২.৫ বিবাহযোগঃ (বিবাহ দ্বারা সম্মিলন)

দ্বিতীয় ভাগ – পঞ্চম অধ্যায়

এইভাবে অনুরঞ্জিত হইয়া স্বয়ংবরে প্রবৃত্তা নায়িকাকে গান্ধর্ববিধানযোগ করিবে। আর তদ্বিপরীতাকে আসুরাধিবিধানযোগ করিবে। এই জন্য বিবাহযোগ কথিত হইয়াছে। তাহার মধ্যে গান্ধর্ববিধানই প্রায়শ দেখিতে পাওয়া যায়। অতএব তাহার সহায়সাধ্য বিধির বিষয় বর্ণিত হইতেছে—

যদি কন্যার দর্শন প্রচুরপরিমানে না পাওয়া যায়, তবে প্রিয়কর ও হিতপ্রায় উপচার দ্বারা পুরুষপ্রবৃত্তা ধাত্রেয়িকাকে হস্তগত করিয়া তাহার নিকট প্রেষিত করিবে।।’১।।

সেই ধাত্রেয়িকা কন্যার বিদিত না হইয়া নায়কের পক্ষ হইয়া নায়কের গুণদ্বারা নায়িকাকে অতিরঞ্জিত করিবে। যাহা নায়িকার অত্যন্ত রুচিকর, সেইসকল নায়কগুণ তাহার নিকট ভুয়িষ্ঠভাবে উপবর্ণিত করিবে। আর অন্যান্য বরয়িতার যে-সকল দোষ নায়িকার অভিপ্রায়বিরুদ্ধ বলিয়া মনে করিবে, সে সকল দোষ নায়িকার নিকট সতত প্রতিপন্ন করিবে। মাতা ও পিতার গুণাগুণাভিজ্ঞতা, অর্থে লোভ এবং বান্ধবগণের চপলতা প্রতিপন্ন করিবে। আর যে-সকল সমানজাতীয় শকুন্তলা প্রভৃতি কন্যাগণ নিজের বুদ্ধি অনুসারে ভর্ত্তাকে প্রাপ্ত হইয়া সম্প্রয়োগ করিয়া, পরে গুরুজনের নিকট অনুমোদিত হইয়াছিল, সেইসকল কন্যা ইহাকে নিদর্শনস্থায়ীয় করিয়া দেখাইবে। আরও বলিবে, মাতাপিতা হয়ত মহাকূলে দান করিতে পারেন; কিন্তু তথায় সপত্নীগণ অত্যন্ত পীড়া দেয়, স্বামীর বিদ্বিষ্ট করিয়া সুখ দেয় ও পরিশেষে পরিত্যাগ পর্যন্ত করাইয়া থাকে, ইহা যথেষ্ট দেখিতে পাওয়া যায়। একমাত্র পত্নী হইলে তাহার পরিণাম বর্ণনা করিবে। একচারিতায় অনুপহত সুখ ও নায়িকার প্রতি অনুরাগ বর্ণনা করিবে। যখন বুঝিবে নায়িকার মনে অনুরাগ জমিয়াছে, কিন্তু মরিবার ভয় ও লজ্জার জন্য স্বয়ং কিছুই করিতে পারে না দেখিয়া, উপায় দ্বারা সে ভয় ও লজ্জার অবচ্ছেদ করিয়া দিবে। সমস্তই দ্যুতির ন্যায় আচরণ করিবে। বলিবে, তুমি অজানতীর ন্যায় থাকিবে, অথচ নায়কই তোমাকে বলাৎ গ্রহণ করিবে। তাহা হইলে ত সুন্দরভাবে পরিগৃহীত হইবে; ইত্যাদি বলিয়া যোজিত করিবে।।’২।।

নায়িকা স্বীকার করিলে, নায়ক কোনও একটি নিভৃত স্থানে তাহাকে লইয়া গিয়া কোনও শ্রোত্রিয়ের বাটি হইতে সংস্কৃত অগ্নি আনাইয়া কুশ পাতাইয়া স্বগৃহ্যোক্ত বিধানানুসারে হোম করিয়া অগ্নিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করিবে। নায়িকাকে তিনবারই পরিভ্রমিত করিবে। তারপর মাতাকে ও পিতাকে জানাইবে। অগ্নিসাক্ষিক বিবাহ আর নিবর্তিত হয় না, ইহা আর্যাচার জানিবে।।’৩।।
নিবর্তিত হয় না–তাহাকে আর অন্যের সহিত বিবাহ দেওয়া হয় না। অগ্নিসন্নিধান ধর্মবিবাহে কর্তব্য।।৩।।

কেবল যে উদ্বাহমাত্র করিয়া প্রকাশ করিবে, তাহা ননে। কন্যাকে অভিগমন-দোষে দূষিত করিয়া ধীরে ধীরে তাহার স্বজন বর্গের নিকট প্রকাশ করিবে। আর যাহা হইলে নায়িকার বান্ধবগণ কুলের দোষ পরিহারার্থ এবং দণ্ডের ভয়ের জন্য তাহাকেই ইহাকে দেয় সেইরূপ যোগাযোগ করিবে। তারপর প্রীতিপুর্বক উপহার প্রদান ও অনুরাগ প্রদর্শন করিয়া নায়িকার বান্ধবদিগকে প্রীত করিবে। অথবা গান্ধর্ববিধানানুসারেই বিবাহের চেষ্টা করিবে।।’৪।।

স্বয়ং পাণিগ্রহণ করিতে নায়িকা যদি অস্বীকুর্খতী হয়, তবে কোন অন্তরঙ্গ কুলস্ত্রীকে বা নায়কের পূর্বসংসৃষ্ট প্রীয়মাণ স্ত্রীকে দ্রব্য দ্বারা স্বীকৃত করিয়া, তদ্দ্বারা নায়িকাকে অন্য কার্যের ছলে গমনীয় সময়ে আনাইবে। তারপর শ্রোত্রিয়ের বাটি হইতে অগ্নি আনাইয়া পূর্বের ন্যায় বিবাহ করিয়া ফেলিবে।।’৫।।

অথবা কোনও প্রাতিবেশ্যা আসন্ন বিবাহে নায়িকার মাতাকে নায়িকার অভিমত দোষগুলি এক-একটি করিয়া বলিয়া নায়িকা যাহাকে মনঃস্থ করিয়াছে, তাহার অনুমোদনার্থ অভিপ্রায় লওয়াইবে। তারপর মাতার অভিপ্রায় লইলে, রাত্রে সেই প্রতিবেশ্যার বাটিতে নায়ককে আনাইয়া শ্রোত্রিয়বাটি হইতে অগ্নি আনাইয়া পূর্বের ন্যায় বিবাহ সম্পাদন করাইবে।।’৬।।
প্রতিবেশবাসিনী অবশ্য নায়কের দ্রব্যোপহারে সন্তুষ্ট হইয়াই এরূপ কার্যে ব্রতী হইবে, ইহা বলাই বাহুল্য। এটি দ্বিতীয় কল্প জানিবে।।৬।।

অথবা সমানবয়স্ক বেশ্যা বা পরস্ত্রীতে প্রসক্ত নায়িকার মাতাকে দুঃসাধ্য স্ত্রী সম্পাদনাদি দ্বারা বা প্রিয়কর দ্রব্যোপহার দ্বারা সুদীর্ঘকাল ধরিয়া নিতান্ত অনুরঞ্জিত করিবে। পরে তাহাকে নিজের অভিপ্রায় গ্রহণ করাইবে। প্রায়ই যুবকগণ সমানশীল, সমানব্যসন ও সমানবয়স বয়স্যিদিগের কোনও বিষয় সম্পাদন করিবার জন্য জীবন পর্যন্ত দিতে পারে। তারপর তদ্বারাই অন্যকার্যের ছলে নায়িকাকে আনাইবে এবং গমনীয় সময়ে শ্রোত্রিয়বাটি হইতে সংস্কৃত অগ্নি আনাইয়া বিবাহকার্য সমাধা করিবে।।’৭।।
প্রিয়োপগ্রহ—যে বস্তু যাহার প্রিয়, তাহাই তাহাকে আপাতত সংগ্রহ করিয়া দেওয়া।
সাম—নীতিবিশেষ, আপাতত যে নীতি অবলম্বন দ্বারা মনোমালিন্য-বিবাদাদির নিষ্পত্তি হইয়া যায়।
দান—ইহাও নীতিবিশেষ, আপাতত অর্থাদি দ্বারা বিবাদ ভঞ্জন করা, বা অন্য উপায় দ্বারা।
অভিপ্রায় গ্রহণ—তোমার ভগিনীকে পরিণয় করিতে ইচ্ছা করি, এইরূপ অভিপ্রায় গ্রহণ করাইয়া। ইহা তৃতীয় কল্প।।৭।।

সুপ্ত বা প্রমত্তনায়িকার উপগম করিয়া যে তাহাকে গ্রহণ করা যায়, তাহাকে পৈশাচ বিবাহ কহে।
ধাত্রয়িকা অষ্টমীচন্দ্রিকাদিদিবসে, (অগ্রহায়ণ মাসের কৃষ্ণা অষ্টমী, অষ্টমীচনদ্রিকা) সেইদিন দিবসে উপবাস করিয়া পূজাপূর্বক রাত্রিজাগরণ করিতে হয়, যতক্ষণ চন্দ্রোদয় না হয়। মদনীয় সুরাদি নায়িকাকে পান করাইয়া নিজের কিছু কার্যের উদ্দেশ্য করিয়া নায়কের গমনীয় দেশে নায়িকাকে আনিবে। সেইস্থলে নায়িকা আসিয়া মদ্যপানাদি দ্বারা সংজ্ঞাহীন হইলে অভিগম দ্বারা দূষিত করিয়া, পরে পূর্বোক্ত বিধানানুসারে বিবাহ করিবে।। ’৮।।
দূষিত করিয়া তাহার বান্ধবের নিকট ক্রমশ প্রকাশ করিবে এবং যাহা হইলে নিজে পায়, তাহার যোগাযোগ করিবে।।৮।।
এই এক প্রকার।।৮।।

ধাত্রেয়িকার নিকট শায়িনী আছে, কিন্তু নিকটে আর কেহই নাই, সেই অবস্থায় ধাত্রেয়িকাকে প্রকাশ করিতে বারণ করিয়া সংজ্ঞাহীন অবস্থায় অভিগমন দ্বারা দূষিত করিয়া পূর্বের ন্যায় বিবাহ করিবে।।’৯।।
ইহা দ্বিতীয় প্রকার। ইহাতে অগ্ন্যাহরণাদি নাই। কারণ, এই বিবাহ অধর্ম।।৯।।

প্রসহ্যাহরণে (বলাৎকারে) রাক্ষস বিবাহ—
গ্রামান্তরে বা উদ্যানে নায়িকা গমন করিয়াছে জানিয়া, বহুসহায়ের সহিত সুসংনদ্ধ—বিশেষরূপে সজ্জিত হইয়া নায়ক তখন রক্ষকগণকে বিত্রস্ত করিয়া বা মারিয়া ফেলিয়া কন্যাকে হরণ করিবে।’
ইতি বিবাহযোগ।।১০।।

আট প্রকার বিবাহের মধ্যে কোন্‌টির অপেক্ষা কাহার প্রাধান্য, তাহা কীর্তন করিতেছেন—
আট প্রকার বিবাহের মধ্যে পূর্ব পূর্ব বিবাহ প্রধান; কারণ ধর্মত সেই বিবাহ প্রবর্তিত হইয়া থাকে। পূর্ব পূর্ব বিবাহ করিতে অক্ষম হইলেই, তবে উত্তর উত্তর করিতে প্রবর্তিত হইবে।।’১১।।

কৃত বিবাহের ফল অনুরাগ। এই অনুরাগাত্মক গান্ধর্ব বিবাহ মধ্যম হইলেও সুতরাং পূজনীয়।।’১২।।

গান্ধর্বের প্রধান্য হইবার কারণ যাহা, তাহা একই শ্লোকে প্রথিত করিয়া দেখাইয়াছেন—
গান্ধর্ব বিবাহ সুখের হেতু, ইহাতে প্রায়শই তত ক্লেশভোগ করিতে হয় না, ইহাতে বরণ-সম্বিধানও নাই এবং এটি অনুরাগাত্মক। এই সমস্ত কারণে গান্ধর্ব বিবাহই আট প্রকারের মধ্যে প্রবর, এইরূপ আচার্যেরা মনে করেন।।’১৩।।

ইতি বিবাহযোগপ্রকরণ।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2