসক বা বিশেষজ্ঞের ব্যবস্থার আশ্রয় গ্ৰহণ করিতে পারি।

পুরুষের যৌন-ইন্দ্ৰিয়সমূহ

পুরুষের যৌন-ইন্দ্ৰিয়ের মধ্যে লিঙ্গ (পেনিস) ও অণ্ডকোষই (টেসটিক্লস্‌) প্ৰধান। লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ ভিন্ন আবার প্রষ্টেট গ্ৰন্থি, কাউপার গ্ৰন্থি, শুক্রকোষ প্রভৃতি কতিপয় উপাঙ্গ আছে। নিয়ে যে ছবি দেওয়া হইয়াছে, উহা নরদেহের জননেন্দ্ৰিয়ের প্রধান অংশের লম্বমানভাবে ছেদিত অংশ। উহাতে পুরুষের যৌন-অঙ্গসমূহের পাব।স্পরিক অবস্থিতি সুস্পষ্টভাবে পরিালক্ষিত হইবে। স্ত্রী এবং পুরুষের আভ্যন্তরীণ যৌন-গঠনপ্রণালীর পার্থক্য কত, তাহা এই ছবির সহিত নারীর যৌন-অঙ্গের তুলনা করিলেই সুস্পষ্ট প্ৰতীয়মান হইবে।



পুরুষের লিঙ্গ প্রস্রাব নিৰ্গমের পথ হইলেও ইহা প্রধানত সঙ্গমযন্ত্র। সঙ্গমের উপযোগী করিয়াই প্রকৃতি ইহাকে প্ৰস্তুত করিয়াছে।

উহা গড়পড়তা স্বাভাবিক অবস্থায় দুই হইতে তিন ইঞ্চি লম্বা এবং এক হইতে সোয়া এক ইঞ্চি ব্যাসবিশিষ্ট। তখন ইহা শিথিলভাবে বুলিয়া থাকে। ইহার মধ্যে কোনও অস্থি না থাকায় ইহা অতিশয় কোমল। ইহা প্ৰধানত শিরা, উপশিরা, তন্তু ও স্নায়ুর দ্বারা গঠিত। নিম্নে যে ছবি দেওয়া হইয়াছে, উহা আড়াআড়িভাবে ছেদিত লিঙ্গের ছবি।



উহাতে দেখা যাইবে যে, লিঙ্গের অভ্যন্তরভাগ তিনটি কুঠরিতে বিভক্ত। এই তিনটি কুঠরিই রক্তবাহী উপাদানসমূহের সমষ্টি মাত্র। উপরিভাগে স্পঞ্জের স্থায় যে দুইটি যুক্ত কুঠরি দৃষ্টিগোচর হইতেছে, উহারা প্রকৃতপক্ষে অসংখ্য রক্তবাহী নলিকার সমষ্টি মাত্র। উহারা সংকোচন-সম্প্রসারণশীল কতকগুলি স্নায়ুবিক ও পৈশিক তন্তু দ্বারা পরস্পর সম্বন্ধযুক্ত। উহাদের নিয়ে অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্রাকৃতি স্পঞ্জসদৃশ যে কুঠরিটি দৃষ্ট হইতেছে, উহাও রক্তনালীর সমষ্টি মাত্র। – উহার মধ্যস্থলে যে ছিত্রটি দেখা যাইতেছে তাহাই মূত্রনালী। শুক্রও এই পথ দিয়া নিষ্ক্রান্ত হয়।

উত্তেজনার সময় লিঙ্গের অসংখ্য রক্তবাহী নলিকাসমূহে শোণিত সঞ্চার বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া লিঙ্গের আয়তন ও দৃঢ়তা বৃদ্ধি করে। লিঙ্গমূলের পেশী লিঙ্গের এই উত্থান দৃঢ়তা সংরক্ষিত করে। উত্থানাবস্থায় লিঙ্গের দৈর্ঘ্য সাধারণতঃ চার হইতে সাত ইঞ্চি এবং ব্যাস দেড় হইতে দুই ইঞ্চি হইয়া থাকে। কোনও ক্ষেত্রে (যথা নিগ্রোদের) এই অবস্থায় কাহারও নয় ইঞ্চি হইতে বার ইঞ্চি পরিমাণ লিঙ্গের কথা ডাক্তারেরা বলিয়াছেন। ইহার আগাগোড়া আয়তন প্ৰায় সমান, তবে অগ্র ও পশ্চাদভাগ অপেক্ষা মধ্যভাগ অপেক্ষাকৃত মোটা ও দৃঢ় হইয়া থাকে। স্বাভাবিক অবস্থায় লিঙ্গের দৃশ্যমান অংশ দৈর্ঘ্যে গড়ে মাত্র তিন-চারি আঙ্গুল হইলেও সমগ্রভাবে উহা অনেক বেশী লম্বা। উহা পশ্চাদিকে ৪-৫ ইঞ্চি দীর্ঘ হইয়া গুহ্যদ্বারের দিকে গিয়া শেষ হইয়াছে।

লিঙ্গের অগ্রভাগকে লিঙ্গাগ্ৰ কহে। ইহা শৈশবে ত্বক (Fore-skin) দ্বারা সম্পূর্ণরূপে আচ্ছাদিত থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই ত্বক (অগ্রচ্ছদ) ক্ৰমে ঈষৎ উপরে উঠিয়া যায়। যখন লিঙ্গাগ্র স্বাভাবিক অবস্থায় সম্পূর্ণ বা অংশত আবৃত, এবং উত্তেজিত অবস্থায় সম্পূর্ণ বা অংশত উন্মুক্ত থাকে। লিঙ্গাগ্রভাগ আতিশয় অনুভূতিশীল কোমল তন্তুসমষ্টি দ্বারা গঠিত এবং শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর ন্যায় কোমল ও মসৃণ ঝিল্লীর দ্বারা আবৃত। ইহা ঈষৎ গোলাকার।

লিঙ্গাগ্রভাগের মন্তকের ছিদ্রটি মূত্র ও শুক্র নির্গমের পথ। লিঙ্গ মুণ্ডের এক ইঞ্চি পশ্চাতে ঈষৎ সরু হইয়া লিঙ্গাবরক ত্বকের সহিত মিশিয়া আবার  মোটা হইয়াছে। এই সরু অংশের নাম লিঙ্গগ্রীবা। গ্রীবার অগ্রভাগে লিঙ্গের মুণ্ড সর্বাপেক্ষা অধিক পরিধিবিশিষ্ট,এবং বর্তুলাকার। ইহাই লিঙ্গের মধ্যে সর্বাপেক্ষা অনুভূতিশীল স্থান এবং উঁচু বলিয়া রতিক্রিয়ার সময়ে ইহার সহিতই যোনিগাত্রের বেশি ঘর্ষণ হওয়াতে গভীর সুখানুভূতি হয়।

লিঙ্গের দৈর্ঘ্য বা আয়তন পুরুষের রতিক্ষমতার নির্ভুল পরিচায়ক নহে। উহার সহিত সন্তানোৎপাদন ক্ষমতারও বিশেষ সম্বন্ধ নাই। লিঙ্গের মূলদেশের নিম্নে একটি চামড়ার থলি (২২ নং চিত্তের নং ৮)। এই থলির মধ্যে দুইটি ঈষৎ গোলাকার মাংসগ্রন্থি আছে। এই মাংসগ্রন্থিকে অণ্ডকোষ  বলা হইয়া থাকে। অণ্ডকোষদ্বয়ের প্রত্যেকটি স্বভাবতঃ গড়পড়তা দেড় ইঞ্চি লম্বা, এক ইঞ্চি প্রশস্ত ও আড়াই ইঞ্চি পরিধিবিষিষ্ট। ইহা অপেক্ষা বৃহৎ বা ক্ষুদ্র অণ্ডকোষ সাধারণতঃ সুস্থতার পরিচায়ক নহে। স্বাভাবিক অবস্থায় অণ্ডকোষদ্বয় থলির মধ্যে দুই আড়াই ইঞ্চি ঝুলিয়া থাকে। ঠাণ্ডা লাগিলে থলিটি সঙ্কুচিত হয়। অনেক ক্ষেত্রে বাম অণ্ডকোষটি দক্ষিণ অণ্ডকোষ হইতে বড় হয় এবং একটু বেশি ঝুলিয়া থাকে। ইহাতে ভীত হইবার কারণ নাই।

স্থূলদৃষ্টিতে এই অণ্ডকোষদ্বয় মানুষের শরীরের পক্ষে অনাবশ্যক বোধ হইতে পারে। কিন্তু প্ৰকৃতপক্ষে অণ্ডকোষদ্বয়ের প্রয়োজনীয়তা অসামান্য। অণ্ডকোষদ্ধয় অসংখ্য রক্তবাহী শিরা ও নলিকা দ্বারা গঠিত। এই সমস্ত নলিকায় শুক্ৰকীট জন্মগ্রহণ করে। শুক্ৰকীট সৃষ্টি হইয়া শুক্রকীটবাহী নল বাহিয়া উপরিস্থিত দুইটি থলিতে চলিয়া আসে। এই থলিদ্বয়কে শুক্রকোষ বলে। ফলত অণ্ডকোষদ্বয়ই শুক্রোৎপাদনের উৎস। পুরুষের অণ্ডকোষদ্বয়কে নারীর ডিম্বকোষের সহিত তুলনা করা যাইতে পারে। এই অণ্ডকোষদ্বয় স্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধিপ্ৰাপ্ত না হইলে অথবা দেহমধ্য হইতে না নামিয়া আসিলে শুক্রের অল্পতা, সুতরাং সন্তান উৎপাদন ক্ষমতার অল্পতা বা অভাব সুচিত হইবে।

অণ্ডকোষদ্বয়ে ইহা ছাড়া আর একরকম বিশেষ রস সৃষ্ট হয়। ইহাকে গ্ৰন্থিরস বা হরমোন বলে। এই রস সোজাসুজি রক্তে মিশিয়া শরীরের পুষ্টিসাধন করে, শারীরিক ও মানসিক বৃত্তির উৎকর্ষ সাধন করে, এবং শরীরে ও মনে পুরুষালি ভাব আনে। ইহা শুক্রের সহিত, অথবা অপর কোনও ভাবে বাহির হয় না।

নাভির তলদেশে উরুদ্বয়ের সংযোগস্থলে যেখানে লিঙ্গ ও অণ্ডকোষ সংলগ্ন হইয়াছে, সেই স্থানকে বস্তিপ্রদেশ বলা হব। যৌবনাগমে ঐ স্থানে লোম বাহির হয়।

পূর্বেই উল্লিখিত হইয়াছে যে, অণ্ডকোষে শুক্ৰকীট উৎপন্ন হইয়া উদ্ধৃরদেশে উখত হয় এবং শুক্রকোষ (২২নং চিত্র) নামক কোষদ্বয়ে আসিয়া সঞ্চিত হয়। এই কোষদ্বয় মূত্রাধারের নিম্নে উহার গা ঘোষিযা অবস্থিত। এই কোষদ্বয়ে শুক্ৰ সঞ্চিত থাকা ব্যতীত এক প্রকার তরল রসও উৎপন্ন হয়। এই রস ঈষৎ পিচ্ছিল বলিয়া উহার সহিত শুক্র মিশ্রিত হইয়া শুক্ৰও পিচ্ছিল হইয়া থাকে।

মূত্রাধারের নিয়ে শুক্রকোষের সমান্তরালে, মূত্রনালীর অপর পার্শ্বে দৈর্ঘ্যে প্রস্থে দেড় ইঞ্চি লম্বা। আর একটি গ্রন্থি আছে। এই গ্ৰন্থির নাম মুখশায়ী গ্ৰন্থি বা প্ৰষ্টেট গ্ৰন্থি (২২নং চিত্র). ইহার অবস্থিতি শুক্ৰ নিৰ্গমন রোধ করে বলিয়া শুক্ৰস্থলনে পুরুষ এতটা পুলকাবেগ অনুভব করে। এতদ্ব্যতীত এই গ্ৰন্থি হইতে একপ্রকার শ্বেত রস নিঃসৃত হইয়া থাকে। ঐ রস মূত্রনালীকে পিচ্ছিল করিয়া দেয় বলিয়া শুক্র নির্গমনে সুবিধা হয় এবং শুক্রকীটও এই রসে উদ্দীপিত হয়। এই রসই শুক্রের বিশিষ্ট গন্ধের কারণ।

মুত্রনালীর নির্গম-পথের সম্মুখে বাদামের মত ক্ষুদ্ৰাকৃতি যে দুইটি গ্ৰন্থি অবস্থিত, উহাদিগকে কাউপার গ্রন্থি (২২নং চিত্র) বলা হয়। এই গ্রন্থিদ্বয় হইতেও প্ৰষ্টেট রস ও শুক্রকোষ-নিম্রাবের ন্যায় এক প্রকার তরল স্রাব নিৰ্গত হয়। ইহাও শুক্র নির্গমনের সুবিধার জন্যই হইয়া থাকে। কামোত্তেজনার সময় ইহার রস মূত্রনালী দিয়া নিৰ্গত হয়। এই রস পাতলা, বর্ণ ও গন্ধহীন ও চটচটে। ইহা পিচ্ছিল হওয়ায় সঙ্গমকে সহজ ও বেদনাহীন করে।

নারীর যৌন-অঙ্গসমূহ

স্ত্রীলোকের যৌন-ইন্দ্ৰিয়কে নিম্নলিখিত ভাগে ভাগ করা। যাইতে পারে; ভগ, যোনি, জরায়ু, ডিম্ববাহী নল ও ডিম্বকোষ। নিয়ে যে ছবি দেওয়া হইল, উহা নারীর যৌনপ্রধান দেহাংশের লম্ববান ছেদিত অংশ। এই ছবি হইতে নারীদেহের যৌন-অঙ্গসমূহের আভ্যন্তরিক অবস্থিতির পারস্পরিকতা বুঝা যাইবে।



উরুদ্বয় ও উদর যেখানে আসিয়া মিলিত হইয়াছে সেই ত্রিকোণাকৃতি স্থানটুকু যোনিপ্রেদেশ। উহা উপর হইতে ক্রমশ সরু হইয়া নীচের দিকে মলদ্বার পর্যন্ত নামিয়া আসিয়াছে। উহার নাম ভগ। ভগের দুই দিকেই একটি করিয়া খাজ (কুঁচকি) দেখা যায়। উপরে যেখানে যোনিপ্রদেশ সবচেয়ে স্ফীত ও চওড়া তাহাকে কামাদ্রি বলে। এই স্থান জুড়িয়া কৈশোরে লোম উৎপন্ন হইয়া থাকে। এখানে কিছু চৰ্বি জমা থাকে বলিয়া উহাকে অন্যান্য অংশ অপেক্ষা কিঞ্চিৎ উঁচু দেখায়।

কামাদ্রির নীচেই ঠিক মাঝখান হইতে দুইধারে দুইটি চামড়ার ভাঁজ ঠোঁটের মত হইয়া নামিয়া আসিয়া মলদ্বারের দিকে গিয়াছে। ইহাদের নাম বৃহদোষ্ঠ। উপরের দিকে এই ওষ্ঠদ্বয় স্ফীত থাকে, কিন্তু নীচের দিকে পাতলা হইয়া নামিয়া যায়। ইহাদের উপরেও কৈশোরে কেশোদগম হয়। কামাদ্রির ও বৃহদোষ্ঠের চামড়ার মধ্যে বহু তৈলনিঃসারক এবং ঘর্মনিঃসারক গ্ৰন্থি আছে। রস নিঃসরণের ফলে সাধারণতঃ অভ্যন্তরভাগে ভিজা থাকে। বৃহদোষ্ঠ স্ত্রীলোকে বা সমস্ত যোনিপথটি ঢাকিয়া রহিয়াছে। বৃহদোষ্ঠের জন্যই স্ত্রীলোক স্বাভাবিকভাবে দাঁড়াইলে তাহার যোনিমুখ দৃষ্টিগোচর হয় না। বৃহদোষ্ঠের ভিতরে পুনরায় দুইটি ক্ষুদ্র চামড়ার ঠোঁট দ্বারা যোনিমুখ আবৃত থাকে। এই দুইটি ঠোঁটকে ক্ষুদ্রোষ্ঠ বলা হয়। ক্ষুদ্রোষ্ঠের ভিতরেও বহুসংখ্যক তৈলনিঃসাবক গ্ৰন্থি আছে।

ভগের ফাটলের প্রারম্ভেই ক্ষুদ্রোষ্ঠের সংযোগস্থলে যে মাংসাক্ষর আছে, উহাকে ভগাঙ্কুর বলা হয়। স্ত্রীলোকের ভগাঙ্কুরের গঠন ও প্রকৃতির সহিত পুরুষের লিঙ্গের অনেকটা সাদৃশ্য। গোচর হইয়া থাকে। তবে স্বায়ুর আধিক্যহেতু ইহার শীর্ষদেশ পুরুষের শিশ্নাগ্রের অপেক্ষা অনেক বেশী স্পর্শানুভবী ও উত্তেজনাশীল। নিগ্রো স্ত্রীলোকের ভগাঙ্কুর অপেক্ষাকৃত বড় হয় বলিয়া প্রকাশ।

মুত্রনালীর মুখ ভগাঙ্কুরের নীচে এবং যোনিপথেব ঊর্ধ্বে অবস্থিত। এই পথটি মূত্রাধার হইতে নামিয়া আসিয়াছে। (২৪নং চিত্রে দেখুন)

মূত্রনালীর মুখের একটু নীচেই এবং অল্প পিছনে যোনিমুখ অবস্থিত। অনেক লোকই ভুল বুঝিয়া মনে করে যে, পুরুষের মত স্ত্রী-লোকের মূত্রনালী ও যোনিপথ এক। ইহা ঠিক নহে। মূত্রনালী ও যোনিপথ ভিন্ন।

ওষ্ঠদ্বয় ফাঁক করিলে স্ত্রীলোকের যোনিমুখ দৃষ্ট হয়। যোনিমুখ হইতে জরায়ুমুখ পর্যন্ত ৩-৪ ইঞ্চি লম্বা ও ২ ইঞ্চি ব্যাস-বিশিষ্ট যে একটি নল আছে এই নলটিকেই যোনিপথ বলা হইয়া থাকে। এই নলটি সংকোচন- প্রসারণশীল পেশীসমূহ দ্বারা এমনভাবে গঠিত যে, ইহাকে চাপ দিয়া অনেকখানি বড় করা যাইতে পারে। সন্তান প্রসবের সময় ইহা পরিধিতে প্ৰায় ১৫ ইঞ্চি প্ৰশান্ত হইতে পারে। যোনিপথ জরায়ুতে গিয়া শেষ হইয়াছে। যোনিপথেই পুরুষের শুক্র নারীর জরায়ুতে গমন করে এবং সন্তান মাতৃগর্ত হইতে নিষ্ক্রান্ত হয়।

জরায়ু বস্তিকোটরে ঝুলায়মান একটি থলে। ইহার আকার অনেকটা পেঁপের মত। ইহার গলা সরু এবং পেট মোটা। ইহার মুখ নিন্মদিকে যোনিপথের সহিত মিশিয়াছে। ইহা প্ৰায় ৩ ইঞ্চি লম্বা ও ২ ইঞ্চি চওড়া। ইহা এমন সঙ্কোচন-সম্প্রসারণশীল তন্তুদ্বারা গঠিত যে, গর্ভাবস্থায় ইহা স্বাভাবিক অবস্থার ছয় হইতে আট গুণ বৃদ্ধিপ্ৰাপ্ত হয় (২১ নং চিত্ৰ)। কিন্তু প্রসবের পরে প্রায় ৪০ দিনের মধ্যে ইহার আবার স্বাভাবিক আকারপ্রাপ্ত হয়; তবে সম্পূর্ণভাবে প্রসবের পূর্বের অবস্থা প্ৰাপ্ত হয় না। জরায়ুর ভিতরভাগের গাত্র শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর দ্বারা আবৃত।

জরায়ুর উভয় পার্শ্বে ঈষৎ উচ্চে দুইটি গ্রন্থি আছে। ইহাদের আকার দুইটি বৃহৎ বাদামের মত, দৈর্ঘ্যে দেড় ইঞ্চির বেশী হইবে না। ইহাদিগকে ডিম্বকোষ বলা হয়। এই ডিম্বকোষদ্বয়ের অনতিদূরে দুইটি নল দুইদিক হইতে জরায়ুতে মিলিত হইয়াছে। ডিম্বকোষের নিকট ইহাদের মুখ প্ৰস্ফুটিত ফুলের মুখের মত শাখাবিশিষ্ট এবং ইহারা দৈর্ঘ্যে চারি ইঞ্চির অধিক হইবে না। ইহাদিগকে ডিম্ববাহী নল বা ফ্যালোপিয়ান টিউব বলা হয়।

যোনিমুখের সামান্য পশ্চাতে একটি পাতলা ঝিল্লী দ্বারা যোনিমুখ অনেকটা আবৃত থাকে। প্ৰধানত প্রথম সঙ্গমের দ্বারা, কিংবা কদাচিৎ অন্য কোনও কারণে ইহা ছিঁড়িয়া যায়। ইহাকে সতীচ্ছদ বলা হয়। ইহার নাম সতীচ্ছদ দিবার কারণ বোধ হয় এই যে, পূর্বকালে এই পর্দাকে সতীত্বের নিদর্শন মনে করা হইত। এই পর্দা দ্বারা যোনিমুখ অনেকটা আবৃত থাকে, তবে রক্তস্ৰার বাহির হইবার জন্য বিভিন্ন আকারের ও মাপের একটি (কদাচিৎ একাধিক) ছিদ্র থাকে।(3) এই আবরণ ছিন্ন না করিয়া পুরুষের লিঙ্গ কিছুতেই নারীর যোনির মধ্যে প্রবেশ করিতে পারে না। সুতরাং কোনও নারীর সতীচ্ছদ ছেঁড়া থাকিলে সে পুরুষের সহিত সঙ্গম করিয়াছে, এমন মনে করা একেবারে অন্যায় নহে। তবে কথা এই যে, পুরুষের লিঙ্গ প্ৰবেশ ব্যতীত অন্য কারণেও সতীচ্ছদ ছিন্ন হইতে পারে এবং কদাচিৎ হইয়াও থাকে। যাহাদের সতীচ্ছদ খুব পাতলা, মাতার বা নিজের অঙ্গুলি দ্বারা পরিষ্কার করার বা চুলকাইবার উৎসাহে তাহাদের পর্দা ছিঁড়িয়া যায়। খেলাধুলা বা লাফালাফির ফলে ইহা ছিন্ন হয় না। শৈশবে অজ্ঞাতসারে (কৃমি প্ৰবেশ প্রভৃতি কারণে) যোনি চুলকাইতে চুলকাইতে বালিকাদের সতীচ্ছদ ছিন্ন হইতে পারে। সতীচ্ছদের অবিদ্যমানতা নারীর অসতীত্বের সুস্পষ্ট লক্ষণ ধরিয়া লওয়া নিতান্ত অসঙ্গত। আবার কোনও কোনও নারীর সতীচ্ছদ এত পুরু ও শক্ত যে পুরুষ সহবাসেও তাহা কিছুতেই ছিন্ন হয় না; সকলক্ষেত্রে পূর্ণ সঙ্গম কারাও সম্ভব হয় না। সেজন্য অস্ত্ৰপ্ৰয়োগের দ্বারা তাহাদের সতীচ্ছদ ছিন্ন করিয়া স্বামী সহবাসের সুবিধা করিয়া লইতে হয়। সুতরাং সতীচ্ছদ অছিন্ন থাকা (অক্ষত যোনি) সতীত্বের অকাট্য প্রমাণ নয়।

রতিক্রিয়ার সহিত স্ত্রীলোকের স্তন প্ৰত্যক্ষভাবে না হইলেও এত ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত যে, স্ত্রীলোকের স্তনকে যৌন-অঙ্গের অন্তভূক্ত করা হইয়াছে। যৌবনাগমের পূর্বে স্ত্রীলোকের ও পুরুষের স্তনের মধ্যে আকারগত কোন পার্থক্য থাকে না। যৌবনাগমে স্ত্রীলোকের স্তনদ্বয় অর্ধ-বর্তুলাকার, দৃঢ় অথচ কোমলস্পর্শ দুইটি মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়। গর্ভাবস্থায় এই স্তন সর্বাপেক্ষা উন্নত ও বৃহৎ হয়। এই সময়ে স্তনে দুগ্ধ জন্মে এবং বেঁটার চারিপার্শ্বে বৃত্তাকারে কাল দাগ পড়ে। সাধারণতঃ সন্তানের জননী হইবার পর দুগ্ধের ভারে এবং স্তনের স্বায়ুসমূহ দুৰ্বল হইয়া স্তন শিথিল হইয়া হেলিয়া পড়ে। স্তনদ্বয় বক্ষের উভয় পার্শ্বের ৩য়, ৪র্থ, ৫ম, ৬ষ্ঠ ও পঞ্জরাস্থি আবৃত করিয়া উত্থিত হইয়া থাকে। ইহাদের অভ্যন্তরে প্রচুর পরিমাণে দুগ্ধ নিঃসারিক গ্ৰন্থি বিদ্যমান থাকে। স্তনদ্বয় (বিশেষ করিয়া উহাদেয় বোঁটা) খুব অনুভূতিশীল বলিয়া পুরুষের স্পৰ্শন, মর্দন-চোষণে নারীর সুখানুভূতি এবং যৌনলালসা উদ্দীপিত হয়।

ডিম্বস্ফোটন ও ঋতুস্রাব

খুব অল্প কিছুদিন আগেও ডিম্বস্ফোটন প্রক্রিয়া সম্পর্কে মানুষের কিছুই জানা ছিল না। কিন্তু ঋতুস্রাব সম্বন্ধে কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের বশবর্তী হইয়া মানুষ নানা বিধিনিষেধের জাল বুনিয়াছিল। বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও ঋতুস্ৰাবকালে স্ত্রীলোককে অপবিত্র বিবেচনা করা হইয়াছে। জোরোস্ট্রীয়ানদের (ভারতের পার্শিদের) ধর্মশাস্ত্ৰ অনুসারে ঋতুমতী নারী যে শুধু অপবিত্ৰ তাহা নহে, পরন্তু সে ভূতের প্ৰভাবাধীন। হিন্দুশাস্ত্ৰমতে ঋতুস্রাবকালে পুরুষ যাহাতে স্ত্রীলোকের সাথে একই শয্যা গ্ৰহণ না করে সে সম্বন্ধে স্পষ্ট নির্দেশ বহিয়াছে। কোরানে ঋতুস্রাবকে পীড়া বলিয়া উল্লেখ করা হইয়াছে এবং এই সময়ে স্ত্রী-সহবাসকে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করা হইয়াছে।

ঋতুস্রাব সম্বন্ধে বিচিত্ৰ প্ৰথা

পশ্চিম আফ্রিকার আসিনি (Assini) প্রদেশে রজঃস্বালা রমণীকে নৌকায় চড়িয়া নদী পার হইতে দেওয়া হয় না। আবব দেশের রমনীরা ঋতুস্রাব আরম্ভ হওয়া মাত্র সর্ববিধ ধর্ম-কর্ম হইতে বিরত থাকে। কোনও এক আদিম অষ্ট্রেলিয়াবাসী তাহার কম্বল স্পর্শ করিয়াছিল বলিয়া তদীয় ঋতুমতী স্ত্রীকে বধ করিয়াছিল। এশিয়া ও ইউরোপের অনেক স্থানে রমণীরা ইহা আরম্ভ হইলে যে বস্ত্রখণ্ডে রক্ত শোষণ করিয়া লয় তাহা স্রাবকালে আর পরিবর্তন করে না। তাহারা মনে করে যে নূতন বস্ত্রখণ্ড ব্যবহার করিলে স্রাব নূতনভাবে দ্বিগুণ বেগে আরম্ভ হইতে পারে। ভারতীয় রমণীরা কেহ কেহ এই সময়ে পুষ্প সম্ভবা চারা গাছের নিকট গমন করে না। কারণ তাহা হইলে উক্ত গাছ শুকাইয়া মরিয়া যাইতে পারে। তাঁহারা ফলের বাগানে কিংবা শস্যপূৰ্ণ মাঠে গমন করে না, যদি করে তাহা হইলে নাকি ফলমূল এবং শস্যের পরিমাণ হ্রাস পাইতে পারে। প্ৰাচীনকালে জার্মানীতে এই ধারণা ও নিষেধ ছিল। রেড ইণ্ডিয়ানরা ঋতুমতী নারীকে পুরুষের ব্যবহৃত কোনও বিছানা-পত্র বা কাপড়-চোপড় ব্যবহার করিতে, কিংবা রান্না করিতে কিংবা বাহিরের কোন পুরুষের মুখ দেখিতে দেয় না। এই ধরণের কুসংস্কারাচ্ছন্ন বিধিনিষেধ। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যেই বিভিন্ন যুগে স্থান পাইয়াছে।

বর্তমানে অনুসন্ধানের ফলে জানা গিয়াছে যে, ডিম্বকোষের কার্যকলাপের দরুনই এই ঋতুস্রাব সংঘটিত হয়। ঋতুস্রাবের মুখ্য উপাদানগুলি জরায়ু হইতে আসে। প্রতিমাসে ডিম্বকোষ হইতে ডিম্ব নির্গমের সময়ে জরায়ু গৰ্ভধারণের জন্য প্ৰস্তুত হয়। প্ৰাণবন্ত ডিম্বকে জায়গা দিয়া উহার বৃদ্ধির সাহায্য করিতে জরায়ুর ভিতরে যে উদ্যোগ ও আয়োজন হয়, তাহাতে জরায়ুর ভিতরকার শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী বেশ পুরু হইয়া উঠে ও ইহার ভিতরকার গ্ৰন্থিগুলি বুদ্ধিপ্ৰাপ্ত হইয়া শাখা-প্ৰশাখা বিস্তার করে। ডিম্বকোষে প্ৰস্তুত এক প্রকারী হরমোনেব প্ৰভাবেই এরকম হয়। গর্ভোৎপাদন না হইলে অর্থাৎ নারীর ডিম্বের সহিত পুরুষের শুক্ৰকীটের সংস্পৰ্শ না ঘটিলে ঐ ঝিল্লীব অধিকাংশ রক্তস্রাবের সহিত নিৰ্গত হইয়া যায়। এবং উহার স্থলে অবশিষ্ট ঝিল্পী হইতে নূতন ঝিল্লী গঠিত হয়। প্ৰতিমাসে এইরূপে গর্ভ গ্ৰহণের জন্য জরায়ু প্ৰস্তুত হয় এবং গর্ভাধান না হইলে ঋতুস্রাবও মাসে মাসে হয়। ঋতুস্রাব (ইংরেজী Menstruation) শব্দটির উৎপত্তি ল্যাটিন মেনসিস অর্থাৎ মাস হইতে। মাসে মাসে ইহা ঘটে বলিয়া বিভিন্ন ভাষায় ইহাকে ‘মাসিক’ বলা হইয়া থাকে।

ডিম্ব পরিপক্ক হইয়া ডিম্বকোষ হইতে নির্গত হইয়া আসাকে ডিম্বস্ফোটন বা (ওভিউলেশ্যন) বলে। এই ডিম্বস্ফোটন ও ঋতুস্রাব আরম্ভ হয় কৈশোরে এবং ৪০-৫০ বৎসর বয়ঃক্রমকালে প্ৰথমে কয়েক মাস অনিয়মিত স্রাব হইয়া পরে চিরকালের মত ঋতু বন্ধ (ঋতু সংহার) হয়। ইহার প্রায় এক বৎসর পরে নারীর সন্তানোৎপাদন ক্ষমতার অবসান হয়।

পূর্বকালের বিশ্বাস ছিল যে, ডিম্বস্ফোটন ও স্রাব একই সময়ে হইয়া থাকে। কিন্তু অধুনা ইহা সুনিশ্চিতভাবেই জানা গিয়াছে যে রক্তস্রাব ডিম্বস্ফোটনের অনুবর্তী। দুই ঋতুর প্রায় মাঝামাঝি সময়ে (পরবর্তী স্রাব আরম্ব হইতার ১৪ দিন পূর্বে ডিম্বস্ফোটন হয়। সাধারণ সুস্থ নারীর (শতকরা ৮০ হইতে ৯১ জন) ‘মাসিক স্রাব’ নিয়মিতভাবে ঋতুমতী হইলে ২৬ হইতে ৩২ দিনের মধ্যে দেখা যায়। প্ৰতি মাসে কোন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে হওয়া অতীব বিরল। কোনও কোনও ক্ষেত্রে ২০-২১ দিন অন্তর ঋতুস্রাব হয়। কদাচিৎ ৪১ দিনেরও ব্যবধান দেখা যায়। ইহার স্বাভাবিক নিয়মই অনিয়মিত হওয়া। এই ঋতুস্রাব সাধারণতঃ ৩ হইতে ৫ দিন স্থায়ী হয়। এবং ৫ দিনের বেশী হইলে রোগ জ্ঞান করিয়া তাহার চিকিৎসা করা প্রয়োজন।

সংস্কারমুক্ত মন লইয়া বিচার করিলে বুঝা যায়, ঋতুস্রাবকে ঘৃণার চক্ষে দেখার কোন যুক্তি নাই। ইহা সম্পূৰ্ণরূপে একটা প্ৰাকৃতিক ব্যাপার। ঋতুস্রাবের দরুন উদ্বেগের কিছু নাই। বরং যদি ঋতুস্রাব না হয় কিংবা অনিয়মিত হয় তখনই কেবল উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ থাকে। অনেকে মনে করেন যে, এই স্রাবে বিষাক্ত পদার্থ থাকে। এই ধারণা ভুল।

ঋতুস্রাবে গোলযোগ ও তাহার প্ৰতিকার সম্পর্কে তথ্যাদি ৩০ অধ্যায়ে, এবং পালনযোগ্য বিধিনিষেধ ২৮ অধ্যায়ে দেওয়া হইয়াছে।

যৌবন লক্ষণগুলি প্রকাশের বয়স)

কিন্‌যে প্রভৃতির গবেষণায় নিম্নলিখিত বয়সগুলিতে শতকরা কতজনের স্তন, বস্তিলোম ও ঋতুস্রাব দেখা গিয়াছে তাহার হিসাব-ইহা আমেরিকার মেয়েদের মধ্যকা্র হিসাব। আমাদের দেশে একটু সকাল সকালই এই সকল প্ৰকাশ পায়।

বয়স

শতকরা কত জনের দেখা গিয়াছে

বস্তিলোম

স্তন

ঋতু

-

-১০

১০-১১

১৬

১৪

১১-১২

৪০

৩৭

২১

১২-১৩

৭২

৬৭

৫০

১৩-১৪

৯১

৮৭

৭৯

১৪-১৫

৯৮

৯৫

৯২

১৫-১৬

১০০

৯৮

৯৭

১৬-১৭

১০০

৯৯

৯৯

১৭-১৮

১০০

১০০

১০০

১৮-১৯

১০০

১০০

১০০

 

গড়পড়তা বস্তিলোম প্রথম প্ৰকাশের বয়স ১২., স্তনের ১২.৪ ও ঋতুস্রাবের ১৩ বৎসর। গড়পড়তা বস্তিলোম ও স্তন প্রকাশের প্রায় সাড়ে ৮ মাস পরে আদ্য ঋতু আরম্ভ হয়।

বিভিন্ন প্রকার প্রজনন

প্রজননে যৌন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের আলোচনার পরে স্বভারতই প্রশ্ন উঠতে পারে ইত্যর প্রাণীদের মধ্যে এই সম্বন্ধে কি ব্যবস্থা রহিয়াছে এবং কোন কোন দিক হইতে স্ত্রী ও পুরুষের মধ্যে মিল ও গবামিল রহিয়াছে। সংক্ষেপে এ বিষয়ে কয়েকটি সাধারণ কথা বলা যাইতেছে।

প্ৰজনন জীবনের একটি মৌলিক গুণ। প্ৰজনন থামিয়া গেলে জীবনের পরিসমাপ্তি অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু এই প্রজননের প্রক্রিয়া একই রকমের নহে। ইহা ব্যাপকভাবে বিভিন্ন প্রকারের হইয়া থাকে।

১। প্রজননের সর্বাপেক্ষা সবল প্রক্রিয়া দৃষ্ট হয় এমিবা ও ব্যাক্টিবিয়া জাতীষ জীবনের আদিম আকৃতির মধ্যে। যখনই এমিবা একটি নির্দিষ্ট আকার ধারণা করে তখনই ইহা দুইভাগে বিভক্ত হইয়া যায়। প্ৰতি অংশই আবার পূর্ণতা পায় ও আবার দুইভাগে বিভক্ত হয়। এই রকম ভাবে এক রকম পোকা (Flat worm) কতগুলি অংশে বিভক্ত হইয়া যায় এবং প্রতিটি অংশই পূর্ণাঙ্গ জীবে পরিণত হয়। এই রকমের প্রজনন প্রতিক্রিয়াকেই অযৌন-প্ৰজনন (Asexual Reproductior) আখ্যা দেওয়া হইয়া থাকে। সর্বাপেক্ষে নিম্নতম শ্রেণীর জীব এই পদ্ধতিতেই জন্মায়। ইহারা এই ভাবেই বংশ বিস্তার করিয়া আসিতেছে। (৫নং চিত্র দেখুন)

২। উপরোক্ত জীবের মধ্যেও দেখা যায়, দ্বিধাবিভক্ত হইয়া বংশ বিস্তারেব ব্যাপার চলিতে চলিতে যেন শ্ৰান্তির কোনও কারণ আসিয়া পড়ে। তখন দুইটি ভিন্ন জীব একত্রে মিশিয়া বা মিলিয়া আবার ভিন্ন হইয়া যায়। এরূপ সংযোজনের দ্বারা ইহা বা যেন পরস্পরের মধ্যে কতক পদার্থ বিনিময় করতঃ পুনর্বার উদ্দীপ্ত বোধ করে। ঐ দুইটি পূর্বের মতই দেহ বিভাগ প্রক্রিয়ায় বংশ বিস্তার করে। এই ভাবেই বোধ হয় জীব-জগতে যৌন-মিলনের সূত্রপাত হইয়াছিল।

৩। পরবর্তী ধাপে দেখা যায় দেহের নির্দিষ্ট কতগুলি কোষ প্রজননের উদ্দেশ্যে বিশিষ্ট আকার ধারণ করিতেছে। স্বতন্ত্র, অঙ্কুর, কোষ, শুক্র এবং ডিম্ব গঠিত হইয়া দুইটির মিলনে একটি নূতন জীবের উৎপত্তি হইতেছে। এইরূপে জীব কোষের মধ্যে শ্রম-বিভাগ (Division of Labour) দৃষ্ট হয়।

উভলিঙ্গ ও মধ্যলিঙ্গ (Hermaphroditism and Inter-sex)

উভলিঙ্গ জীবের দৃষ্টান্ত শামুক ও কেঁচো্র মধ্যে পাওয়া যায়। ইহা এমন এক অবস্থা যাহাতে একই প্ৰাণীর মধ্যে স্ত্রী ও পুরুষের যৌন-অঙ্গ ও গ্রন্থিসমূহ দৃষ্ট হয় এবং সে স্ত্রীলোক না। পুরুষ বলা দুষ্কর হয়। মানুষের মধ্যেও যে একই ব্যক্তি স্ত্রীলোক ও পুরুষের মতই যৌন-কাৰ্য সমাধা কবিতে পারে চিকিৎসাশাস্ত্রে তার সামান্য কয়েকটা দৃষ্টান্ত বহিয়াছে।

প্রকৃত উভলিঙ্গ প্ৰাণীর শরীরের মধ্যে পুরুষ ও নারীর যৌন-গ্রন্থি (sexgland) দুইটির (অর্থাৎ অণ্ডকোষ ও ডিম্বকোষ) দৃষ্ট হয়। এইরূপ দৃষ্টান্ত অতি বিরল। তবে এরূপ হয় যে, একই ব্যক্তি অণ্ডকোষ অথবা ডিম্বকোষের অধিকারী হয় (উভয়ের নহে), কিন্তু বিপরীত লিঙ্গের নানা লক্ষণ ও প্রভাব তাহার মধ্যে দেখা যায়। এইরূপ স্থলে মূলতঃ (প্রকৃত) পুরুষকে স্ত্রীলোকের মত দেখায় এবং সে স্ত্রীলোকের মত ব্যবহার করে, আর স্ত্রীলোককে পুরুষের মত দেখায় এবং সে পুরুষের মত ব্যবহার করিয়া থাকে।

এই রকমেব ঘটনাকে আন্তঃলিঙ্গ (Intermediate sex) ব্যাপার বলিয়াও অভিহিত কিবা হয় এবং সময় সময় সাময়িক পত্র-পত্রিকায় এরূপ ধরনের ঘটনার উল্লেখে চাঞ্চল্যের সৃষ্টিও হয়। ডাক্তার জেমস পারসনস (James Persons) এ রকমের দৃষ্টান্ত তাহার পুস্তকে উল্লেখ করিয়াছেন।

৪। কোনও কোনও প্ৰাণীর মধ্যে দেখা যায় যৌন-মিলনের মারফত বা গৌণভাবে শুক্র প্রেরণের ফলে জীবনের সৃষ্টি হয়। ব্যাঙের ক্ষেত্রে দেখা যায়। পুরুষ-ব্যাঙ দৃঢভাবে নারী-ব্যাঙের পৃষ্ঠে বসিয়া উহাকে সামনের পদদ্বয় দ্বারা আঁটিয়া ধরিয়াছে। এইভাবে চার থেকে দশ দিন পৰ্যন্ত চলিতে থাকে। অতঃপর নারী-ব্যাঙ ডিম্ব ছাড়ে এবং পুরুষ-ব্যাঙ শুক্র পরিত্যাগ করে। এক্ষেত্রে পুরুষ-ব্যাঙের যৌনাঙ্গ নারী ব্যাঙের অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট করানো হয় না। কেবলমাত্র একে অপরকে স্পর্শের দ্বারা উত্তেজিত করে, ফলে উভয়ের যৌন-ক্রিয়া সমাধা হয়; প্রজননের কাজও চলে। এক রকমের শুক্তি দেখা যায় যাহাদের পুরুষ-শুক্তির শুক্রবীজাণু জলে ছাড়ার পরে যখন কোন নারী শুক্তির সান্নিধ্যে আসে তখনই উহার যোনি পথে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া যায়।

৫। মাছের মধ্যে মৈথুন ক্রিয়া ব্যতিরেকে বংশ বিস্তার হয়। স্ত্রী-মৎস্য জলের উপরে ডিম্ব ছাডে। ডিম্বের গন্ধ বা দৃষ্টি পুং-মংস্যকে আকৃষ্ট করে। তখন উহা শুক্র পরিত্যাগ করিয়া ভাসমান ডিম্বকে প্ৰাণবন্ত করিয়া দেয়। দুই মৎস্যের দৈহিক মিলনের কোনও প্রয়োজন হয় না।

৬। আর এক ধাপ উপরে আসিয়া দেখা যায় স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গের প্ৰকৃত মৈথুন ছাড়াও কেবলমাত্র উহাদের সংস্পর্শের দ্বারা শুক্রকে যথাস্থানে স্থাপন করার মধ্য দিয়া গর্ভোৎপাদন করা হয়। পাখীর মধ্যে ইহা সচরাচর হয়। পুং ও স্ত্রী পাখী পরস্পরেব যৌন-নলকে সান্নিধ্যে রাখিলেই শুক্র বাহির হইয়া স্ত্রীপক্ষীর দেহাভ্যন্তরে প্রবেশ করে।

৭। মাকড়সা জাতীয় কীটাদি নিঃসরণ যন্ত্রকে মৈথুন-যন্ত্র থেকে বিচ্ছিন্ন করিয়া সংজনন ক্রিয়া চালাইয়া যায়।

৮। শাবকবাহী জন্তু ও বৃশ্চিক যৌন-ক্রিয়া নিষ্পন্ন করে কাঁটার মত জননেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে।

৯। সর্বশেষে আমরা দেখিতে পাই জননেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে মৈথুন ক্রিয়া। স্তন্যপায়ী জীবেরা, যেমন মানুষ ও অপরাপর কয়েক শ্রেণীর প্রাণীরা মৈথুনযন্ত্রের সাহায্যে শুক্ৰ প্রেরণের দ্বারা গর্ভসঞ্চার করিয়া থাকে।

উন্নত ধরনের জীবের ক্ষেত্রে স্ত্রীলোকের দেহাভ্যন্তরে ডিম্ব ও শুক্র কীটের মিলন সংঘটিত হয়। ইহার জন্য দৈহিক মিলনের প্রয়োজন। এইরূপ মিলনের সময় পুরুষের শুক্ৰ স্ত্রীলোকের যৌন-অঙ্গে স্থাপন করা হয়। এই প্রক্রিয়াকে শুক্রস্থাপন কাৰ্য (Insemination) বলা হয়। ভেড়া, হরিণ জাতীয় যে সকল প্ৰাণীর মৈথুন অঙ্গের সাথে শুক্রকে সরাসরি ঠিক জরায়ু গর্তে প্রেরণের জন্য এক রকমের সূতার মত সাদা উপাঙ্গ থাকে সেই সকল ক্ষেত্রে শুক্ৰ সরাসরি জরায়ুর অভ্যন্তরে প্রবিষ্ট হইয়া গর্ভোৎপাদন করে। কিন্তু অপরাপর ক্ষেত্রে যেমন মানুষের বেলায়, শুক্ৰ যোনিপথের শেষ প্ৰান্তে জমা হয়। সেখান হইতে উহা ক্ৰমে ক্ৰমে জরায়ু ও ফ্যালোপিয়ান টিউবে উপস্থিত হয়। সমস্ত শুক্রকীট বাহিয়া উপরে উঠতে পারে না। অসংখ্য শুক্ৰকীট যোনিপথের এসিড নিঃসরণের ফলে নিঃশেষ হইয়া যায়।

এইভাবে শুক্রকীট ও ডিম্বের মিলনের ফলে যে প্ৰজনন ক্রিয়া চলে তাহার বিশেষত্ব হইল যে দুইটি ভিন্ন জীবের দোষ ও গুণের সমন্বয়ে বংশধরেরা খানিকটা ভিন্ন আকার ও প্ৰকৃতির হয়। উন্নতি ও অবনতি বিবর্তনেরই ধারা।

মানুষ বুদ্ধিবলে গৃহপালিত পশু ও পক্ষীর মধ্যে উন্নত ধরনের জীবের কর্ষণ করিতে পারে। জীববিজ্ঞান মানুষকে এতদূর ক্ষমতা দিয়াছে। মানুষের মধ্যেও উৎকর্ষ সাধনের পদ্ধতি ইউজেনিক মতবাদে বহিয়াছে।

অন্তঃস্ৰাবী গ্ৰন্থিসমূহ

জীবদেহের বিপাকীয় প্রক্রিয়া-ঘটিত পবিবর্তন এবং বুদ্ধির কার্ষে সাহায্য করিবার জন্য কতকগুলি অন্তঃস্ৰাবী গ্ৰন্থি আছে। ইহাদের ভিতর হইতে যে রস নিৰ্গত হয় তাহার। ফলে বিপাকীয় পবিবর্তন ঘটে। এই সকল গ্রন্থির শিবার মধ্য দিয়া যখন রক্ত চলাচল করে, তখন উক্ত রস কোনও নালীর মধ্য দিয়া না নামিয়া সোজাসুজি রক্তের সহিত মিশিয়া যায়। এই সব গ্রন্থির নালী নাই। তাই ইহাদিগকে নির্ণালী গ্রন্থি (Ductkess Glands) বলে।

থাইরয়েড (Thyroid), প্যারাথাইরয়েড (Parathyroid), এ্যাড্রিনাল (Adrenal), পিটুইটারী (Pituitary) অণ্ডকোষদ্বয় (Testes), ডিম্বকোষদ্বয় (Ovaries) প্ৰধান অন্তঃস্ৰাবী গ্ৰন্থি। ১৭ নং চিত্রে নারীদের এইরূপ প্রধান কয়েকটি গ্ৰন্থি দেখানো হইয়াছে। পুরুষের মধ্যেও শেষোক্ত দুইটি ব্যতীত অপরগুলি আছে।



এই সকল নির্ণালী গ্রন্থি হইতে যে রস নির্গত হয়, তাহাকে বলা হয় হরমোন (Hornone)। হরমোন দেহের অঙ্গপ্ৰত্যঙ্গ-বিশেষকে উত্তেজিত এবং উদ্দীপিত করিয়া তাহাদের যথাযথভাবে কর্মক্ষম করে।

চিত্ৰে সকলের উপরে দেখানো পিনিয়েল গ্ৰন্থিটি মস্তিষ্কের সঙ্গে সংযুক্ত পিটুইটারীর উপরে পিছনে অবস্থিত। ইহার কাজ এ্যাড্রিান্তলের বিপরীত। ইহা যৌন অঙ্গসমূহের অকালের পরিপক্কতা নিবারণ করে। ওজনে ইহা এক আউন্সের দু’শ তিরিশ ভাগের এক ভাগ।

পিটুইটারী গ্ৰন্থি–মূত্র প্রবাহ এবং যৌনবোধ নিয়ন্ত্রিত করে। ইহা ওজনে এক আউন্সের ৬০ ভাগ। মানব দেহের উপর এই গ্ৰন্থির আশ্চৰ্য প্ৰভাব। ইহার কার্য অল্প মাত্রায় হইলে মানুষ খর্বকায় হয় এবং যৌনবোধ পুরা মাত্ৰায় জাগ্রত হয় না। আবার কিশোর অবস্থায় অতি মাত্রায় ইহার কাৰ্য চলিলে মানুষ অতি দীর্ঘকার হইয়া পড়ে। ইহা হইতে খুব অল্প মাত্রায় রস নিৰ্গত হইলে মানুষ নিদ্রাকাতর হয়। এই সব নির্দিষ্ট কাৰ্য ব্যতীত এই গ্ৰন্থির প্রভাব সাধারণভাবে অন্যান্য অন্তঃস্ৰাবী গ্ৰন্থির উপরও রহিয়াছে। এজন্য ইহাকে ‘Master Gland’ বা ‘Conductor of the Endocrine Orchestra’ বলা হয়।

পিটুইটারী গ্ৰন্থির প্রভাবে নারীদেহে প্ৰথম যৌবনের সূচনা লক্ষিত হয় এবং নারীত্বে অন্যান্য চিহ্ন ও বৈশিষ্ট্য আত্মপ্ৰকাশ করে। শিশু যখন মাতৃগর্ভে পূর্ণাঙ্গতা লাভ করে তখন এই পিটুইটারীর প্রভাবেই উহা ভূমিষ্ঠ হইবার পূর্বে জরায়ুর সঙ্কোচন এবং প্রসারণ আরম্ভ হয় এবং শিশু ভূমিষ্ঠ হয়। পিটুইটারীর কার্যকারিতা নানা কারণে হ্রাস পাইয়া গেলে মানবদেহ ও মনের অত্যন্ত ক্ষতি সাধিত হয়। পুরুষের দাড়ি ভালভাবে গজায় না, পুরুষ দেখিতে অনেকটা মেয়েলী ধরনের হয়, বুদ্ধি শক্তির বিকাশও তেমন হয় না। এই পিটুইটারী স্ত্রী ও পুরুষের সমস্ত যৌনযন্ত্রসমূহের গতি-সঞ্চালন ও কাৰ্য তৎপরকারক।

থাইরয়েড গ্ৰন্থি ওজনে প্ৰায় ২ আউন্সের মত। থাইরক্সিন নামক হরমোন নিঃসরণ করে এবং দেহ মধ্যে নানা সজীব উপাদানের রাসায়নিক পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ করে। কৃত্রিম উপায়ে থাইরক্সিন তৈরি করা চলে। প্যারাথাইরয়েড থাররয়েডেরই অতি সান্নিধ্যে। ইহারা কতকগুলি ক্ষুদ্র গ্রন্থির সমষ্টি। ইহারা প্যারাথরমোন (Parathormone) নামক হরমোন উৎপাদন করে ও রক্তের মধ্যের ক্যালসিয়াম বা চুনের নিয়ন্ত্রণ করে। ইহার একটু নীচে থাইমাস (Thymius) গ্ৰন্থি। ইহাকে “শৈশবকালীন গ্ৰন্থি” বলা হয়। কারণ পরবর্তী জীবনে ইহা ধীরে ধীরে অন্তর্হিত হইয়া যায়।

ছবিতে পরবর্তী প্যানক্রিয়াস গ্ৰন্থি অন্তঃস্ৰাবী ও বহিঃস্ৰাবী দুই গ্ৰন্থিরই কাজ করে। ইনসুলিন (Insulin) নামক হরমোন, যাহা ইদানীং সফলতার সহিত বহুমূত্র রোগের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হইতেছে, তাহা এই প্যানক্রিয়ালে নিহিত কতকগুলি সুক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ম জীবকোষের দ্বারা সৃষ্টি।

এ্যাড্রেন্যল গ্ৰন্থি মূত্রাশয়ের উপরে অবস্থিত। ইহা হইতে এ্যাড্রিান্তলিন নামক হরমোন নিঃসৃত হইয়া স্নায়ুমণ্ডলীকে উদ্দীপ্ত করে। উহাকে “উচ্ছ্বাস গ্ৰন্থি’ও বলা হয়। কারণ সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীর ভাবোচ্ছাস ও যৌন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যখনই আমাদের শারীরিক ভারসাম্য ভয়, ক্রোধ ও বেদনার প্রভাবে পর্যুদস্ত হয়, তবে বুঝিতে হইবে যে আমাদের রক্তে ইহা বেশী পরিমাণে প্ৰবিষ্ট হইয়াছে। নারী-দেহ অভ্যন্তরে নারীত্বেব প্ৰধান চিহ্ন তাহার ডিম্বকোষ। ইষ্ট্রিন (Oestrin, or Estrim) বা এষ্ট্রোজেন (Estrogoen) নামক ইহার হরমোনের কাৰ্যক্ষমতার দরুনই নারীদেহে নারীসুলভ বৈশিষ্ট্য প্রকট হইয়া উঠে। যৌবনের ভরা জোয়ার নারীর দেহমানকে আলোড়িত এবং সচকিত করিয়া তোলে। অস্ত্রোপচার দ্বারা ডিম্বকোষ বাদ দিয়া দেখা গিয়াছে তাহার ফলে পেটের মাংসপেশীসমূহ ও ভাগ শুকাইয়া যায়, কখনও কখনও মাসিক ঋতুস্রাব বন্ধ হইয়া যায় এবং নারী গর্ভধারণের সম্পূর্ণ অনুপযোগী, মোটা ও কতকটা পুরুষালী হইয়া পড়ে।

ডিম্বকোষের প্ৰধান কাজ হইল ইহার মধ্যস্থ অসংখ্য ডিম্বাণুদের মধ্যে প্ৰায় প্ৰতি মাসে একটিকে বিকশিত করিয়া তোলা। ইহা ছাড়া, ইহার অন্তৰ্গত ডিম্বাণুগুলির প্রত্যেকটি যে খাপের (তাহাদের আবিষ্কারক গ্রাফের নামধারী গ্রাফিয়ান ফলিক্স–Graffian follicle-এর) মধ্যে থাকে সেই ফলিক্স ইষ্ট্রিন (oestrin) নামক হরমোহন ক্ষরিত করে। তাই ইহাকে ফলিকিউল্যর হরমোনও বলে। ইহা হইতে এষ্ট্রোজিন (Eastrogen) নামক স্ত্রী হরমোহন প্ৰস্তুত হয়। ইহা জননেন্দ্ৰিয় ও লিঙ্গ-নির্দেশক গৌণ অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বিকাশ নিয়ন্ত্রিত করিয়া থাকে। নাবালক প্রাণীর ডিম্বকোষ তাহার উদর কাটিয়া বাহির করিয়া দিলে জননেন্দ্রিয়গুলি সচরাচর বিকাশ লাভ করে না, স্তনগুলি ছোট থাকিয়া যায় এবং চেহারা উভলিঙ্গের মত থাকে। প্ৰায় সকল রকম প্ৰাণীর সম্বন্ধেই ইহা প্রয়োজ্য। উক্ত ফলিঙ্ক হইতে ডিম্বানু নির্গত হইয়া ডিম্ববাহীনলে প্রবেশ করার পর ফলিক্সটি শুকাইতে থাকে ও তাহার মধ্যে একটি পীতবর্ণ বস্তু কর্প্যস লুটিয়্যম (Corpus Luteum—এই ল্যাটিন শব্দেরও অর্থ পীতবর্ণ শরীর) প্রস্তুত হয়। গর্ভাধান না হইলে ইহা শুকাইয়া যায়, হইলে ইহা আবার প্রজেষ্টেরন (Progresterome) নামক হরমোন ক্ষরণ করে। ইহার ক্রিয়া-ফলে গর্ভাবস্থায় ডিম্বস্ফোটন ও (তাজনিত) ঋতুস্রাব বন্ধ থাকে এবং গর্ভরক্ষা হয়। যদি গৰ্ভকালে উক্ত পীত বস্তু নষ্ট করা হয় তাহা হইলে ভ্রূণ মরিয়া যায়।

চিত্ৰে সকলের শেষে প্ল্যাসেণ্টা বা গর্ভ ফুলের অবস্থান। গৰ্ভ ধারণ কালে ইহা জরায়ুতে বিকাশ লাভ করিয়া ভ্রূণ ও মাযেব মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে। সন্তান ভূমিষ্ঠ হইবার পারে জরায়ু হইয়া ইহা বাহির হইয়া আসে বলিয়া ইহাকে Afterbirth বলা হয়। ইহা কয়েক প্ৰকারের হরমোন উৎপন্ন করে।

পুরুষের গ্রন্থিসমূহের সাথে স্ত্রীলোকের গ্রন্থিগুলির পাৰ্থক্য এই যে পুরুষের বেলায় উপরে বর্ণিত স্ত্রী লোকের গ্রন্থিসমূহের মধ্যে ডিম্বকোষ ও প্ল্যাসেণ্ট ছাড়া সবই এক রকমের এবং স্ত্রীলোকের ডিম্বকোষের অনুরূপ রহিয়াছে অণ্ডকোষ।

পুরুষের অণ্ডকোষ হইতে নিঃসৃত রস টেষ্ট্রোষ্টেরন (Testosterone) হরমোন নামক দেহের রক্তধারার সঙ্গে মিশ্রিত হইয়া পুরুষের দেহে ও মনে পৌরুষের সঞ্চার করে। অণ্ডকোষের ভিতরে অসংখ্য শুক্রকীট সৃষ্ট হয় এবং ইহা হইতে উক্ত হরমোন নিঃসৃত হয়। ইহার ফলেই লিঙ্গ-নির্দেশক গৌণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পবিস্কুটন হইয়া থাকে। যৌনবোধ জাগ্রত হইবার পূর্বে অস্ত্রোপচার দ্বারা বালকের অণ্ডকোষ বাদ দিয়া দেখা গিয়াছে যে, যৌবনেও প্ৰজনন অঙ্গসমূহ ও যৌনবোধ যথাযথভাবে পরিস্ফুট ও তেমন ক্ষমতাশালী হয় না, যৌনকেশ ও দাড়িগোফ দেখা দেয় না-মেয়েদের মতন পাতলা গঠন, গলার স্বর এবং ভাবভঙ্গী হয়। যৌনগ্ৰন্থি নিষ্কাশিত করিলে, নরনারীর শরীর ও মন তাহাদের বিশেষত্ব, সাহস ও শক্তিহীন হইয়া পড়ে।

মোরগের অণ্ডকোষ কাটিয়া ফেলিলে সে আর মুরগীর পিছনে ধাওয়া করে না, উচ্চৈঃস্বরে ডাকে না, উহার মাথার মুকুট ক্ষুদ্রতর, বিকৃত ও বিশ্ৰী হইয়া যায়। পাঠাকেও “খাসী’’ করার পর এরূপ ভাবান্তর ঘটে।

লেখকের মস্ত বড় একটা ঘোড়া ছিল। ইহাকে যখন কেনা হইয়াছিল তখন ইহার বয়স খুব কম ছিল, তখন মস্ত বড় আকারের হইলেও মাদী ঘোড়ার দিকে সে মোটেই আকৃষ্ট হইত না। তখনও যৌন-আকর্ষণের প্রভাব ইহার উপর পড়ে নাই। কিছুদিন পর হইতেই ইহার মধ্যে যৌন-চাঞ্চল্য দেখা দিল। তখন মাদী ঘোড়ার পিছনে ধাওয়া করিবার অদম্য প্ৰবৃত্তি দেখিয়া ইহার অণ্ডকোষ ছেদনের ব্যবস্থা করা হইল। পশু-ডাক্তারেরা ইহার অণ্ডকোষ দুইটি না কাটিয়া ফেলিয়া শুধু বাহির হইতে সাড়াশী দিয়া চাপিয়া অণ্ডকোষ হইতে যে সকল শিরা-উপশিরা উপরের দিকে গিয়াছে তাহা পিষ্ট করিয়া দিলেন। ইহাতে অণ্ডকোষের অন্তস্ৰাবী রস-স্খলনের ব্যাঘাত ঘটিল এবং ঐ রসের চলাচল বন্ধ হইল। ঘোড়াটি ইহার পর আর মাদী ঘোড়ার দিকে আকর্ষণ বোধ করিত না। শরীর ও স্বাস্থ্য অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও যৌনহরমোনের অভাব ঘটায় তাহার পুরুষোচিত যৌনাকাঙ্ক্ষা লুপ্ত হইয়া গেল। অপর জন্তুদের সম্বন্ধেও এই কথা থাটে।

নবনারীর যৌনবোধ যে তাহাদের শুধু যৌন-অঙ্গসমূহেই সীমাবদ্ধ নহে, উহা যে তাহার সারাদেহ ব্যাপ্ত হইয়া থাকে, তাহার কারণ এই সকল অন্তঃস্রাবী গ্ৰন্থিব প্রভাব। এই সকল গ্ৰন্থির কার্যপ্ৰণালী ও প্রভাব সম্বন্ধে শবীরতত্ত্ববিদদেব গবেষণার পূর্বে লোকের কোন সুস্পষ্ট ধারণা ছিল না। অধুনা এ সম্বন্ধে বহু অনুসন্ধান ও গবেষণা চলিতেছে।

—————–
(1)  এই বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা আমি আমার ইংরেজী পুস্তক All about Sex, Love and Happy Marriage পুস্তকে করিয়াছি।
(2)  “No man should marry before he has studied anatomy or dissected the body of a woman.”-Balzac.
(3) কাহারও আবার সতীচ্ছদে কোন ছিদ্র থাকে না (Imperforate Hymen). সেক্ষেত্রে ঋতুস্রাবের রক্ত বাহিরে আসিতে পারে না। ডাক্তারের সাহায্যে উহার অস্ত্ৰোপচার করাইয়া লইতে হয়।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2