৪.৪ বিশীর্ণপ্রতিসন্ধানম্‌ (পুরাতন প্রণয়ীর সহিত পুনরায় বন্ধুত্বকরণ)

চতুর্থ ভাগ – চতুর্থ অধ্যায়

বর্তমানে যাহার ধনশোষণ করিয়া লওয়া হইয়াছে, তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া, পূর্বসংসসৃষ্ট কোন ধনবানের সহিত আবার সন্ধিস্থাপন করিবে।।’১।।

সে যদি ধনদান করিবে বলিয়া বোধ হয়, ধনবান্‌ হয় এবং সানুরাগ হয়; তবেই তাহার সহিত সন্ধি করিবে।।’২।।

সে যদি অন্যত্র গমন করিয়া থাকে; তবে তাহা নিরূপণ করিতে হইবে। সেই বিশীর্ণ-নায়ক ষড়্‌বিধ। তাহার কার্যযোগ যেহেতু ষড়্‌বিধ।।’৩।।

কর্মযোগ কি, তাহা কথিত হইতেছে—
এখান হইতে নিজেই চলিয়া গিয়াছে এবং সেখান হইতেও নিজেই অপসৃত হইয়াছে।১। এখান ও সেখান হইতে নিষ্কসিত হইয়া অপসৃত হইয়াছে।২। এখন হইতে স্বয়ং অপসৃত; কিন্তু সেখান হইতে নিষ্কাশিত হইয়া অপসৃত হইয়াছে।৩। এখান হইতে অপসৃত; কিন্তু সেখানে অবস্থান করিতেছে।৪। এখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়া অপসৃত; কিন্তু সেখান হইতে স্বয়ং অপসৃত হইয়াছে।৫। এবং এখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়া অপসৃত হইয়াছে, সেখানে অবস্থান করিতেছে।৬।।’৪।।

ইহাগিদের মধ্যে সন্ধেয় ও অসন্ধেয় কে, তাহার বিচার করা যাইতেছে—
এখান ও সেখান হইতে নিজেই অপসৃত হইয়া যদি পীঠমর্দাদি দ্বারা আবার সম্বানার্থ চেষ্টা করে, অথচ উভয়েরই গুণের কোন অপেক্ষা না করে; তবে সে চঞ্চলবুদ্ধি নায়ক কখনই আর সন্ধেয় হইতে পারে না।।’৫।।

এখান ও সেখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়া অপসৃত হইয়াছে, কিন্তু নিজে অপসৃত হয় নাই বলিয়া স্থিরবুদ্ধি। সে যদি অন্য বহুলাভকারিণী নায়িকা দ্বারা নিষ্কাসিত হইয়া থাকে; তবে সেই সসার নায়কের তাহার রোষ উৎপাদন করিয়া অমর্ষ (বিরাগ) জন্মাইয়া দিতে পারিলে আমার পক্ষে বহুপ্রদ হইতে পারে; এরূপ বুঝিলে সে সন্ধেয়।।’৬।।

এখান হইতে স্বয়ং অপসৃত; কিন্তু সেখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়া অপসৃত হইয়াছে। সে যদি পূর্বদান অপেক্ষা বহুধন দান করে; তবে সে গ্রাহ্য।।’৮।।

এখান হইতে নিজে অপসৃত হইয়া সেখানে অবস্থান করিতেছে, কিন্তু পীঠমর্দাদি দ্বারা আবার সন্ধানার্থ চেষ্টা করিতেছে। এরূপস্থলে, তাহার নির্ণয় করিতে হইবে, ঠিক কিনা।।’৯।।

এস্থলে সন্ধেয় পক্ষ কি, তাহা বলিতেছেন—
তাহার নিকট বিশেষ গুণলাভ করিতে সমর্থ হইবে ভাবিয়া গিয়াছিল; কিন্তু তাহার বিশেষ গুণ দেখিতে না পাইয়া আসিতে চাহিতেছে। অথবা সেখান হইতে আসিবার জন্য আমার নিকট জিজ্ঞাসা করিতে ইচ্ছা করিতেছে যে, আমি আবার তাহাকে লইতে ইচ্ছা করি কিনা। সেখানে কোন বিশেষ গুণ দেখিতে না পাইয়া এবং আমার বিশেষ গুণ দেখিতে পাইয়া, আমার উপর সানুরাগভাবে আসক্ত হইয়া, এবার বহুদান করিতে পারে। যদি এরূপ বুঝিতে পারা যায়, তবে তাহাকে সন্ধান করা উচিত। অথবা তাহার গুণ দেখিয়া তাহার নিকট নিজেই অপসৃত হইয়া গিয়াছিল; কিন্তু আমার অপেক্ষা তাহার বিশেষ কোনও গুণ নাই, অধিকন্তু তাহার দোষ দেখিয়া এখন আমার যে বহুগুণ আছে, তাহা জানিতে পারিয়াছে ও ভূয়িষ্ঠ (প্রচুরতর) গুণ দেখিতেছে। এরূপ হইলে, সেই গুণদর্শী নিশ্চয়ই ভূয়িষ্ঠধন দান করিবে, সুতরাং সে সন্ধেয়।।’১০।।

অসন্ধেয় পক্ষ কি, তাহা বলিতেছেন—
নায়ক বালকধর্মাবলম্বী, অথবা একত্র দৃষ্টিপ্রদানকারী নহে, কিংবা অত্যন্ত সন্ধান কখনই করে না, বা হরিদ্রার রাগের ন্যায় যাহার রাগ চিরস্থায়ী নহে, অথবা যে যাহা তাহা করিয়া থাকে, কিংবা আসিয়া সন্ধান করিবে কিনা, সন্দেহ। যদি এরূপ বুঝিতে পারা যায়, তবে তাহার চেষ্টা করা উচিত নহে।।’১১।।

এখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়া অপসৃত এবং সেখান হইতেও অপসৃত। এখন আবার পীঠমর্দাদি দ্বারা সন্ধানার্থ চেষ্টা করিতেছে। সে নায়ক তর্কণীয়। আর এরূপ অবস্থায় সে যদি অনুরাগ বশত আসিতে চাহে, তবে সে নিশ্চয় বহুদান করিবে। আর যে নায়ক আমার গুণের পক্ষপাতী হইয়া আর অন্য নায়িকার রতিলাভ করিতে পারে না, সেও নিশ্চয়ই সন্ধেয়।।’১২।।
পারিতেছে না বলিয়া সে সেখান হইতে নিষ্কাসিত হইয়াছে, সে নিশ্চয় অনুগাহ্য।।১২।।

পূর্বে আমি যাহাকে অন্যায়পূর্বক নিষ্কাসিত করিয়াছি, সে আমার নিকট আবার আসিয়া যদি সেই বৈরনির্যাতন করিতে ইচ্ছা করে, অথবা আমি অভিযোগ বশত তাহার ধন অপহরণ করিয়াছি, কিন্তু সম্প্রয়োগ খুব অল্পই করিয়াছি; এখন সে যদি আমাকে বিশ্বাস করিয়াই আমার নিকট হইতে সেই ধন অপহরণের ইচ্ছা করিয়া থাকে; কিংবা ভৃতুভাবে থাকিয়া সেই ধন লইতে ইচ্ছা করিয়া থাকে; অথবা এখন আমি যাহার সহিত আছি, তাহার ভেদ ঘটাইয়া সে আবার ত্যাগ করিবার ইচ্ছা পোষণ করিতে থাকে; তবে সে সে ব্যক্তি কখনই মঙ্গলবুদ্ধিসম্পন্ন নহে; সুতরাং কখনই তাহারা সন্ধেয় নহে।।’১৩।।

যে অন্যথাবুদ্ধি, এখন অনুরাগ আছে, ধন দান করিতে সম্মত; কিন্তু পরে আর অনুরাগ থাকিবে না, ধনও দিবে না—যে এরূপ, সে সেইকালেই নিষ্কাস্য।।’১৪।।

অনেকগুলি কারণ বলিতেছেন—
দুঃখ দিবার জন্য আমি তাহাকে নিষ্কাসিত করিয়াছি; সুতরাং সে অন্যত্র গমন করিয়াছে; কিন্তু আমার উপর তাহার অনুরাগ কিছুমাত্র স্খলিত হয় নাই। যদি এরূপ হয়, তবে তাহাকে যত্ন করিয়া আনয়ন করিবে।।’১৬।।
(ভাষ্যকার ব্যাখ্যা করেন—নায়ক অন্য নায়িকার নিকট অভিগমন করার অপরাধে যদি আমি কিছু বলি, এই ভয়ে সে যদি আমাকে ছাড়িয়া অন্যত্র গমন করিয়া থাকে, তবে তাহাকে যত্নপূর্বক আনয়ন করিতে হইবে।)

অথবা এখান হইতে লোক যাইয়া, তাহার সহিত কথোপকথন করায়, যদি সে সেখানে আর শান্তি না পায়; তবে সে সন্ধেয়। অবশ্য যত্নপূর্বক আনেতব্য, কিংবা তাহার নিকট সম্প্রতি থাকায়, সে তাহার যদি সমস্ত অর্থ বিনষ্ট করিয়া দেয়, এরূপ বুঝিতে পারা যায়, তবে সে নায়ক তাহার নিকট হইতে যত্নপূর্বক আনেতব্য; অথবা তাহার এখন যেরূপ অবস্থা পড়িতেছে, তাহাতে এখন প্রচুর অর্থাগম হইবার সম্ভাবনা; সুতরাং তাহাকে যত্নপূর্বক আনয়ন করা উচিত। কিংবা সে এখন আরও অনেকগুলি সম্পত্তি ক্রয় বা চুক্তি করিয়া লইয়াছে; সুতরাং এখন তাহার আনয়ন করা উচিত। যদি বা সে এখন অধিকরণ (অধ্যক্ষতার স্থান) লাভ করিয়া থাকে, তবে সে এখন আনেতব্য। অথবা এখন তাহার স্ত্রীবিয়োগ ঘটিয়াছে, এখন আর বহুধন ব্যয়ে তাহার বাধা নাই; সুতরাং তাহাকে আনয়ন করা উচিত। অথবা এখন তাহার পরতন্ত্রতা ঘুচিয়াছে, যদি এরূপ হয়, তবে সে যাহা ইচ্ছা করিবে, তাহাই করিতে পারিবে। কিংবা পিতা বা ভ্রাতার সহিত বিভক্ত হইয়াছে, সুতরাং স্বাধীন হইয়াছে, যথেচ্ছ ব্যবহার করিতে পারিবে। কিংবা ইহার সহিত অমুক ধনীর অতিরিক্ত বন্ধুত্ব আছে—যদি আমি ইহাকে হস্তগত করিতে পারি, তবে সেই ধনী নায়ককে পাইতে পারিব। অথবা ইহাকে এখন ইহার ভার্যা অবমান করিয়াছে; এখন আমি যদি ইহাকে হস্তগত করিতে পারি, তবে ইহাকে ইহার ভার্যার নিকট বিক্রম প্রকাশ করাইতে পারিব। অথবা ইহার মিত্র আমার দ্বেষকারিণী একটি সপত্নীকে কামনা করিতেছে, এখন যদি আমি ইহাকে সন্ধিত (কৌশলে হস্তগত) পারি, তবে তাহাকে তাহার সহিত ভিন্ন করিয়া দিতে পারিব। এব্যক্তি বড়ই চঞ্চল; আচ্ছ! আমিও একবার ইহাকে গ্রহণ করিয়া ইহার চাপল্য আরও খানিক বাড়াইয়া দেই না কেন, এই ভাবিয়া বা গ্রহণ করিতে পারি।।’১৭।।

বিশীর্ণের সন্ধান কিরূপে করিতে হইবে তাহা কথিত হইতেছে—
পীঠমর্দাদিবর্গ তাহার নিকট নায়িকার মাতার দৌঃশীল্য, নায়িকার অনুরাগ, পরাধীনতা অ তজ্জন্যই নিষ্কাসনের বর্ণনা করিবে। বর্তমান নায়িকের সহিত সংসর্গ ও বিদ্বেষও বর্ণনীয়। নায়িকার অভিজ্ঞানের সহিত পূর্বানুরাগ দ্বারা নায়কের প্রত্যয় জন্মাইয়া দিবে। নায়ককৃত উপকারসূচক অভিজ্ঞান প্রদর্শন করিতে হইবে। তাহার অর্থ বা অনর্থ প্রতিকার যাহাতে হয়।।’১৮।।

ইতি বিশীর্ণপ্রতিসন্ধান প্রকরণ।

অপূর্ব ও পূর্বসংশ্লিষ্ট নায়কের মধ্যে পূর্বসংশ্লিষ্ট নায়কের প্রশস্ততর। আচার্যগণ বলেন—যে ব্যক্তি শীল বিদিত হইয়াছে, রাগ বুঝিতে পারা গিয়াছে, সুন্দর উপচার প্রয়োগে সে সমর্থ; ইহা প্রত্যক্ষ বলিয়া তাহারই সন্ধান ভাল। যদি সর্বতোভাবে পূর্বসংসৃষ্ট নায়ক নিষ্পীড়িতার্থ হইয়া থাকে, তবে সে আর অত্যন্ত ধন দান করিতে পারে না এবং তাহাকে বিশ্বাস করাইতেও বহু দুঃখ পাইতে হয়। যে অপূর্ব (যাহার সহিত কখনও সম্বন্ধ হয় নাই) সে অনায়াসেই নিজে অনুরাগপূর্বক আসিতে চাহে; সুতরাং সেই প্রশস্যতর—আচার্য বাৎস্যায়ন এই কথা বলেন। তাহার মধ্যেও পুরুষস্বভাব অনির্ণেয় বলিয়া অনেক বিষয় আছে। তাহা কার্যক্ষেত্রে দেখিয়া-বুঝিয়া তবে সন্ধান করিবে।।’১৯।।

অবিষয়ে অনেকগুলি শ্লোক আছে—
গম্য নায়কের নিকট হইতে অন্য নায়িকাকে ভেদ করিয়া দিতে বা অন্য নায়িকার নিকট হইতে গম্য নায়কের ভেদ ঘটাইয়া দিতে, কিংবা অন্য নায়িকার নিকটে অবস্থিত নায়কের উপঘাত (ব্যয় দ্বারা নষ্ট) করিবার জন্য, আবার সেই সেই নায়কের সহিত সন্ধান অবশ্য কর্তব্য।
নায়ক যে সংস্থানে থাকিয়া অতিরিক্ত সংসক্ত হইয়াছে এবং সে সংসক্ততার জন্য অন্য নায়কের সংযোগকে অত্যন্ত ভয় করে ও নায়িকার অপরাধ দর্শনই করে না। তদ্ভিন্ন পরিত্যাগভয়ে বহুদান করিয়া থাকে, তাদৃশ নায়ক কখনই উপেক্ষণীয় নহে।
নায়িকা কখনও অসক্তের অভিনন্দন ও কখন বা সক্তের পরিভব করিবে। অন্য নায়কের দূত আসিয়াছে দেখিয়া, যে নায়ক তখন অতিরিক্ত ধনদান করে, নায়িকা তাহাকে তখন কোনওক্রমে অসন্তুষ্ট করিবে না; তবে পূর্বের সেই সংসৃষ্ট বা অসংসৃষ্ট কিংবা বিশীর্ণকে কালে (অবসরমতে) সম্প্রযুক্ত করিবার চেষ্টা করিবে। বিশীর্ণ নায়কের সহিত সন্ধান করিবে; কিন্তু সক্তের অনুরাগ বর্ধন করিবে।
প্রথমে পরিণাম দেখিবে, লাভ ও অধিকপ্রীতিও দেখিবে। তারপর সৌহৃদ্য দেখিয়া বিচক্ষণা গণিকা বিশীর্ণব্যক্তিকে প্রতিসন্নিহিত করিবে।।’২০।।

ইতি বিশীর্ণপ্রতিসন্ধাননামক প্রকরণ।
ইতি শ্রীমদ্‌বাৎস্যায়নীয়কামসূত্রে বৈশিকনামক চতুর্থঅধিকারণে বিশীর্ণপ্রতিসন্ধাননামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।।৪।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2