১.০৬ যৌনবোধের স্বরূপ : দেহের সহিত সম্বন্ধ যৌনবোধ কাহাকে বলে

যৌনবোধের স্বরূপ : দেহের সহিত সম্বন্ধ যৌনবোধ কাহাকে বলে
প্রথম খণ্ড – ষষ্ঠ অধ্যায়

যৌনবোধেব সূক্ষ্ম সংজ্ঞা দেওয়া সম্ভবপর নহে। বিভিন্ন যৌনবিজ্ঞানী বিভিন্ন ভাবে যৌনবোধের ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছেন। প্রাগ (Prague) বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ডাঃ কিশ বলিয়াছেন যে, নারী ও পুরুষ পরস্পরের সহিত ঘনিষ্ঠতরভাবে দৈহিক মিলনের যে বাসনা অনুভব করে, তাহার নাম যৌনবোধ। শৈশবে এই বোধ নিদ্রিত থাকে, বয়ো বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে উহা স্ফূরিত হইয়া যৌবনে পূর্ণজাগ্রত এবং বার্ধক্যে হ্রাসপ্ৰাপ্ত হয়।

অধ্যাপক কিশের এই ব্যাখ্যা মোটামুটি গ্রহণযোগ্য হইলেও উহার সামান্য ত্রুটি এই যে, এই ব্যাখ্যায় মানুষের যৌনবাসনাকে অনাবশ্যকরূপে সঙ্কুচিত করা হইয়াছে। কারণ নারীপুরুষ যে কেবল বিপরীত লিঙ্গের প্রতিই আকর্ষণ বোধ করে তাহা সত্য নহে, সমলিঙ্গ ব্যক্তির প্রতিও মানুষের যে যৌন-আকর্ষণ তাহাকে অন্যমুখী (deviation), বিকল্প (Substitution), অথবা বিকৃতি (perversion) আখ্যা দিলেও উহা যে যৌনবোধেব অন্তৰ্গত, এ কথা অস্বীকার করিবার উপায় নাই।

যৌনবোধ একটি স্বাভাবিক বৃত্তি

প্ৰাণীজগতে যৌনবোধ একটি সহজাত বৃত্তি। সহজাত বৃত্তি বলিতে আমরা কি বুঝি? মাকড়সা জাল বুনে, পাখী বাসা নির্মাণ করে, মৌমাছি মৌচাক গড়ে-এইগুলি উহাদের সহজাত বৃত্তি। যে স্বাভাবিক প্রবণতার বশবর্তী হইয়া প্রাণীরা কোন এক সুনির্দিষ্ট প্ৰণালীতে বংশপরম্পরায় কোন কাৰ্য সমাধা করিতে উদ্বুদ্ধ হয়, তাহাকেই মোটামুটি সহজাত বৃত্তি বলা যায়।

প্রাণীর সহজাত বৃত্তির লক্ষণ : () একইরূপ কাৰ্যকলাপ; () সেই শ্রেণীর সব প্রাণীরই ঐ রূপ কাৰ্যকলাপে উদ্বুদ্ধ হওয়া; () অন্যের বিনা পরামর্শে বা শিক্ষায় আপনা হইতেই ঐ রূপ কাৰ্যকলাপের ক্ষমতা ও প্রবণতা থাকা।

মাকড়সা একটা বয়সের সীমানা উপনীত হইলেই জাল বুনিতে থাকিবে। এই জাল বুনিতে তাহার পূর্বশিক্ষার কোন প্রয়োজন নাই। অন্য মাকড়সা সাধারণত: যেরূপ জাল বুনিয়া থাকে, এই মাকড়সাটিও তেমনই করিবে।

ইনকিউবেটরে কৃত্রিম তাপ দিয়া ডিম ফুটানো হইলেও ডিম হইতে ছানা বাহির হইয়াই, যে জাতীয় ডিম সেইরূপ—হাঁসের ডিম হইলে হাঁসের মত, মুরগীর ডিম হইলে মোরগ-মুরগীর মতই-ব্যবহার করিতে থাকে।

অভ্যাস এবং বৃত্তির মধ্যে পার্থক্য এই যে, অভ্যাসের বেলায় ব্যক্তিবিশেষ বা কতিপয় ব্যক্তি কোন বিশেষ অভ্যাসের দাস হইতে পারে, বৃত্তির বেলায় এক জাতির সমস্ত প্ৰাণীর বংশানুক্রমে একইরূপে বোধ করে বা কাজ করে। যৌনবোধও প্ৰাণীজগতে অন্যান্য সহজাত বৃত্তির মত একটি বৃত্তি। ইনকিউবেটবে ফুটানো ডিম্বপ্রসূত একটি মোরগ ও মুরগীকে, একেবারে পৃথক রাখিয়া পালন করিলেও, যথাসময়ে উহারা এই বুত্তির তাড়নায়, যৌনমিলনে ব্ৰতী হইবে, ইহা দেখা যায়।

তেমনই মানুষেরাও যৌনবোধ সহজাত বলিয়া, অন্যের বিনা ইঙ্গিতে বা অজানা অচেনা সত্ত্বেও নর ও নারী পরস্পরের প্রতি আপনা হইতেই যৌনআকর্ষণ অনুভব করিবে এবং বাধাপ্ৰাপ্ত না হইলে পরস্পর দৈহিক মিলনেও ব্ৰতী হইবে।(1) তবে পার্থক্য এই যে, উচ্চশ্রেণীর প্ৰাণী (বানর ও মানুষ্য) যৌন-আকর্ষণ অনুভব করিলেও সহসাই সন্তোষজনকভাবে দৈহিক মিলনে সমর্থ হইবে না–পরস্পরের আগ্রহে ও চেষ্টায় অবশেষে মিলনের প্রকৃত পদ্ধতি হয়ত আবিষ্কার করিয়া ফেলিবে। অথচ নিম্নশ্রেণীর প্রাণী সহজেই ঐ প্রক্রিয়া সম্পাদনা করিয়া ফেলিবে। আবার, মনুষ্য সাধারণতঃ অন্য প্ৰাণীর বা অন্য লোকের মৈথুনক্ৰিয়া দেখিয়া বা অন্যের মুখে শুনিয়া বা পুস্তক পড়িয়া প্ৰকৃত রতিক্রিয়ার পদ্ধতি শিক্ষা করে।

দেহের সহিত যৌনবোধের সম্বন্ধ

মানুষের মধ্যে এই বৃত্তিটি ক্ষুৎ-পিপাসার মতই শক্তিশালী। কর্ষণ ও অভ্যাসের দ্বারা অন্যান্য বৃত্তির ন্যায়। এই বৃত্তিটিকেই কথঞ্চিৎ নিয়ন্ত্রিত করা সম্ভব হইলেও সে নিয়ন্ত্রণ দেহ-নিরপেক্ষ হইতে পারে না। কথাটা আরও পরিষ্কার করিয়া বলা যাইক।

ক্ৰোধ, লোক্ত ও মোহ, কামের মতই ঐত্তি বটে, কিন্তু কামবৃত্তি আমাদের দেহের উপর যতটা ক্রিয়া করে, ক্রোধ, লোভ বা মোহ ততটা করে না। এক ব্যক্তি ঘন ঘন রাগ করিলে বা লোভ করিলে তদ্বারা তাহার শরীরের উপর যতটা ক্রিয়া হইবে, একজন ঘন ঘন কামোত্তেজিত হইলে, অথবা কামবৃত্তি চরিতার্থ করিলে, তদ্বারা তাহার শরীরের উপর  তাহা অপেক্ষা অনেক বেশী ক্রিয়া হইবে। কারণ, মানুষের যৌনবৃত্তি চরিতার্থ হয় প্রধাণত যৌন-অঙ্গ সমূহের দ্বারা এবং প্রকারান্তরে প্রায় সারা দেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, রক্ত-চলাচল, স্নায়ুমণ্ডল ইত্যাদির উপরে উহার প্ৰতিক্রিয়া হয়।

যৌনপ্রদেশসমূহ

যৌনবোধ দেহের দিক দিয়া প্ৰধানত স্বায়ুর সহিত সম্বন্ধযুক্ত। মানুষেরা দেহে স্বায়ুপ্রধান যে সমস্ত স্থান আছে, সেখানে যৌন অনুভূতি আতিশয় প্ৰবল। এই সমস্ত স্থান যৌনবোধেব সহিত এমন ঘনিষ্ঠভাবে সম্বন্ধযুক্ত যে, ইহাদিগকে যৌনস্থান বা কামাঞ্চল বলা যাইতে পারে। এই সমস্ত স্থানের স্বায়ুসমূহ যৌনবোধে বা সঠিত অতিশয় ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত। মানুষের মনে কোন ও কারণে যৌনবাসনার ক্ষুরণ হইলে প্ৰাথমিক যৌনপ্রদেশসমূহে উক্ত অনুভূতিব লক্ষণ প্রকাশ হয়, আবার ঐ সকল স্থানেই স্পর্শ বা ঘর্ষণের দ্বারাও যৌন-অনুভূতির সৃষ্টি হয়। গুরুত্ব হিসাবে যৌনপ্রদেশসমূহের সংক্ষিপ্ত পরিচয় নিয়ে দেওয়া গেল :–

স্ত্রীলোকের—() ভগাঙ্কুর () ক্ষুদ্রোষ্ঠ () ভেষ্টিবিউল(2) () বৃহদোষ্ঠ () স্তন, বিশেষত স্তনের বোঁটা () যোনির উপর দিকের দেয়াল () উরুদেশ () নিতম্ব (a) গুহ্যদ্বার (১০) ঠোঁট (১১) গাল।

পুরুষেরা-–() শিশ্ন মুণ্ড () বাকি লিঙ্গ () অণ্ডকোষ () বস্তিপ্রদেশ () স্তনের বোঁটা () উরুদেশ () নিতম্ব () গুহ্যদ্বার () ঠোঁট (১০) গাল।

এই সকল স্থানের প্ৰভাব-ভেদ আমরা ২য় খণ্ডের ‘মিলনের বিভিন্ন স্তর’ অধ্যায়ের প্রথম কয়েক অনুচ্ছেদে আলোচনা করিয়াছি।

ইহা ছাড়া স্থান কাল ও পাত্র ভেদে মানুষের শরীরের প্রায় সর্বত্রই যৌনবোধ সৃষ্টি করা যায়। বিশেষত, দেহের যে যে স্থানে চর্ম ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লী সম্বিলিত হইয়াছে, সেই সমস্ত স্থানেই যৌনবোধ অল্পবিস্তর বিদ্যমান আছে- তবে উপরে যে সমস্ত স্থানের নাম করা গেল সেই সমস্তের সহিত যৌনবোধের বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান রহিয়াছে। ঐ সমস্ত স্থান নিজের অথবা অপরের হস্ত দ্বারা, বিশেষত বিপরীত-লিঙ্গের হস্ত, জিহ্বা, ওষ্ঠ বা অনুরূপ অঙ্গ দ্বারা ঘর্ষিত বা স্পর্শিত হইলে সুখানুভূতি ও যৌনবৃত্তি জাগ্রত হয়। আবার অপরের ঐ সব অঙ্গের সেবা করিলেও নিজের কাম জাগ্রত হয়।

মিলনে যৌনপ্রদেশের ক্রিয়া

সেইজন্য মিলনের সময় স্ত্রী-পুরুষের পরস্পরের ঐ সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গের নানাপ্রকার সংযোগ চিরকাল মানুষের মধ্যে প্ৰচলিত আছে। কেবল নিত্রিত কামাভাবকে জাগ্ৰত করিবার জন্যই যে ঐ সমস্ত যৌনপ্রদেশের ব্যবহার হইয়া থাকে তাহা ননে; স্বামী-স্ত্রীর আরদ্ধ ক্রিয়াকে অধিকতর সুখাদায়ক করিবার উদ্দেশ্যে এবং পরস্পরের প্রতি অধিকতর আগ্রহ সৃষ্টি করিবার জন্যও সমস্ত প্রদেশে সুড়সুড়ি, চুম্বন ও মর্দন অথবা চোষণ, লেহন প্রভৃতি প্রয়োজনীয় কাৰ্য বলিয়া চিরকাল স্বীকৃত হইয়া আসিতেছে।(3) ঐ সমস্ত অঙ্গের কোন কোনটা এত তীব্র অনুভূতিশীল যে, মানুষ নিজে নিজেও ঐ সমস্ত স্থানে যৌন অনুভব করিতে পারে। হস্তমৈথুন, উরুমৈথুন প্রভৃতি মানুষ যৌনপ্রদেশের অনুভুতিশীলতার জন্যই করিয়া থাকে।

ব্যক্তিভেদে যৌনপ্রদেশের অনুভূতিশীলতার ব্যতিক্রম

বলা বাহুল্য, ব্যক্তিভেদে উপরোক্ত স্থানসমূহের অনুভূতিশীলতার ব্যতিক্রম হইয়া থাকে। পুস্তকপাঠে এই সমস্ত ব্যক্তিগত ব্যতিক্ৰম ধরিবার কোনও সাধারণ সুত্ৰ জানিবার উপায় নাই। স্বামী-স্ত্রী অথবা প্রেমিক-প্ৰেমিক নিজ নিজ অভিজ্ঞতা হইতে পরস্পরের যৌনপ্রদেশসমূহের অনুভূতিশীলতার আবিষ্কার এবং সঙ্গমের পূর্বে ও সঙ্গমের সময়ে ঐ সমস্ত প্রদেশের সম্যক ব্যবহার করিতে পাৱেন, অন্যথায় যৌনসন্মিলন বিশেষ সুখের হয় না।

যৌনবোধ ও পঞ্চেন্দ্ৰিয়

মানুষ তাহার যৌনপ্রদেশসমূহের অনুভূতি ইন্দ্রিয়সমূহের ভিতর দিয়াই করিয়া থাকে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যাইতে পাৱে যে, পুরুষ চক্ষু দ্বারা কোনও সুন্দরী রমণীর সুগঠিত দেহ দর্শন করিলে বা হস্তদ্বারা স্পর্শ করিলে তাহার যৌনপ্রদেশসমূহে অনুভূতি জাগ্রত হয়। মানুষ পঞ্চবিধ জ্ঞানেক্রিয়গুলির সকলেরই সাহায্যে যৌন-অনুভূতি লাভ করিয়া থাকে। যথা—চক্ষু দিয়া দর্শন, কৰ্ণ দিয়া শ্ৰবণ, জিহ্বা দ্বারা চোষণ, লেহন ও চুম্বন, নাসিকা দিয়া ব্ৰাণ এবং ত্বক দিয়া স্পর্শন।

যৌনবোধ ও দর্শনেন্দ্ৰিয়

আমরা দর্শনেন্দ্ৰিয়ের কথাই সর্বাগ্রে বলিব। প্ৰথমেই বলিয়া রাখা ভাল যে, এখানে মনশ্চক্ষুকেও আমরা চক্ষুর অন্তৰ্গত ধরিয়া লইয়া আলোচনা করিব। কারণ, আমারা কল্পনাতেও অনেক রকম দর্শনক্রিয়া সম্পন্ন করিয়া থাকি।

মানুষের জ্ঞানবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দর্শনেন্দ্ৰিয়ের ক্রিয়া এত বাড়িয়া যাইতেছে যে, প্ৰকৃতপক্ষে চক্ষুই বর্তমানে আমাদের জ্ঞানাহরণের সর্বপ্ৰধান ইন্দ্ৰিয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। যৌনবৃত্তির দিক হইতেও চক্ষুই সর্বপ্রধান ইন্দ্ৰিয়। মানুষ তাহার মানসনেত্ৰেই তাহার চিরপুব্বাতন স্বপ্নময়ী ও স্বপ্নচারিণী রূপসী মানস-প্ৰতিমাব এবং কল্পলোকের সুন্দর নায়কের রূপ ধ্যান করিয়া আসিতেছে। ‘সুন্দর’ ও ‘সুন্দরী’, ‘রূপবান’ ও ‘রূপসী, প্ৰভৃতি প্রেমের পরিকল্পনাগুলি সমস্ত দৰ্শনসাপেক্ষ।

প্ৰধানত চক্ষুদ্বারাই আমাদের যৌনক্ষুধা জাগ্রত ও তৃপ্ত হইয়া থাকে। আমাদের কবিগণ ‘সুন্দরের’ যে কল্পনা করিয়া গিয়াছেন, তাহার সঙ্গে যৌনবোধ জড়িত ছিল কি না বলিতে পারি না; কিন্তু আমরা যদি নর বা নারীদর্শনে শিরায় একটা পুলকের ঝঙ্কার অনুভব করি তবে আমরা স্বীকার করি আর নাই করি, একথা সত্য যে অন্ততঃ বিপরীত লিঙ্গের সৌন্দর্যের উপলব্ধি ও তাহার প্রতি আকর্ষণের মধ্যে যৌনবোধ লুক্কায়িত আছেই আছে। কারণ, ‘সুন্দর’ কথাটা ব্যক্তিনিরপেক্ষ হইতে পারে না। আমার যাহাকে ভাল লাগে, সেই আমার নিকট সুন্দর। আমার এই ভাল লাগারও একটা মাপকাঠি আছে। সুতরাং সত্যকার ‘সুন্দর’ জিনিস এ জগতে খুব কমই আছে যাহার সঙ্গে যৌনবোধ জড়িত নাই।

মানবদেহে সৌন্দৰ্য উপলব্ধির অনেকখানিই যৌনবোধ, তাহার আর একটি প্রকৃষ্ট প্রমাণ এই যে, আমরা বিপরীত লিঙ্গের ব্যক্তির মধ্যেই সৌন্দর্যের আদর্শ খুঁজিয়া বেড়াই। পুরুষের কাছে নারীর সৌন্দর্যের আদর্শ এবং নারীর কাছে পুরুষই সৌন্দর্যের আকর। আবার পুরুষের কাছে নারীদেহের মধ্যে তাহার যৌনপ্রদেশসমূহই সৌন্দর্যের চরম নিদর্শন।

আদিকালে নারীপুরুষের সৌন্দর্য বিচার হইত তাহাদের যৌনপ্রদেশের সৌন্দর্য দিয়া। সেই জন্য পুরুষ ও নারী পরস্পরের নিকট লোভনীয় করিবার উদ্দেশ্যে নিজেদের যৌনপ্রদেশসমূহ কৃত্রিম উপায়ে দর্শনীয় করিয়া রাখিত। নৃতত্ত্ববিদেরা বলেন যে, আদিম যুগের বিবস্ত্র নরনারীরা প্রথমে কেবল মাত্র তাহাদের যৌনাঙ্গগুলি (তৃণ পত্ৰাদি দ্বারা) আচ্ছাদন করিতে আরম্ভ করে, লজ্জাবশতঃ নয়, বরং সেগুলির দিকে দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। বর্বর যুগে নারী ও পুরুষ যৌনবৃত্তি জাগ্রত ও পরিতৃপ্ত করিবার জন্য দলে দলে নৃত্য করিত এবং ঐ নৃত্যে সকলেই নিজ নিজ যৌনপ্রদেশসমূহে আড়ম্বর সহকারে প্রদর্শন করিত। নৃত্যের সময় এখনও বস্ত্ৰপরিহিত আফ্রিকার নারীরা তাহাদের নিতম্বদেশ বিশেষভাবে সঞ্চালন ও ঘূর্ণন করে। ভারত প্ৰভৃতি দেশের আদিম অধিবাসীদের নৃত্যও এইরূপ হওয়া সম্ভব। এমনকি মধ্যযুগেও ইওরোপে উচ্চশ্রেণীর লোকেরা এমন কায়দায় পোষাক-পরিচ্ছদ ব্যবহার করিতেন, যাহাতে তাহাদের যৌন-অবয়বসমূহ বিপরীত লিঙ্গের লোকের আকর্ষণ করিতে পারে। পঞ্চাশ বৎসব পূর্বেও সেখানকার মেয়েরা কৃত্ৰিম উপায়ে বক্ষ ও নিতম্ব উচ্চ এবং কোমব সরু করিয়া বাহির হইতেন। প্রায় চল্লিশ বৎসর আগেও বাঙালী মেয়েদের মধ্যে পাছাপাড় শাড়ী এবং নিতম্বের উপর গোট, চন্দ্রহার প্রভৃতি অলঙ্কার ব্যবহৃত হইত। আধুনিক উচ্চশ্রেণীর বাঙালী মহিলাদের মধ্যে বক্ষ উন্নতকারী আঁটসাট বডিস, কঁচুলী বা ব্রেসিয়ার ব্যবহার (বিশেষত বাড়ীর বাহিরে) ঐ উদ্দেশ্যেই করা হয়। অনেকে সযত্ন অবহেলায়, দক্ষিণ দিকের অঞ্চল সরাইয়া সৌন্দর্যের মন্দির উন্মুক্ত রাখেন। কেহ কেহ উভয় দিকেরই। পৃথিবীর কোনও কোনও স্থানে এখনও পর্যন্ত স্ত্রীলোকেরা কৃত্রিম উপায়ে তাহাদের যৌন-প্ৰদেশ বৃহত্তর করতঃ রাস্তায় ভ্ৰমণ ও নৃত্যাদি করিয়া পুরুষের মন আকর্ষণ করিয়া থাকে। জাপানে আজিও যৌনসন্মিলনের যে সমস্ত চিত্র মুদ্রিত ও প্রচারিত হইয়া থাকে, তাহা তে স্ত্রীপুরুষের যৌন অঙ্গসমূহকে অস্বাভাবিকরূপে প্ৰাধান্য দেওয়া হইয়া থাকে। এইভাবে প্ৰাধান্য দিতে দিতে এবং সৃষ্টির সহায় ও প্রতীকরূপে লিঙ্গকে দেবতার শ্রেণীতে উন্নীত করা হইয়াছিল। লিঙ্গপূজা পৃথিবীর অনেক জাতির মধ্যে প্রচলিত ছিল। হিন্দু ও রোমীয়দের মধ্যে আজিও লিঙ্গপূজা বিদ্যমান।

শালীনতাবোধের ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ যৌনঅঙ্গকে প্রাধান্য দেওয়া হইতে বিরত হইতেছে। কতকটা বাধ্য হইয়াও মানুষকে ইহা করিতে হইয়াছে। কারণ, প্ৰাথমিক যৌনপ্রদেশসমূহ (অর্থাৎ পুরুষের লিঙ্গ ও স্ত্রীলোকের যোনি) আতিশয় কোমল অঙ্গ। সৌন্দৰ্যবৃদ্ধির জন্য এই সমস্ত অঙ্গ প্ৰদৰ্শন করিয়া বেড়াইলে উহারা প্ৰয়োজনারূপে সুরক্ষিত থাকিতে পারে না। সমস্ত কোমল অঙ্গ সুরক্ষিত রাখিতে হইলে আররণ অপরিহার্য। এইজন্য এবং শালীনতার জন্যও মানুষ প্রাথমিক যৌনপ্রদেশসমূহ আর আগেকার মত প্ৰদৰ্শন করিয়া বেড়ায় না।

কিন্তু মানুষের চক্ষুর ক্ষুধা মিটাইবার, তথা কামতৃপ্তি চরিতার্থের উপকরণ চাই। তাই বাজারে পুলিসের সতর্ক চক্ষুকেও ফাঁকি দিয়া হাজার হাজার অশ্লীল ছবি বিক্রয় হইতেছে। ইন্দ্ৰিয়ভোগে যাহারা সতত লিপ্ত ও তৃপ্ত তাহারাও এই সমস্ত ফটো দর্শন করিতে ভালবাসে এবং দর্শন করিয়া কল্পনায়  সুখ অনুভব করিয়া থাকে। ইহার কারণ এই যে নিজের আঙ্গিক মিলন মানব সম্পূর্ণভাবে দেখিতে পায় না এবং অপরের দেখার সুযোগ অতীব বিরল। কিন্তু ছবিতেও মানুষ তৃপ্ত হইতে পারে না। গৃহকোণে নির্জনে চক্ষুর ক্ষুন্নিবৃত্তি শত হইলেও আংশিক তৃপ্তি মাত্র। সেইজন্য মানুষ শালীনতার মুখ রক্ষা করিয়া প্রাথমিক যৌন-অঙ্গসমূহ পরিত্যাগ করতঃ দ্বিতীয় শ্রেণীর যৌন-অঙ্গসমূহকে প্রাধান্য দিতে লাগিল। দ্বিতীয় শ্রেণীর যৌন-অঙ্গের মধ্যে স্ত্রীলোকের নিতম্ব ও স্তনই প্ৰধান, এতদ্ব্যতীত পুরুষের শ্মশ্র-গুল্ক ও স্ত্রীলোকের কেশও অপর পক্ষের যৌনবোধ জাগ্রত ও তৃপ্ত করিয়া থাকে।

ইউরোপ, আফ্রিকা ও এশিযার আৰ্য, সেমেটিক ও অন্যান্য সকল জাতির মধ্যেই স্ত্রীলোকের প্রশস্ত নিতম্ব সৌন্দর্যের লক্ষণ বলিয়া গৃহীত হইয়া আসিতেছে। নিতম্ব দুলাইয়া পুরুষের মন আকর্ষণ করিয়া গজেন্দ্ৰ গমনে চলিতে পারা নারীর একটা বিশেষ গুণ বলিয়া বিভিন্ন জাতির কবিতায় স্থান পাইয়াছে। আমাদের দেশে মনোরম চন্দ্রহার ও বিছাহার প্রভৃতি অলঙ্কার ও পাছাপাড় শাড়ী দ্বারা নিতম্বকে লোভনীয় করার প্রথা আজিও গ্রামাঞ্চলে, ও নিম্নশ্রেণীর মধ্যে শহরেও, বিদ্যমান আছে। ইউরোপীয় সুসভ্যজাতিসমূহের মধ্যেও আঁটা ফ্রক পরিধান করিয়া সুঠিত নিতম্বকে ফুটাইয়া তোলা নারীজাতির সৌন্দৰ্যবিকাশের অন্যতম উপায় দাঁড়াইয়াছে।

নিতম্বের পরেই স্ত্ৰীজাতির স্তনের স্থান।, যৌনতৃপ্তির উপকরণ হিসাবে স্তনকে নিতম্বের উপরে স্থান দিতে হয়। কিন্তু স্তনের দোষ এই যে, ইহার আয়ু অতি ক্ষণস্থায়ী। নারীর অন্যান্য অঙ্গে যখন ভরা যৌবন থাকে, তখনই তাহার স্তনে বাৰ্থক্য আসিয়া উপস্থিত হয়। সাধারণতঃ নারীর স্তন যৌবনের প্রারম্ভে ৫-৬ বৎসরের অধিক সুগঠিত, দৃঢ়, সুগোল ও উন্নত থাকে না। তাই, নারী-সৌন্দৰ্য-বিবেচকেরা স্তনকে নিতম্বের নিম্নে স্থান দিয়াছেন।

সমস্ত জাতির সাহিত্যই নারীর স্তনের অশেষ গুণকীর্তন করিয়াছে। সিক্তবসনা নারীর স্তনের স্তুতিগানে বাঙলার কবিরা অসংখ্য কবিতা রচনা করিয়া গিয়াছেন। ইউরোপীয় নারীরা ‘টাইট্‌ব্ৰেষ্ট’ প্ৰভৃতি কৃত্রিম উপকরণ অবলম্বনে উন্নত স্তন অধ্যাবৃত রাখাকে সৌন্দর্যের নিদর্শন মনে করিয়া থাকেন। পুরুষের দাড়ি-গোঁফ ও স্ত্রীলোকের কেশও সৌন্দর্যের নিদর্শন। সভ্যতার ক্ৰমবিকাশের সঙ্গে এই সমস্তের আদর ও কদর অনেক কমিয়া গিয়াছে। কিন্তু পূর্বকালে সমস্ত সভাজাতির মধ্যেই ইহা খুব ছিল। ভারতবর্ষে এবং প্ৰায় সমস্ত প্ৰাচ্য ও পাশ্চাত্য দেশগুলিতে স্ত্ৰীজাতির কেশের মূল্য কিন্তু আজিও কমে নাই। হ্যাভলক এলিসের মতে দেশ ও কাল ভেদে কেশের প্রতি নারীপুরুষের আকর্ষণেব তীব্রতাভেদ পবিলক্ষিত হইয়া থাকে।

সুতরাং দেখা যাইতেছে যে, আমাদের দর্শনেন্দ্ৰিয়েব ভিতর দিয়া আমাদের যৌনবোধ অনেকখানি জাগ্রত ও তৃপ্ত হয়। আমাদের অধিকাংশ সৌন্দৰ্যবোধের অন্তরালে যৌনবোধ লুক্কাইত বহিয়াছে। আমাদের চক্ষুর যৌনক্ষুধার নিবৃত্তির জন্যই ভাস্কৰ্য চিত্রবিদ্যা ও সিনেমা প্ৰভৃতি আবিষ্কৃত হইয়াছে।

যৌনবোধ ও শ্রবণেন্দ্ৰিয়

মিলনে শ্রবণেন্দ্ৰিয়ের স্থানও যে নগণ্য নহে তাহার প্ৰমাণ এই যে, সঙ্গীত যৌন বৃত্তির জাগরণ ও বুদ্ধির সাহিত ঘনিষ্ঠভাবে সংশ্লিষ্ট। একথা প্ৰায় অধিকাংশ বিজ্ঞানবিদই স্বীকার করিয়াছেন যে, মানুষের যৌনবোধের অনেকখানিই শ্রবণেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে জাগ্রত হয়।

সঙ্গীত যে সাধারণভাবে আমাদের মনোবৃত্তির উপর বিশেষ-ক্রিয়াশীল, সে কথা এক রকম বিনাপ্রতিবাদে গ্রহণ করা। যাইতে পারে। কিন্তু প্রিয়জনের নিতান্ত সাধারণ, অসংলগ্ন বা অর্থহীন কথাবার্তাও আমাদের মনকে স্পর্শ করে, নাড়া দেয় ও আমাদের আনন্দ বর্ধন করে। সঙ্গীত ব্যতীত বক্তৃতা, উচ্ছ্বাস, দীর্ঘনিঃশ্বাস, এমন কি গালাগালি আমাদের বিভিন্ন মনোবৃত্তির উপর কতখানি প্রভাব বিস্তার করিতে পারে, সে কথা অধিকাংশ পাঠকই নিজ নিজ অভিজ্ঞতা হইতে উপলব্ধি করিতে পারেন।

সুইডেনের ভাষাতত্ত্ববিদ স্প্যর্বার (Sperber) বলিয়াছেন যে প্রাণিজগতে দুইটি অভাব পূরণের জন্য ভাষা সৃষ্টি হইয়াছে : একটি—মায়ের নিকট সন্তানের ক্ষুধা নিবেদনের জন্য, অপরটি-প্ৰেমিকার নিকট প্রেমিকের যৌনক্ষুধা নিবেদনের জন্য। এ কথার মধ্যে কিঞ্চিৎ আতিশয্য থাকিতে পারে, কিন্তু উহার মধ্যে যে সত্য একেবারেই নাই, এ কথা কেহ বলিতে পারেন না। আমরা শুধু যে প্রিয়জনের কণ্ঠস্বর শুনিতে ভালবাসি, তাহাই নহে, প্রিয় জনেব মুখে প্ৰেমকথা, এমন কি যৌনবোধাত্মক কথা–যাহাকে সাধারণতঃ অশ্লীল কথা বলা হইয়া থাকে—তাহাও শুনিতে ভালবাসি। যৌনবোধ শ্ৰবণেন্দ্ৰিয়েব সাহায্যে এতটা তৃপ্তি চায় যে, প্ৰিয়জন ছাড়া অপর লোকের মুখেও অশ্লীল কথা ও গীত শুনিতে আনন্দ বোধ করি। ফলতঃ যৌন-কাৰ্যাদি দর্শন-লালসা যেমন চক্ষুর একটা সাধারণ ক্ষুধা, সেইরূপ যৌন ভাবেব বাক্যাদি শ্রবণ-আকাঙ্ক্ষাও কর্ণের একটা সাধারণ ক্ষুধা।

তবে বিজ্ঞানীগণের অভিমত এই যে, শ্রবণেন্দ্ৰিয়ের ক্রিয়া পুরুষ অপেক্ষা নারীর উপরই বেশী। ইহার কারণ এই যে, যৌবনাগমে পুরুষের কণ্ঠস্বর হঠাৎ এমন পরিবর্তিত হয় যে, নারীর কৰ্ণে সে পরিবর্তন এক অপূর্ব সুধা ঢালিয়া দেয়। যৌবনাগমে নারীর কণ্ঠে উল্লেখযোগ্য কোনও পরিবর্তন আসে না। সেইজন্য নারীর কৰ্ণে পুরুষের কণ্ঠস্বর বিশেষ আনন্দদায়ক।

কানের ভিতর দিয়া মরমে পশিল গো, আকুল করিল মোর প্ৰাণ” —এটা শুধু নারীতেই সম্ভব। ইহার কারণ, হ্যাভলিক এলিসের ভাষায়—পুরুষের কণ্ঠে যতটা পৌরুষ আছে, নারীর কণ্ঠে ততটা নারীত্ব নাই। উহার অর্থ এই যৌবনাগমে পুরুষের কণ্ঠে যে পবিবর্তন আসে, নারীর কণ্ঠে সেরূপ আসে না।

যৌনবোধ ও ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়

এমন অনেক প্ৰাণী আছে, যাহাদের মধ্যে ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ই সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী ইন্দ্ৰিয়। তাহাদের এই ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ই অন্যান্য সকল ইন্দ্ৰিয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করিয়া থাকে। ঘ্রাণেন্দ্ৰিয় অপর জ্ঞানেন্দ্রিয়গুলির পূর্বেই জীবদেহে বিকশিত হইয়াছিল। মানুষের মধ্যেও ঘ্রাণেন্দ্রিয়ের স্থান নগণ্য নয়। ইহার কারণ এই যে, মস্তিষ্কের সহিত ঘ্রাণেন্দ্ৰিয় প্রত্যক্ষভাবে সম্বন্ধযুক্ত। আমাদের মনোবৃত্তি তথা শবীর উপর ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ের প্রভাব কতটুকু তাহা আমরা অতি সহজেই হৃদয়াঙ্গম করিতে পারি, সুগন্ধ হইতে আমাদের মানসিক প্ৰফুল্লতা এবং দুৰ্গন্ধ হইতে আমাদের মানসিক বিষন্নতা এবং এই উভয় হইতে আমাদের শারীরিক পরিবর্তন, ইত্যাদি হইতে আমরা শরীর ও মনের উপর ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ের প্ৰভাবেব গভীরতা উপলব্ধি করিতে পারি। মন ও শরীরের উপর ঘ্রাণশক্তির এই প্ৰভাব বশতঃই আমাদের যৌনবোধের উপর উহার প্রভাব অতি সহজ হইয়াছে। ঘ্রাণশক্তি দ্বারা যৌনবোধকে প্রভাবান্বিত করা প্ৰকৃতির সুনির্দিষ্ট অভিপ্ৰায়। গ্রীসদেশের হিপোক্রেটিস (Hippocratis) এবং মনিন (Monin) ও ভেঞ্চুরীর (Venturi) অভিমত এই যে, মানুষের ঘ্রাণশক্তি, তাহার শরীরের গন্ধ বিভিন্ন বয়সে বিভিন্ন রকম হইয়া থাকে; এবং মানুষের যৌনবোপ ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে বিপবীত লিঙ্গের যৌনশক্তির সন্ধান পাইয়া থাকে।

এই সমস্ত মতবাদের মধ্যে আতিশয়োক্তি বা সংকীর্ণতা থাকিতে পারে, কিন্তু ইহা অস্বীকার করিবার কোনও বিজ্ঞানসম্মত কারণ নাই যে, নাসিকার সহিত যৌনবোধের ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান আছে। অনেক চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যে পুরুষ মিথুনীভুক্ত হইবার পূর্বে স্ত্রী জাতির যোনির ভ্রূণ লয়। ইহার দৈহিক কারণ এই যে, নাসিকাব সহিত মস্তিষ্কেব তথা সমস্ত স্বায়ু মণ্ডলীর ঘনিষ্ঠতা বহিয়াছে। অবশ্য যৌন-ব্যাপারে, অন্যান্য প্ৰাণীর ন্যায়, মানুষ ঘ্রাণেন্দ্ৰিয় দ্বারা ততটা প্ৰভাবান্বিত নহে। তথাপি আমরা উহা সচরাচব লক্ষ্য করিয়া পাকি যে, এমন অনেক গন্ধদ্রব্য আছে যাহার দ্বারা আমাদের যৌনবোধের হ্রাস-বুদ্ধি হইয়া থাকে। পক্ষান্তরে, যখন আমরা দেখিতে পাই যে, প্রিয়জনের শরীর ও পোষাক বা গন্ধ আমাদের যেমন প্রিয়, অপ্রিয়জনের শরীর ও পোষাকের গন্ধ তেমনি অপ্রিয়, তখন আমরা একথা মানিয়া লইতে বাধ্য যে, ঘ্রাণেন্দ্ৰিয়ের সহিত আমাদের যৌনবোধের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ বিদ্যমান আছে।

যৌনবোধ এবং জিহ্বা ও ত্বগিন্দ্ৰিয়

যৌনবোধের আর একটি প্রধান ইন্দ্রিয় আমাদের ত্বক। রতিক্রিয়া “আমাদিগকে যে এতখানি আনন্দ দান করিতে পারে, সে কেবল আমাদের ত্বকের অনুভূতিশীলতার জন্যই।

প্ৰধানত ত্বকের উপরই আমাদের সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ানুভূতি প্রতিষ্ঠিত। সমস্ত ইন্দ্ৰিয়ের মধ্যে ত্বকই সর্বাপেক্ষা প্রত্যক্ষ সম্বন্ধযুক্ত। পশুপক্ষীর মধ্যে প্রধানত এই ত্বকের ভিতর দিয়াই যৌনবৃত্তি উন্মেষ লাভ করিয়া থাকে।

শৈশব হইতেই এই স্পর্শমুখানুভূতি পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। কিশোরীদের মধ্যে যখন সৰ্বপ্রথম যৌন-অনুভূতি জাগ্রত হয়, তখন প্রধানত তাহা স্পর্শসুখানুভূতিতেই সীমাবদ্ধ থাকে। তাঁহারা চুম্বন, আলিঙ্গন, ধর্ষণ ও মর্দনেই তৃপ্ত হয়। প্ৰকৃত সঙ্গম ক্রিয়াকে তাঁহারা ভীতির চক্ষে দেখে।

সুড়সুড়ি ও মর্দন প্রভৃতি হাতের এবং চুম্বন, চোষণ, লেহন ও দংশন প্রভৃতি ওষ্ঠ, জিহ্বা ও দাঁতের ক্রিয়া ঐ সমস্তই ত্বগিন্দ্ৰিয়ের অনুভূতির তৃপ্তিসাধক। যে সব ব্যক্তি স্পর্শকাতর হয় (প্ৰায় সমস্ত নারীগণ) তাহাদের সুড়সুড়ি বা কাতুকুতু প্ৰায় অসহ্য বোধ হয়। এই জন্য স্ত্রীলোকের যৌনপ্রদেশসমূহ কোমল বলিয়া ঐ সব স্থানে সুড়সুড়িবোধ খুব বেশী। কাজেই হঠাৎ কেহ ঐ সমস্ত স্থান স্পর্শ করিতে পারে না। ইহাতে স্ত্রীজাতির সতীত্ব রক্ষা হয়। কিন্তু যৌনকার্যে ঐ সুড়সুড়ি আবার সমস্ত যৌনচেতনাকে উন্মুখ করিয়া দেয়। এই সুড়সুড়ির বর্ধিত মাত্রাই মর্দন। যে সমস্ত অঙ্গে সুড়সুড়ি দিলে যৌনচেতন, জাগ্রত হয়, যৌনচেতনা বুদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ঐ সমস্ত স্থানে প্ৰচাপনের প্রয়োজন হয়। সেইজন্য নারীর যৌনপ্রবৃত্তি বৃদ্ধির সময় সে তাহার যৌন-অঙ্গসমূহে পুরুষহন্তের স্পৰ্শন ও মর্দন আকাঙ্খা করে।

চুম্বন ত্বগিন্দ্রিয়ের স্পর্শানুভূতির আর একটি জাজ্বল্যমান দৃষ্টান্ত। আমাদের অধরোষ্ঠ অতিশয় চেতনাশীল অঙ্গ। ত্বক ও শ্লৈষ্মিক ঝিল্লীর সীমারাখা হাওয়ায় ইহা স্পর্শনগুণে অত্যন্ত অনুভূতিশীল। ইহার সঙ্গে অধিকতর চেতনাশীল জিহ্বার সহযোগিতা থাকায় ইহা আমাদের যৌনচেতনা বুদ্ধির পরিপোষক। জিহ্বা, ও ঠোঁট এতটা চেতনাশীল বলিয়াই আমাদের যৌনবোধে। ইহারা প্ৰত্যক্ষ অংশ গ্রহণ করিয়া থাকে। চুম্বনের প্রথা সমস্ত সভ্যদেশেই প্রচলিত আছে।

চুম্বনেব বর্ধিত মাত্রার নাম চোষণ, লেহন ও দংশন। যে সমস্ত স্থানে চুম্বন করিলে মানুষের যৌনপ্রবৃত্তি জাগ্রত হয়, যৌনপ্রবৃত্তি বৃদ্ধির সঙ্গে সেট সমস্ত স্থানে চোষণ, লেহন ও কোমল দংশনও প্রয়োজন হইয়া পড়ে।

আলিঙ্গন আমাদের ত্বগিন্দ্ৰিয়ের স্পর্শানুভূতির অপর নিদর্শন। যৌনকাৰ্যে এই আলিঙ্গন অতীব প্রয়োজনীয় অংশ।

সুড়সুড়ি বা মর্দন, চুম্বন, চোষণ বা দংশন, লেহন ও আলিঙ্গন আমাদের যৌন-ক্রিয়ার প্রত্যক্ষ অংশ। হ্যাভলক এলিস্‌ প্রভৃতি যৌনবিজ্ঞানবিদ্‌গণের অভিমত এই যে, যৌনপ্রবৃত্তি বৃদ্ধির জন্যে এ সমস্ত কার্য অবশ্যই করা উচিত। কিন্তু শুধু ইহাদের দ্বারা শুক্ৰস্খনোদ্দেশ্যে এবং স্ত্রীলোকের চরম তৃপ্তি আনয়ন উদ্দেশ্যে এই সমস্ত কাৰ্যই দীর্ঘকাল ধরিয়া করিতে থাকিলে উহা স্বাভাবিকতার মাত্রা ছাড়াইয়া যায় এবং তখনই কেবল উহা যৌন-বিকারে পর্যবসিত হয়।

মিলনের দৈহিক প্রতিক্রিয়া

যৌনবোধ পঞ্চেন্দ্ৰিয়ের সাহায্যে কিভাবে জাগ্রত ও বর্ধিত হয় তাহা বলিলাম। উহার প্রত্যক্ষ তৃপ্তি হয়। কিন্তু নর ও নারীর দৈহিক মিলনে। এই মিলনের সহিত ব্যক্তিগত সুখ ও তৃপ্তি, পারিরাবিক বন্ধন ও শ্ৰীতি, জাতিগত উৎকর্ষ ও বংশবৃদ্ধি অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত।

নর ও নারীর মিলনে প্ৰধানত দুই প্রকারের দৈহিক প্রতিক্রিয়া সংঘটিত হয়। ইহার একটি রক্তসঞ্চালন-ঘটিত, অপরটি শ্বাসপ্রশ্বাস-ঘটিত। এই সময়ে, বিশেষ করিয়া উত্তেজনার চরম মুহুর্তে শ্বাসপ্রশ্বাস অনেকখানি রুদ্ধ হইয়া যায়। ইহার অবশ্যম্ভাবী ফলস্বরূপ পুরুষদেহে রক্তের চাপ বৃদ্ধি পায়, হৃৎপিণ্ডের গতি দ্রুত হয়, শিরাসমূহ ফুলিয়া উঠে, দৃশ্য ও অদৃশ্য উভয়ভাবে শরীরের বিভিন্ন স্থান হইতে পৰ্যাপ্ত পবিমাণে রক্তক্ষরণ হইতে থাকে।

নারী-অঙ্গে ও অনুরূপ পবিবর্তন সংঘটিত হইতে থাকে। জরায়ুর মুখ খানিকটা উন্মুক্ত হইয়া উহা বস্তি-প্রদেশে খানিক দূরে নামিয়া আসে। যোনিপ্রাচীরের বিভিন্ন রসগ্রন্থি হইতে ক্ৰমাগত রসক্ষরণ হইতে থাকে। ভগাঙ্কুর উত্তেজিত ও উত্থিত হয়।

নারী অপেক্ষা পুরুষের মধ্যেই এই বিপর্যয় অধিকতব সুস্পষ্টরূপে পরিলক্ষিত হইয়া থাকে। তাহার কারণ যৌন-উত্তেজনা পুরুষের মধ্যে যেমন ঝড়ের বেগে আসিয়া থাকে, তেমনিই ঝড়েব বেগে তিরোহিত হয়। ফলে পুরুষের স্নায়ুমণ্ডলে যৌন-উত্তেজনা যতখানি বিপ্লব সৃষ্টি করে নারীর ততখানি করে না।

ক্লান্তিনাশক নিদ্রা

যৌন-উত্তেজনার এই সমস্ত প্রাকৃতিক ও অবশ্যম্ভাবী দৈহিক শ্রান্তি, ক্লান্তি ও গ্লানি মোচন করিবার জন্যই স্বয়ং প্রকৃতিই এক সুন্দর ব্যবস্থা করিয়াছেন। এই ব্যবস্থা নিদ্রা, রতিক্রিয়ার পরিসমাপ্তিতে সুরতকদ্বয়ের উভয়ে এক দুৰ্নিবার অথচ সুখদায়ক সুষুপ্তি অনুভব করিয়া থাকে। স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য সুরতকদ্বয়ের বিশেষত পুরুষের, এই সুষুপ্তির নিকট আত্মসমর্পণ করা অত্যাবশ্যক। কারণ সুরতক্রিয়ার পরবর্তী এই নিদ্রা অবসাদনাশক মহৌষধি বিশেষ।

যৌনমিলন সম্বন্ধে। ২য় খণ্ডের সপ্তম হইতে উনবিংশ অধ্যায়ে বিস্তৃত আলোচনা করা হইয়াছে। যৌনবোধের দৈহিক পরিণতি নর ও নারীর মিলন এবং উহাতে উভয়ের দেহে যে ক্রিয়া-প্ৰতিক্রিয়াল সৃষ্টি করে তাহা ই এখানে সংক্ষেপে উল্লেখ করা গেল।

————-
(1) সেক্সপিয়ার-সৃষ্টি চরিত্র মিরাণ্ডা ও বঙ্কিমচন্দ্র-সৃষ্টি কপালকুণ্ডলার দৃষ্টান্ত।
(2) ভগাঙ্গুর উপরের দিকে দুয়োtখদের মধ্যবর্তী স্থার।
(3) দ্বিতীয় খণ্ডের ‘রতি কৌশল সম্পর্কে মতামত ও তথ্য’ অধ্যায় দেখুন।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2