দ্বিতীয় ভাগ – তৃতীয় অধ্যায়
বরণসম্বিধান পূর্বক অধিগত কন্যায় বিস্রম্ভণ কথিত হইয়াছে, কিন্তু যদি বরণের যোগ্যা কন্যা না পাওয়া যায়, তবে সেখানে গান্ধর্বাদি চারিটি বিবাহ বিধান করা হইতেছে। সে স্থলে অলাভের কারণ যতগুলি হইতে পারে, তাহা বলিতেছেন—
‘ধনহীন যে ব্যক্তি, সে অভিজনাদিগুণযুক্ত হইলেও দরিদ্র বলিয়া কন্যালাভ করিতে পারে না। মধ্যস্থগুণ—রূপ ও শীলাদি আছে, কিন্তু অভিজনাদিগুণ প্রধান না থাকায় হীন বলিয়া ব্যপদেশ হওয়ায় কন্যালাভ করিতে সমর্থ হয় না। সধন হইলেও নিজের বাটীর নিকটে বাস করে বলিয়া সীমাদি লইয়া কহল হওয়ায় ধনগর্বেই লাভ করিতে পারে না; মাতা, পিতা ও ভ্রাতা থাকিলে তদধীন থাকায় অন্যপ্রধান বলিয়া সধন হইলেও লাভে অসমর্থ। যাহার আচরণ বালকের ন্যায়, সে গৃহাদিতে প্রবেশাধিকার লাভ করিলেও তাহার উপর বালকাচার বলিয়া ঘৃণিত হওয়ায় কন্যাকে সে বরণ করিতে পারে না, সুতরাং বাল্যকাল হইতেই কন্যাকে অনুরক্ত করিবে। দেখিতে পাওয়া যায়, দক্ষিণাপথে (দাক্ষিনাত্যপ্রদেশে) মাতাপিতৃহীন বালক মাতুলকূলে বাস করিয়া ঘৃণিতপ্রায় হইয়াও সেই উপায়ে ধনের প্রাচুর্যেও অলভ্যা মাতুলকন্যাকে বা অন্যের সহিত বাগদানে আবদ্ধা কন্যাকে সাধন (আয়ত্ত) করিয়া থাকে। বিবাহের যোগ্য অন্য বালিকাকেও স্পৃহাযুক্ত করিতে পারে। এইরূপ হইলে, বালিকাকে ধর্মত লাভ সম্ভব হইতে পারে ও তথায় এই বশীকরণ সুতরাং শ্লাঘনীয়। এই কথা ঘোটকমুখ বলেন।।’১।।
উপক্রমকারী
ব্যক্তি দ্বিবিধ; বালক
ও যুবা। তাহার মধ্যে বালককে
লক্ষ্য করিয়া বলা হইতেছে—
‘তাহার
(সেই
নায়িকার) সহিত
পুষ্পচয়ন, মাল্যগ্রথন,
গৃহস্থালীর
উপযুক্ত পুত্র-কন্যাদি
(কাষ্ঠময়
বা মৃন্ময়) লইয়া
ক্রীড়াযোজন এবং ভাত ও পানীয়
(ধূলিখেলা)
প্রস্তুত করিবে।
পরিচয় ও বয়সের অনুরূপ ব্যবহার
করিবে। পাশকক্রীড়া,
পট্টিকাগ্রথন
(ক্রীড়া),
মুষ্টিদ্যুত
(পরমুট্খেলা)
ও খুল্লকদ্যুত,
মধ্যমাঙ্গুলি
গ্রহণ, ষট্পাষাণকাদি
(ঘুঁটি
খেলা—ছয়টি গুটি লইয়া প্রথমে
একটি তুলিয়া ভুমিস্থ,
আর একটি কুড়াইয়া
লইয়া তৎক্ষনাত পতমান,
সে গুঁটিকে
হাতের পৃষ্ঠে ধরা এবং ক্রমে
ছয়টিই শূণ্যে তুলিয়া এক সহযোগে
ধরা, আবার
একটি দুইটি করিয়া মাটিতে রাখা।
ইহা আভ্যাসিক-ক্রীড়া,
এতদ্ভিন্ন আরও
স্ত্রীপরম্পরা যাবতীয় খেলা।)
সেই সেই দেশে
প্রসিদ্ধ যে সকল খেলা আছে,
সেগুলো
তত্তদ্দেশবাসিজনগনের আয়ত্ত
বলিয়া যে-সকল
দাস ও দাসী থাকিবে,
তাহাদিগের
সহিত ক্রীড়া করিবে। তারপর
অবসর মতে কন্যার সঙ্গেও খেলা
করিবে। যে-সকল
খেলায় অঙ্গের ব্যায়াম হয়,
যেমন,
সুনিমীলিতকা
(চোর-চোর
বা পলাপলিখেলা), আরব্ধিকা
(কৃষ্ণফল
ক্রীড়া), লবণবীথিকা
(লবণহট
নামে খ্যাত পশ্চিমদেশ)
অনিলতাড়িকা
(পক্ষীর
ন্যায় বাহুদ্বয় প্রসারিত
করিয়া চক্রের ন্যায় ভ্রমণ),
গোধূমপুঞ্জিকা,
(পাঁচজনের মধ্যে
একজন, পাঁচজনের
কাছে পয়সা, টাকা,
সিকি বা দুয়ানী
লইয়া, ধান্যাদির
সহিত মিলাইয়া, পাঁচভাগ
করিয়া রাখিবে, পরে
যে যেটি ইচ্ছা ডাকিয়া লইবে।
তাহাতে যাহার ভাগে পয়সা আদি
কিছুই নাই, সে
সেই অংশ পরিমান পয়সা আদি মূল
ব্যক্তিকে দিবে। (প্রমারাখেলা,
তেতাসখেলা,
কূপনখেলা
ইত্যাদি তাহারই প্রতিরূপ।)
অঙ্গুলিতাড়িতকা,
(একজনের চক্ষু
ঢাকিয়া রাখিয়া তাহার কপালে
বা মস্তকে অঙ্গুলি প্রহার
করিয়া ‘কে মারিল?’ এই
প্রশ্ন করিয়া হাস্য করা)
এইরূপ দেশপ্রচলিত
নানাবিধ ক্রীড়া তাহার সখীগণের
সহিত করিবে।।’২।।
যুবকেরা প্রায়শ
যে সকলে ক্রীড়া করে, তাহার
কথা বলিতেছেন—
‘কন্যার
নিকট যে স্ত্রী বিশ্বস্ত বলিয়া
মনে করিবে, তাহার
সহিত অবিচ্ছিন্ন প্রীতি করিবে,
সে যে তাহার
কার্য করিতে প্রস্তুত আছেম
তাহা বুঝিয়া করিবে। কন্যার
ধাত্রীর দুহিতাকে তৎকালে
সুখকর এবং পরিণামহিতকর ব্যাপার
দ্বারা অধিকভাবে আবদ্ধ করিবে।
ধাত্রীর কন্যা নায়কের অভিপ্রায়
বুঝিতে পারিয়াও নায়ককে
প্রত্যাখ্যাত না করিয়া নায়িকার
সহিত মিলিত করিয়া দিতে পারে।
তুমি এই কামযাগের আচার্যকর্ম
কর, একথা
না বলিলেও অভিপ্রায় অনুভব
করিয়া করিতে পারে। নায়কের
মনোগত ভাব বুঝিতে না পারিলেও
নায়িকাকে তাহার গুণের বর্ণনা
করিয়া, নায়িকাকে
নায়কের প্রতি অনুরাগিণী করিতে
পারে; অনুরক্ত
হইলে ইহা তাহার শক্তির অতীত
নহে। প্রযোজ্য নায়িকার যে যে
বিষয়ে অভিলাষ, তাহা
জানিয়া সম্পাদিত করিবে।
ক্রীড়নক দ্রব্য, যাহা
অপূর্ব ও অন্য নায়িকার অতি
বিরলই আছে, তাহা
ইহাকে অনায়াসে উপহার দিবে।
সেই উপহারে নানাপ্রকার চিত্রে
চিত্রিত বহুপরিমাণে অনেক
সময়ে অন্য অন্য আকারের কন্দুক
সন্দর্শন করাইবে। সেইরূপ
সূত্রময়ী, কাষ্ঠময়ী,
শৃঙ্গময়ী,
গজদন্তময়ী
পুত্তলিকা, মধুচ্ছিষ্টময়ী
(মোমের),
পিষ্টকময়ী ও
মৃন্ময়ী পুত্তলিকাও সন্দর্শন
করাইবে। ভক্তপাকের জন্য
মহানসিকদ্রব্যাদি (হাঁড়ি,
কলসী,
মালসা,
বেড়ি)
প্রভৃতির
সন্দর্শন করাইবে। কাষ্ঠময়
স্ত্রী ও পুরুষ সম্প্রযুক্তভাবে
বিনির্মিত করিয়া এবং কাষ্ঠময়
দেবকুল ও দেবগৃহ প্রস্তুত
করিয়া সন্দর্শন করাইবে।
মৃত্তিকা, বংশবিদল
ও দারু নির্মিত শুক,
পারাবত,
মদনসারিকা,
লাবক,
কুক্কুট এবং
তিত্তিরি পক্ষিযুক্ত পিঞ্জর
প্রস্তুত করাইয়া এবং
বিচিত্রাকৃতিসংযুত জলপাত্রসকল,
নানাবিধ যন্ত্র,
ক্ষুদ্রবীণা,
হিন্দোলিকাসকল
দেখাইবে। অলক্তক, মনঃশিলা,
হতিতাল,
হিঙ্গুর এবং
শ্যামবর্ণক (চিত্রের
জন্য রাজাবর্তচূর্ণ)।
আর চন্দন ও কুষ্কুম, পান
ও সুপারি, যে
সময়ে যেরূপ উপযোগী তাহাও
দেখাইবে। আর শক্তি থাকিলে
নায়িকাকে প্রচ্ছন্নভাবে দানও
কর্তব্য। তদ্ভিন্ন যে-সকল
দ্রব্য প্রকাশ করিবার যোগ্য,
তাহা প্রকাশ্যভাবেই
দিবে। তাহা হইলে সকলেরই অভিপ্রায়
বর্ধণকারী বলিয়া এই নায়ককে
সকলে মনে করে, তাহা
যত্নসহকারে কর্তব্য। এইরূপে
প্রচ্ছন্নদেশে একবার দেখিবার
জন্য প্রার্থনা করিবে।
প্রচ্ছন্নদেশে পাইলে প্রচ্ছন্নভাবে
কথা কহিবার চেষ্টা করিবে।
গোপনে দান করিবার কারণ নিজে
গুরুজনের (তাহার
পিতার মাতার) ভয়
করিয়া থাকে, ইহাই
বলিবে। যাহা দিবে, তাহা
যেন আরও অন্যে পাইবার জন্য
যথেষ্ট চেষ্টা করিয়াছিল ও
করিয়া পায় নাই, ইহাও
বলিবে। যে সমস্ত গল্পে নায়িকার
বেশ অনুরাগ আছে জানিবে,
অনুকূল মনোহারী
সুন্দর সুন্দর সেই সকল গল্প
করিবে। তাহাতে অনুরাগ বর্ধণ
করা হইবে। কোনও বিস্ময়কর বিষয়ে
প্রসক্তি আছে জানিলে,
ইন্দ্রজাল
প্রয়োগ দ্বারা বিস্মিত করিবে।
কলার কৌশলে অনুরাগিনী হইলে,
তৎকৌশল প্রদর্শন
এবং গীতপ্রিয় হইলে,
শ্রুতিসুখকর
সঙ্গীত দ্বারা মনোরঞ্জন করিবে।
কোজাগরদিনে, অগ্রহায়ণমাসের
কৃষ্ণাষ্টমীদিনে,
কৌমুদীদিনে,
উৎসবে,
যাত্রায়,
গ্রহণে এবং
গৃহাচারে আচারগতা নায়িকার
বিচিত্র আপীড় ও সিক্থক নির্মিত
কর্ণপত্রভঙ্গ, বস্ত্র,
অঙ্গুলীয়ক ও
ভূষণাদিদান করিয়াও মনোরঞ্জন
করিবে। যদি তাহাতে কোনও দোষ
হইবে মনে না করে, তাবেই
ইহা করিতে পারে। ধাত্রেয়িকা
যদি মনে করে যে, তদ্দ্বারা
তাহার বিশেষরূপ অনিষ্ট হইবে,
তবে তাহা করিবে
না। অন্য পুরুষ অপেক্ষা এটি
বিশেষ, এইরূপ
জানিয়া সেই ধাত্রেয়িকা সেই
নায়িকার সেই পুরুষে প্রবৃত্তি
বিষয়ে উপযোগকর চতুঃষষ্টি
কলার গ্রহণ করাইবে। সেই সকল
কলার গ্রহণ বিষয়ে উপদেশ দ্বারা
নিজের রতিকৌশলাভিজ্ঞতার বিষয়
প্রযোজ্যার নিকট প্রকাশিত
করা হইবে। নিজে উদারবেশ গ্রহণ
করিবে, যেন
নিজেকে দেখিতে কোনপ্রকারে
অসৌষ্ঠব প্রকাশ না পায়। নায়কের
বেশভূষা দেখিয়া নায়িকা অনুরাগ
প্রকাশ করিলে তাহা তাহার
ইঙ্গিত ও আকার দ্বারা বুঝিয়া
লইবে। যুবতীগণ পরিচিত হইলে
প্রথমে সর্বদা দেখিতে শুনিতে
ইচ্ছা করে; কিন্তু
তাদৃশ কামনা করিলেও লজ্জাবশত
অভিযোগ করিতে পারে না। ইহা
প্রায়িক।।’৩।।
এই পর্যন্তই বালাতে উপক্রম নামক প্রকরণ।
নায়িকা ভাব
করিলে ইঙ্গিত ও আকার দ্বারা
তাহা বুঝিয়া লইবে, ইহা
বলা হইয়াছে। এক্ষণে সেই
ইঙ্গিতাকারের বিষয় বলিবেন—
‘সেই
সকল ইঙ্গিত ও আকার কি প্রকার,
তাহা বলিব।।’৪।।
–তাহার
মধ্যে ইঙ্গিত, অন্যথাবৃত্তি;
শারীরিক ও
মানসিক ভেদে তাহা দ্বিবিধ।
শারীরিক ইঙ্গিত কটাক্ষপাতাদি
এবং মানসিক ইঙ্গিত
শ্লিষ্টবাক্যপ্রয়োগাদি।
ইহাকে বাচনিক ইঙ্গিতও বলাইয়া
থাকে। ভাষ্যকার বলেন,
মুখনয়নারাগ
আকার।।৪।।
‘সম্মুখভাবে তাহাকে দেখে না। দৃষ্টা হইলে লজ্জা দেখায়। রুচিকর নিজের অঙ্গ প্রাবরণের অপদেশে প্রকাশিত করে। নায়ক অনবহিত বা একাকী থাকিলে কিংবা দূরগত হইলে দেখে। কোনও কথা জিজ্ঞাসা করিলে একটু মিচ্কে-হাসি হাসিয়া অস্ফুটভাবে অর্থহীনপ্রায় কথা অধোমুখী হইয়া ধীরে ধীরে বলে। নায়কের নিকট অধিকক্ষণ থাকিতে ভালোবাসে। দূরে থাকিয়া ‘আমাকে একটু দেখুক’ মনে করিয়া বদনবিকারের সহিত পরিজনের নিকট কথা বলিতে থাকে। সে স্থান ছাড়ে না। যাহা কিছু একটা দেখিয়া বিশেষ হাস্য করে। অবস্থানের জন্য সে বিষয়ের কথা পাড়িয়া দেয়। ক্রোড়স্থিত বালককে আলিঙ্গন ও চুম্বন করে। নায়ককে দেখিয়া পরিচারিকার তিলক রচনা করিয়া দেয়। পরিজনকে আশ্রয় করিয়া সেই সেই লীলা দেখায়। নায়কের পরিচারকের সহিত প্রীতিকর সঙ্কথা (গল্পাদি) ও দ্যুতক্রীড়াদিও করে। নিজের কর্মেও প্রভূর ন্যায় তাহাদিগকে নিযুক্ত করে। তাহারা নায়কের সঙ্কথা অন্যের নিকট বলিতে থাকিলে তাহা অবহিত হইয়া শ্রবণ করে। ধাত্রয়িকা বলিলে নায়কের গৃহে প্রবেশ করে। ধাত্রয়িকাকে মধ্যে রাখিয়ে নায়কের সহিত দ্যুতক্রীড়া ও আলাপ করিতে ইচ্ছা করে। অলঙ্কুত না থাকিলে নয়নপথ পরিত্যাগ করে। কর্ণপত্র, অঙ্গুলিয়ক, বা মাল্য নায়ক প্রার্থনা করিলে খুব ধীরে গাত্র হইতে খুলিয়া সখীর হস্তে দেয়। নায়ক যাহা দিয়াছে, তাহা প্রত্যহই ধারণ করে। অন্যবরের সঙ্কথা উপস্থিত হইলে, বিষন্ন হয়। অন্যবরপক্ষের সহিত সংসৃষ্ট হইতে চাহে না।।’৫।।
প্রকরণদ্বয়ের
উপসংহার করিতেছেন—
‘এই
বিষয়ে দুইটি শ্লোক আছে,
কন্যার
সেই সেই ভাব সংযুক্ত আকার ও
ইঙ্গিত দেখিয়া সম্প্রয়োগের
জন্য সেই সেই প্রয়োগের চিন্তা
করিবে।।’৬।।
‘বালক্রীড়ানক দ্বারা বালাকে, কলাদ্বারা যৌবনস্থিতা তরুণীকে এবং পৌঢ়াকে তাহার বিশ্বাস্যলোকের সংগ্রহ করিয়া আয়ত্ত করিতে চেষ্টা করিবে।।’৭।।
ইতি ইঙ্গিতাকার সূচনামক প্রকরণ।।