১.২ ত্রিবর্গপ্রতিপত্তিঃ (জীবনের তিন লক্ষ্য)

'পুরুষের পরমায়ু কাল শতবর্ষ মাত্র। –শ্রুতি এর প্রতিপাদন করে থাকেন। অতএব পুরুষ শতায়ু বলে আয়ুকালের বিভাগ করে অনোন্যানুবদ্ধ অথবা পরস্পরসম্বন্ধ এবং পরস্পরের অনুপঘাতক ত্রিবর্গের অনুষ্ঠান করবে'।।১।।

'বাল্যকালে বিদ্যাগ্রহণাদি অর্থের সেবা করবে'।।২।।

'এইরূপ,–যৌবনে কামের সেবা'।।৩।।

'স্থবিরকালে ধর্ম ও মোক্ষের'।।৪।।

'অথবা, আয়ুর 'বাঁধাবাঁধি' নিয়ম না থাকায়, যা উপপন্ন (উচিত) বলে মনে করবে, তারই সেবা করবে'।।৫।।

'বিদ্যাগ্রহণ পর্যন্ত ব্রহ্মচর্যের সেবা করতেই হবে'।।৬।।

'যজ্ঞাদি কর্ম লোকে অপ্রসিদ্ধ এবং তার ফলও প্রত্যক্ষের অযোগ্য বলে পূর্বে প্রবর্তিত হয়নি, শাস্ত্রানুশাসনে যে তার প্রবর্তন এবং মাংস ভক্ষণাদি লোক প্রসিদ্ধ ও তার ফলও প্রত্যক্ষযোগ্য বলে পূর্বে প্রবর্তিত হয়ে আছে, শাস্ত্রানুশাসন প্রভাবে যে তার নিবারণ,–তাইই ধর্ম'।।৭।।

'শ্রুতি হতে বা ধর্মজ্ঞ সমবায় হতে তার অবরোধ করবে'।।৮।।

'বিদ্যা, ভূমি, হিরণ্য, পশ্‌ ধান্য, ভাণ্ডোপস্কর এবং মিত্রাদির অর্জন ও অর্জিতের বিবর্ধন—অর্থ'।।৯।।

'অধ্যক্ষপ্রচার বার্ত্তাশাস্ত্র হতে, বার্ত্তাশাস্ত্রের সঙ্কেতাভিজ্ঞগনের নিকটে এবং বনিকগণের সমীপে তার উপদেশ লয়ে জানবে'।।১০।।

'আত্মসংযুক্ত মন দ্বারা অবষ্ঠিত শ্রোত্র, ত্বক, চক্ষু, জিহ্বা ও ঘ্রাণের স্ব স্ব বিষয়ে অনুকূলভাবে প্রবৃত্তি—কাম'।।১১।।

'বিশেষ কাম দ্বিবিধ;–প্রধান ও অপ্রধান। তদুভয়ই দেখাচ্ছেন,–স্ত্রী বা পুরুষের স্পর্শবিশেষকে লক্ষ্য করে অভিমানিক সুখে অনুবিদ্ধ, ফলবান, বিষয়বোধই প্রধান কাম'।।১২।।

'কামসূত্রের অধ্যয়ন বা নাগরিকজনের সমবায় (বৈঠক বা সভা) হতে সেই কামের বিষয় জেনে নেবে'।।১৩।।

'এদের সন্নিপাত উপস্থিত হলে পূর্ব পূর্বকে গুরুতর বলে মনে করবে'।।১৪।।

সকলের পক্ষেই যে এই বিষির বিষয়তা খাটবে, এমন নয়,–
'রাজার পক্ষে অর্থই গরীয়ান সেহেতু লোকযাত্রা অর্থমূলক। আর বেশ্যার পক্ষেও অর্থই গরীয়ান। ত্রিবর্গ-প্রতিপত্তি-প্রকরণের এই স্থানেই পরিসমাপ্তি'।।১৫।।

'ধর্ম যখন লোকপ্রসিদ্ধ বস্তু নয়, তখন তার প্রাপ্তি বিষয়ে যে কিছু উপায় আছে, তৎ সম্বন্ধে বিধি ব্যবস্থা করা শাস্ত্রের পক্ষেই যুক্তিযুক্ত। কারণ, কোন বিষয়ের অভীষ্ট ফললাভ করতে হলে, তার প্রকৃষ্টতম উপায়ের অবলম্বন করা আবশ্যক। সে উপায় শাস্ত্র হতে জানতে পারা যায়। অর্থসিদ্ধিও উপায় দ্বারা হয়ে থাকে এবং সেই উপায় শাস্ত্রেই কথিত হয়েছে; সুতরাং শাস্ত্র হতে সে উপায় জানতে হয়'।।১৬।।

'আচার্যগন বলে থাকেন,–তির্যগ্‌যোনিতেও কাম স্বয়ংই প্রবৃত্ত হয় এবং তা আত্মার একটি নিত্যসিদ্ধ কর্ম; সুতরাং কামাববোধার্থ শাস্ত্রের কোন প্রয়োজন নাই'।।১৭।।

স্বীয়মত দেখাবার জন্য যুক্তি ও তর্ক দেখাচ্ছেন,–
'কাম স্ত্রী-পুরুষের সম্প্রয়োগাধীন বলে উপায়কে অপেক্ষা করে'।।১৮।।

'সেই উপায়জ্ঞান কামসূত্র হতে হবে, এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন'।।১৯।।

তবে গবাদি পশুতে কিরূপে কামের পূর্ণ বিকাশ দেখা যায়?–
'তির্যকযোনিতে স্ত্রীজাতির আবরণ না থাকায় এবং ঋতুকালে যতদূর আবশ্যক, ততদূর প্রবৃত্তি হয়, তাও অজ্ঞানপূর্বক হয় বলে উপায় ব্যতীতও প্রবৃত্তি বা সম্প্রয়োগ হতে পারে'।।২০।।

ধর্ম বিষয়ে বিপ্রতিপত্তি দেখাচ্ছেন,–
'ধর্মাচরণ করার প্রয়োজন নাই;–কারণ তার ফল ইহজন্মে পাওয়া যায় না এবং যজ্ঞাদি সাধিত হলেও ফল হবে কিনা, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে'।।২১।।

উক্ত হেতুদ্বয়ের মধ্যে প্রথমটিতে লোকপ্রসিদ্ধি দেখান হয়েছে,–
'মূর্খ ভিন্ন কোন্‌ ব্যক্তি হস্তগত দ্রব্যকে পরগত করে?'।।২২।।

'আগামী কল্যকার ময়ূর লাভ অপেক্ষা অদ্যকার পারাবত লাভ মন্দের মধ্যে ভাল'।।২৩।।

'সংশয়সঙ্কুল হেমশত লাভ অপেক্ষা নিঃসন্দেহে এক কার্যাপণ লাভও মন্দের ভাল।–একই কথা নাস্তিকেরা বলে থাকে'।।২৪।।

'শাস্ত্রের উপর আশঙ্কাপ্রকাশ করতে পারা যায় না, অভিচার ও শান্তিকপৌষ্টিকাদির ফল কখনও কখনও দেখতে পাওয়া যায়, লোকের শুভাশুভ প্রদর্শনার্থই যেন বুদ্ধিপূর্বক লক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য-গ্রহচক্রের প্রবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায়, লোকযাত্রা বর্ণাশ্রমাচারঘটিত এবং ভবিষ্যত শস্যলাভার্থ বীজ হস্তগত হলেও ভূমিতে বপন করা হয় দেখতে পাওয়া যায়।–এই হেতু ধর্মাচরণ করবে,–এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন'।।২৫।।

অর্থবিষয়ে বিরুদ্ধবাদীর মত দেখাচ্ছেন,–
'অর্থের আচরণ করার প্রয়োজন নাই; কারণ যথাসাধ্য চেষ্টা করলেও কদাচিত অর্থসিদ্ধি হয় না, আর যত্ন না করলেও কদাচিত আপনা-আপনি হয়'।।২৬।।

ভাল, অকস্মাত যে উপস্থিত হয়, তা কে করে দেয়?—এই কথার উত্তরে বলেছেন,–
'সে সব কালে করে দেয়। ইহাই সিদ্ধান্ত'।।২৭।।

তাই দেখিয়ে বলেছেন,–
'কালই পুরুষের অর্থ ও অনর্থের, জয় ও পরাজয়ের এবং সুখ ও দুঃখের ব্যবস্থাপন করে থাকনে'।।২৮।।

এবিষয়ে লোকপ্রসিদ্ধি দেখাচ্ছেন,–
'কালকে যারা কারণ বলে মানেন, তার বলেন,–কাল বলিকে ইন্দ্র করেছিলেন, কালই বিপরিবর্তিত হয়ে বলিকে ইন্দ্রপদ হতে অপসারিত করে পাতালে পাঠিয়েছিলেন। আবার কালই একে ইন্দ্র করবেন'।।২৯।।

এবিষয়ে সম্প্রতিপত্তি দেখিয়েছেন,–
'অর্থসিদ্ধির প্রতি উপায়ই কারণ,–যেহেতু সমস্ত প্রবৃত্তিও পূর্বে পুরুষকার দেখতে পাওয়া যায়'।।৩০।।

যেহেতু,–
'কোনও বিষয় অবশ্যম্ভাবী হলেও উপায়ের অবলম্বন করেই তা লাভ করতে হয়, তাই নিষ্কর্মার ভদ্র নাই,–এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন'।।৩১।।

কাম বিষয়ে বিরুদ্ধবাদীর মত দেখাচ্ছেন,–
'কামের সেবা করবে না; যেহেতু ধর্ম ও অর্থ হতে কামের উৎপত্তি বলে ধর্মার্থই প্রধান। কামের সেবা করলে কাম সেই প্রধানের (বিরোধী) শত্রু হয়ে দাঁড়ায় এবং অন্য মতেরও বিরোধী হয়। এরা অনর্থ জনের সহিত সম্পর্ক, অসদ্ব্যবসায়, অশৌচ ও অপ্রভাবকে জন্মায়'।।৩২।।

'সেইরূপ—শরীরের উপঘাত, মানের লাঘব, অবিশ্বাস ও হেয়তাকেও জন্মায়'।।৩৩।।

'অনেকে কামবশগত হয়ে সগণেই বিনষ্ট হয়েছে শুনতে পাওয়া যায়'।।৩৪।।

ইহা দৃঢ় করার জন্য আখ্যান বলছেন,–
'যেমন দাণ্ডক্য নামে ভোজবংশে জাত এক রাজা কামবশত ব্রাহ্মণকন্যায় আসক্ত হয়ে বন্ধু ও রাষ্ট্রের সহিত বিনষ্ট হয়েছিল'।।৩৫।।

'দেবরাজ ইন্দ্র অহল্যায়, অতিবল কীচক দৌপদীকে, রাবণ সীতায় এবং আরও আরও অনেককে দেখতে পাওয়া যায়, কামবশগত হয়ে বিনষ্ট হয়।–এই কথা অর্থচিন্তকেরাও বলে থাকেন'।।৩৬।।

এ বিষয়ে সম্প্রপত্তি দেখাচ্ছেন,–
'শরীরের স্থিতিহেতু বলে কাম আহারাদির সমানধর্মা এবং ধর্ম ও অর্থের ফল যে কাম'।।৩৭।।

এইরূপ যদি হয়, তবে তো দোষপ্রসঙ্গ উপস্থিত,–
'অজীর্ণাদিদোষে যেমন বুঝে আহারাদি করতে হয়, সেইরূপ বুঝতে হবে। ভিক্ষুকগন আছে বলে হাঁড়ী চড়াবে না, এরূপ নহে। অথবা মৃগগন আছে বলে যব বপন করবে না, এরূপও নহে।–বাতস্যায়ন এই কথা বলেন'।।৩৮।।

অনুষ্ঠানলক্ষণ প্রতিপত্তির ফল বলছেন,–
'এ বিষয়ে অনেকগুলি শ্লোক আছে—
এইরূপে অর্থ, কাম ও ধর্মের সেবা করে মানব ইহকাল ও পরকালে বাধাহীন অত্যন্ত সুখভোগ করতে পারে'।।৩৯।।

'পরস্পরের অনুপঘাতক ও অন্যোন্যনুবদ্ধ, এই কথা ইতপূর্বে বলে হয়েছে। তারই সংগ্রাহক শ্লোক–
যে কার্যে পরকালে কি হবে, এই আশঙ্কা না জন্মায়, অর্থের হানি না করে এবং সুখও হয়, ত্রিবর্গবিত্‌ শিষ্টগন তাদৃশ সুখকর কার্যেই নির্ভর করেন। যে কার্য ত্রিবর্গের, দ্বিবর্গের বা একবর্গেরও সাধক, তারা সেবা করবে; কিন্তু যে কার্য দ্বিবর্গের বাধক ও একবর্গের সাধক, সেরূপ কর্ম করবে না'।।৪০।।

ইতি শ্রীমদ্‌-বাৎস্যায়নীয় কামসূত্রে সাধারণনামক প্রথমাধিকারণে ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি নামক দ্বিতীয় অধ্যায় সম্পূর্ণ।।২।।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2