দ্বিতীয় ভাগ – দ্বিতীয় অধ্যায়
এইরূপে কন্যালাভ করিতে পারিলেও তাহার বিশ্বাস উৎপন্ন করিয়া দিতে না পারিলে প্রয়োগের যোগ্য হইবে না। অতএব কন্যাবিস্রম্ভণ নামক দ্বিতীয় অধ্যায়ের আরম্ভ করা যাইতেছে। তাহার মধ্যে বিবাহানন্তর কর্তব্য মঙ্গলাচার বলা যাইতেছে—
‘পরিণয় দ্বারা সম্মান প্রাপ্ত হইয়া উভয়েই ত্রিরাত্র পর্যন্ত ব্রহ্মচর্যব্রত অবলম্বন করিয়া ক্ষারলবন বর্জিত আহার করিয়া অধঃ শয্যায় শয়ন করিবে। সেইরূপ এক সপ্তাহ পর্যন্ত গীতবাদ্যের সহিত মঙ্গলস্নান, প্রসাধন, একস্থানে সহভোজন, প্রেক্ষা (নাট্যাদিদর্শন) এবং সম্বন্ধিগনের দর্শন ও সুগন্ধ মাল্যাদি দ্বারা পূজা কর্তব্য। ইহা সার্ববর্ণিক বিধি’।।১।।
‘সেই দশ রাত্রিতে
(দশম দিনের
রাত্রে) বিজনস্থানে
মৃদু মৃদু উপচার দ্বারা ইহার
অভিগমার্থ উপক্রম
করিবে।।’২।।
–সংসর্গযোগ্য
হইলে। অন্যথা লজ্জাভয়াপগমার্থ।
মৃদু, অর্থাৎ
অনুদ্বেগকর উপচার (সম্মান)
দ্বারা।।২।।
উপক্রম করিবার
কারণ?
‘বাভ্যব্যের
মতাবলম্বীরা বলেন,
তিনরাত্র কথা
না বলিয়া থাকায় নায়ককে স্তম্ভের
ন্যায় দেখিয়া কন্যা ‘আমি মূক
গ্রাম্যজনকর্তৃক বিব্যহিত
হইয়াছি’ ভাবিয়ে দ্বেষ করিতে
পারে এবং ক্লীবের ন্যায় দেখিয়ে
তিরস্কার বুদ্ধিও করিতে
পারে’।।৩।।
‘উপক্রম করিবে, বিশ্বাস করাইবে; কিন্তু ব্রহ্মচর্য স্থলন করিবে না। বাৎস্যায়ন এই কথা বলেন।।’৪।।
‘উপক্রম করিয়া বলাৎকারে কিছু প্রয়োগ করিতে চেষ্টা করিবে না।।’৫।।
‘কামিনীকূল কুসুমসুকুমার; সুতরাং তাহাদিগের উপর যে উপক্রম করা যাইবে, তাহাও সুকুমার হওয়া আবশ্যক। যদি তাহাদের বিশ্বাস উৎপাদন না করিয়া বলাৎকারে উপক্রম করা যায়, তবে তাহা সম্প্রযোগদ্বেষিণী হয়। অতএব সাম্যনীতি অনুসারে উপচার প্রয়োগ কর্তব্য।।’৬।।
–অলব্ধপ্রসর
ব্যক্তির উপচার প্রয়োগ সম্ভবে
না বলিয়া উপায় সম্বন্ধে কিছু
বলিতেছেন—
‘তৎকালোচিত
কোনও যুক্তি অনুসারে যে উপায়
দ্বারা নিজের অবকাশ বুঝিবে,
সেই উপায়েই
অনুপ্রবেশের চেষ্টা করিবে।।’৭।।
–লব্ধপ্রসর
হইলে প্রথমে আলিঙ্গন দ্বারা
উপক্রম করিবে, ইহা
বলিতেছেন—
‘তাহার
প্রিয় যে আলিঙ্গন, তাহার
আচরণ দ্বারা কন্যার উপক্রম
করিবে। সেটি অধিক কালের জন্য
যেন না হয়; কারণ,
তাহা তাহার
অপ্রিয়।।’৮।।
‘শরীরের ঊর্ধভাগ দ্বারা প্রথম আলিঙ্গন করিবে। তাহাই তাহার সহনীয়।।’৯।।
‘পূর্বসংস্তুতা
ও বিগাঢ়-যৌবনার
আলিঙ্গন দীপালোকে করিতে পারে;
কিন্তু পূর্বে
আপ্রাপ্তালিঙ্গনা বালার
আলিঙ্গন অন্ধকারেই
প্রশস্ত।।’১০।।
–বিগাঢ়যৌবনার
বিবাহ হইতে পারে, যদি
অন্যান্য শুভলক্ষণ থাকে।
এজন্য তাহার কথা এখানে বলা
হইয়াছে।।১০।।
‘আলিঙ্গন স্বীকার করিয়া লইলে, তখন মুখে করিয়া তাম্বুল দান করিবে। যদি তাহা লইতে না স্বীকার করে, তবে সান্ত্বনাকর বাক্যে, শপথদ্বারা প্রতিযাচিত দ্বারা (আচ্ছা, তুমিই আমাকে গালের পান দাও) এইরূপ প্রার্থনা দ্বারা, কিংবা, কিংবা পাদপতক দ্বারা গ্রহণ করাইবে। লজ্জাযুক্তই হউক, আর অত্যন্ত ক্রোধপরিভুতাই হউক, কামিনী কখনই পাদপতনকে অতিক্রম করিতে পারে না। ইহা সর্বত্রই প্রযোজ্য; (সকল বিষয়েই এইরূপ দেখা যায়) সুতরাং পাদপতনই চরম উপায় জানিবে।।’১১।।
‘সেই তাম্বুলদান প্রসঙ্গে মৃদু (গ্রহণ না করিয়া), বিশদ (সুখস্পর্শকর) এবং অকালহ (বিনাশব্দে) কন্যার অধরে চুম্বন করিবে। কন্যা যদি চুম্বনে সিদ্ধা হয়, তবে তাহাকে আলাপে আনিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। সে সময় যাহা কিছু দেখিয়াছে বা শুনিয়াছে, তাহারই উত্তর শুনিবার জন্য ছোট কথায়, যেন সেটি জানে না, এইভাবে জিজ্ঞাসা করিবে। তাহাতে তূষ্ণীভাবের অবলম্বন করিয়া থাকিতে দেখিলে উদ্বিগ্ন না করিয়া চাটুযুক্ত বহুরূপ প্রশ্ন করিবে। তাহাতেও উত্তর না পাইলে নির্বন্ধ (জেদ) করিবে।।’১২।।
নির্বন্ধ
বিরাগ জন্মিতে পারে;
এজন্য
বলিতেছেন—
‘সমস্ত
কন্যাই পুরুষের প্রযুজ্যমান
বাক্য বিষহ্য করে; কিন্তু
কামের আবির্ভাব হইলেও লজ্জাহেতুক
কতিপয়াক্ষর অন্যার্থশ্লিষ্ট
কথাও বলে না। ঘোটকমুখ এই কথা
বলেন।।’১৩।।
–কথা
বলিতে ইচ্ছা থাকিলেও লজ্জায়
বলিতে পারে না। পুরুষের কথায়
কন্যার বিরাগ কোন ক্রমেই হইতে
পারে না।।১৩।।
কন্যাকে আলাপ
করিবার উপায় কীর্তন করা
হইতেছে—
‘উক্ত
কথার উত্তর পাইবার জন্য পুরুষ
নির্বন্ধাতিশয় করিতে থাকিলে,
শিরঃকম্প দ্বারা
(মাথা
নাড়িয়া) প্রতিবচনের
যোগ (উত্তর)
করিবে। কলহ
হইলে শিরঃকম্প দ্বারা উত্তর
কথা বিধেয় নহে। দোষ খ্যাপন
করাই বিধেয়।।’১৪।।
–‘না’
ও ‘হ্যা’ দুইরূপ শিরশ্চালন
আছে দ্রষ্টব্য। কথা না বলিয়া
যদি কোনরূপ কলহ হইয়া থাকে,
তবে সে সময় আর
শিরশ্চালনা দ্বারা উত্তর
দেওয়া বিহিত নহে।।১৪।।
কলহ যদি না
হয়, অথচ
স্নেহপূর্বক জিজ্ঞাসা করে,
তবে কি প্রকারে
আলাপ করিবে, তাহার
উপায় বলিতেছেন—
‘তুমি
আমাকে চাও, কি
চাও না, আমাকে
বিবাহ করিতে তোমার রুচি ছিল,
কি রুচি ছিল
না, ইহা
জিজ্ঞাসা করিলে, বহুক্ষম
তুষ্ণী থাকিয়ে যখন নিরতিশয়
নির্বন্ধে আবদ্ধ হইয়া পড়িবে,
তখন সেই প্রশ্নের
অনুকূলভাবে শিরশ্চালনা করিবে।
নায়ক যদি প্রতারণার জন্য
বাগ্জাল প্রসারিত করে,
তবে বিবাদ
বাধাইয়া দিবে। শিরশ্চালনা
দ্বারা যখন বলিবে ‘রুচি ছিল
কি না’; তখন
বলিবে ‘না’, যখন
বলিবে ‘ইচ্ছা কর, কি
না’, তখনও
বলিবে ‘না’।।’১৫।।
আর যদি পূর্বের
পরিচয় থাকে, তবে
তাহার আলাপযোজনের বিধি
বলিতেছেন—
‘যদি
সংস্তুতা হয়, তবে
যে সখী অনুকূলা ও উভয়ের বিশ্বস্তা,
তাহাকে মধ্যে
রাখিয়ে কথা আরম্ভ করিবে। সখী
তাহার উত্তর করিলে নায়িকা
অধোমুখী হইয়া হাসিবে। সে যদি
বেশি বাড়াবাড়ি করিয়া অতিরিক্ত
কিছু বলে, তবে
সে সখীকে খুব তিরস্কার করিবে
এবং তাহার সহিত কলহ বাধাইয়া
দিবে। সখী পরিহাসের জন্য,
যাহা নায়িকা
না বলিবে, তাহাও
রচিয়া রচিয়া বলিবে। সেই কথার
সত্যতা জানিবার জন্য সখীকে
ছাড়িয়ে নায়িকার নিকট উত্তর
পাইবার জন্য অভ্যর্থনা করিলে,
তূষ্ণীভাবে
থাকিবে। অতিশয় নির্বন্ধ প্রকাশ
করিলে, ‘আমি
বলিব না’- এই
প্রকার অস্পষ্ট ভাষায় বুঝিতে
পারা যায় বা না যায়, এমনভাবে
বাক্য বলিবে। কখন কখন থাকিয়া
থাকিয়া মধ্যে মধ্যে নায়ককে
অবহাস করিয়া কটাক্ষ পেক্ষণ
করিবে। ইহাই আলাপ যোজন।।’১৬।।
‘এইরূপে পরিচয় হইলে ‘গ্রহণ কর’ না বলিয়া প্রার্থত তাম্বুল বিলেপন ও মাল্য তাহার নিকটে লইয়া দিবে। অথবা নায়কের উত্তরীয়ে (উড়ানিতে) বাঁধিয়া দিবে। সেইরূপে উপযোগপ্রাপ্ত নায়িকার স্তনমুকুলের উপরি আচ্ছুরিতক* বিধানে স্পর্শ করিবে। নিষেধ করিলে ‘তুমিও আমাকে আলিঙ্গল কর, তাহা হইলে আর এমনটি করিব না’, এই কথা বলিয়া আলিঙ্গন-বিধানানুসারে আলিঙ্গন করিবে। নিজের হাত প্রায় লাভি পর্যন্ত প্রসারিত করিয়া আবার ফিরাইয়া লইবে। ক্রমশ ইহাকে (নায়িকাকে) নিজের ক্রোড়ে উঠাইয়া লইয়া অধিক অধিক উপক্রম করিবে। নখ-দশন-ক্ষতাদি গ্রহণ করিতে অস্বীকৃত হইলে ভয় দেখাইতেও প্রবৃত্ত হইবে।।’১৭।।
কি প্রকার ভয়
দেখাইবে?
‘আমি
তোমার অধরে, দন্তপদ
ও স্তনপৃষ্ঠে নখচ্ছেদ্য করিয়া
দিব এবং নিজের গাত্রে সেইরূপ
দাগ করিয়া তোমার সখীজনের নিকটে
বলিব, তুমি
করিয়া দিয়াছ। তুমি তাহাকে কি
বলিবে? এই
প্রকার বালভয়প্রদ বালপ্রত্যায়ন
বাক্যে ধীরে ধীরে ইহাকে
(নায়িকাকে)
প্রতারিত করিবে।
দ্বিতীয় ও তৃতীয় রাত্রে
কৃতবিশ্বাস নায়িকার বক্ষোরুজঘনমূলে
কিছু অধিক পরিমাণে হস্ত যোগ
করিবে।।’১৮।।
হস্তযোগের
উপায় নির্দেশ করিতেছেন—
‘সর্বাঙ্গিক
চুম্বন করিবার উপক্রম করিবে।।’১৯।।
হস্তযোজনবিধি
কহিতেছেন—
‘ঊরুর
উপরে হস্ত বিন্যস্ত করিয়া
সম্বাহনক্রিয়ায় সিদ্ধিলাভ
করিতে পারিলে ক্রমে ঊরুমূলেও
সম্বাহন করিতে প্রবৃত্ত হইবে।
সম্বাহন করিতে নিবারন করিলে
‘দোষ কি’ বলিয়া ইহাকে (নায়িকাকে)
পর্যাকূল করিবে।
তাহা সরাইয়া লইবে। পরে,
তাহা সহ্য হইলে
তাহার (নায়িকার)
গুহ্যদেশ স্পর্শ
করিবে, রশনা
(মেখলা)
খুলিয়া দিবে,
নীবি খুলিয়া
দিবে, বসন
পরিবর্তন করিয়া দিবে এবং
ঊরুমূল সম্বাহন করিবে। এগুলি
নায়ক অন্যচ্ছলে করিবে।
ত্রিরাত্রের পর অন্যের অপদেশ
কর্তব্য। চতর্থী হোমের পর
যন্ত্রযোগ করিয়া রঞ্জিত করিবে;
কিন্তু অকালে
ব্রত খণ্ডন করিবে না এবং তাহার
শিক্ষা না দিয়া চতুঃষষ্টিকলার
শিক্ষা দিবে। ইঙ্গিত ও আকার
দ্বারা নিজের অনুরাগ দেখাইবে।
পূর্বকালীন অনুরাগকর মনোরথ
অনুবর্ণনা করিবে। ভবিষ্যত
কর্তব্য বিষয়ে অনুরুদ্ধ হইলে
অনুকূল প্রবৃত্তি করিবে এবং
তাহার প্রতিজ্ঞা করিবে।
সপত্নীদিগের ভয় বিচ্ছিন্ন
করিয়া দিবে। কালক্রমে কন্যাভাব
পরিত্যাগ করিলে তাহাকে উদ্বিগ্ন
না করিয়াই উপক্রম করিবে।
কন্যাবিস্রম্ভণ প্রকরণ এই
পর্যন্ত।।’২০।।
উক্ত বিষয়ের
উপসংহার করিয়া বলিতেছেন—
এ
বিষয়ে কতকগুলি শ্লোক আছে—
‘এই
উপায়ে বালিকার অভিপ্রায়ানুসারে
প্রসাধন, অর্থাৎ
বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া দিবে।
তাহা হইলে (বালিকা
অত্যন্ত বিশ্বাস সহকারে)
অনুরক্তা হইয়া
পড়িবে।।’২১।।
তাহার বিশেষ
এই—
‘অত্যন্ত
আনুকূল্যে বা অত্যন্ত প্রাতিকূল্যে
প্রবর্তিত হইলে কন্যায় সিদ্ধিলাভ
করিতে পারে না। অতএব মধ্যরীতি
অনুসারে কন্যার প্রসাধন
করিবে।।’২২।।
বিস্রম্ভণের
ফল কি?
‘নিজের
প্রীতিকর, কন্যার
মানবর্দ্ধন এই কন্যাবিস্রম্ভণ
(পরিচয়
ও বিশ্বাস জন্মাইয়া প্রণয়াভিমুখীকরণ)
যে জানে,
সে তাহাদিগের
প্রিয় হয়।।’২৩।।
‘অত্যন্ত লজ্জাবশে যে ব্যক্তি কন্যাকে উপেক্ষা করিবে, সে অভিপ্রায়জ্ঞ নহে বলিয়া পশুর ন্যায় ঘৃণাস্পদ হয়।।’২৪।।
‘যে ব্যক্তির কন্যার অভিপ্রায় না জানিয়া হঠাত উপক্রম করে, তাহার নিকট কন্যা ভয়, বিক্রম, উদ্ধেগ ও দ্বেষ তৎক্ষনাৎই প্রাপ্ত হয়। সে কন্যা প্রীতিযোগ না পাইয়া সেইরূপে উদ্ধেগ-দূষিতা হইয়া হয় পুরুষদ্বিষিণী হয়, না হয়, তাহার উপর বিদ্ধিষ্ট হইয়া তদ্ভিন্নপুরুষগামিনী হয়।।’২৫।।
——————————————–
* আচ্ছুরিত
নখবিলেখনপ্রকরণে দ্রষ্টব্য।