ভুমিকা

বাৎস্যায়ন একজন অসাধারণ প্রতিভাশালী মননপর ব্যক্তি বলিয়া প্রসিদ্ধ। তিনিই নীতিশাস্ত্র-প্রণেতা-চাণক্য। তিনি শব্দশাস্ত্রে বিষ্ণুশর্মা এবং তিনিই নীতিশাস্ত্রে কৌটিল্য বলিয়া বিশেষ প্রথিত। কি নীতিশাস্ত্রে, কি শব্দশাস্ত্রে, কি ন্যায়শাস্ত্রে, যখন যে শাস্ত্রেই বাৎস্যায়ন পরিচয় দিতে প্রস্তুত হইয়াছেন, তখনই তিনি সেই শাস্ত্রে অসাধারণ প্রতিভার বিকাশ করিয়াছেন। রাজনীতিক্ষেত্রেও আমরা বাৎস্যায়নের অলৌকিক প্রতিভার কথা ভূয়সী শুনিয়াছি, সুতরাং পৃথিবীতে, বিশেষত ভারতবর্ষে বাৎস্যায়নের ন্যায় প্রতিভাশালী মননপর-ব্যক্তি অতি বিরল জন্মপরিগ্রহ করিয়াছেন বলিলেও অত্যুক্তি হয় না।

২৫৮৫ বৎসরের বহুপূর্বে বাৎস্যায়ন পাঞ্জাবের অন্তর্গত তক্ষশিলা নামক গ্রামে ধনধান্যসম্পত্তিশালী মহা-গৃহস্থ ব্রাক্ষ্মণবরেন্য মহাত্মা নামক ব্রাক্ষ্মণের ঔরসে জন্মগ্রহন করিয়াছিলেন। এই মহামুনি বাৎস্যায়নই তাহার স্বীয় অসাধারণ নীতিজ্ঞান প্রতিভাবলে মৌর্যবংশের আদিপুরুষ চন্দ্রগুপ্তের মগ্ধ বা বিহারের রাজধানী পাটলীপুত্র নগরে নন্দবংশের সিংহাসনে আরূঢ় করাইয়াছিলেন। সুরগুর মহানীতিজ্ঞ বৃহস্পতি যেমন অর্থ-মীমাংসা, মহর্ষি জৈমিনি যেমন ধর্মমীমাংসা এবং বেদব্যাস মুনিপ্রবর বাদরায়ন যেমন মুক্তিমীমাংসা বা ব্রক্ষ্ম-মীমাংসাপ্রণয়ন করিয়া আপামরসাধারণকে ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষর অধিকার প্রদান করিয়াছেন, সেইরূপ এই পরমনীতিবিশারদ মহামতি মহামুনি বাৎস্যায়নও কাম-মীমাংসা এই কামসূত্রগুলির মধ্যে গ্রন্থিত করিয়া লোকযাত্রা বা সংসারযাত্রা নির্বাহের সুদুর্লভ গ্রন্থ এককালে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন করিয়া দিয়া গিয়াছেন। এই কামসূত্রের উপসংহার ভাগীয় শ্লোক মধ্যে দেখিতে পাওয়া যায় যে, মহামুনি বাৎস্যায়ন ২৪২২ কল্যব্দে, অর্থাৎ ২৫৮৫ বা তার পূর্বে এই গ্রন্থখানি সঙ্কলন করিয়া সমগ্র ভারতবাসীর হৃদয়ে একটি নতুন ভাবের উন্দীপনার আবির্ভাব করিয়া দিয়াছিলেন। কোন্ সময়ে চন্দ্রগুপ্তকে নন্দবংশের সিংহাসনে চানক্য আরুঢ় করাইয়াছিলেন এবং চাণক্য কোন সময়ে প্রাদুর্ভুত হইয়াছিলেন, এযাবত কোন পন্ডিতই তাহার স্ত্রির সিন্ধান্তে উপনীত হইতে পারেন নাই। ইহার সিদ্ধান্ত না হইলেও কামসূত্রের রচনার সময় নির্ধারণ করা দুষ্কর, সুতরাং এ বিষয়ের আলোচনা আবশ্যক। স্কন্ধপুরাণের কুমারিকা খন্ডে ৩৯ অধ্যায়ে লিখিত হইয়াছে-

'ততস্ত্রিষূ সহস্ত্রেষূ দশাধিকশতত্রয়ে।
ভবিষ্যং নন্দরাজ্যঞ্চ চাণক্যো যান্ হানষ্যতি।।'

তারপর ৩৩১০ বর্ষ হইলে নন্দের রাজ্য হইবে। চাণক্য নন্দগণকে বিনাশ করিবে। বাৎস্যায়নের মতে পুরুষের প্রয়োজন তিনটি- ধর্ম, অর্থ ও কাম। তন্মদ্যে ধর্মই শ্রেষ্ঠ। অর্থ ও কামের মধ্যে অর্থ প্রধান এবং ধর্ম ও অর্থ অপেক্ষা কাম নিকৃষ্ট। তথাপি যৌবনে কামের সেবা করিতে উপদেশ দিয়াছেন। বাল্যে অর্থের সেবা ও বার্ধক্যে ধর্মের আচরণ করাই কর্তব্য। যদি যোগ্যতায় কুলায়, তবে যৌবনে ও বার্ধক্যে ধর্ম, অর্থ ও কামের সহযোগে সেবা করিতে পারা যায়, কিন্তু বাল্যে ধর্ম ও অর্থের সেবা করিতে পারিলেও কামের সেবা কিছুতেই করিতে পারে না। কামসূত্রে মধ্যে এই নিয়মটি লিপিবদ্ধ করিয়া দিয়াছেন। পরন্তু এই নিয়ম উল্লঙ্ঘন করিলে অধর্ম হয়, বিদ্যাগ্রহণে ব্যাঘাত জন্মে-প্রভৃতি বহুদোঘের উল্লেখ করিতেও ত্রুটি করেন নাই। বর্তমান১৩১৩ সালে কলির ৫০০৭ অব্দ চলিতেছে; সুতরাং কুমারিকা খন্ডের মতে ৫০০৭-৩৩১০=১৬৯৭ বর্ষ পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত রাজা হন। তাহার কিছুপূর্বেই চাণক্য আর্বিভূত হইয়াছিলেন। (কেহ কেহ এই প্রকার স্থির করিয়াছেন, কিন্তু উক্ত শ্লোকের ব্যাখ্যা ঠিক ঐরূপ নহে। পরে ইহার ব্যাখ্যা করা যাইবে।)

পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্ববিদগণ তাহাদিগের কল্পনায় স্থির করিয়াছেন, যখন আলোক সান্দারের সময় চন্দ্রগুপ্তের রাজা হইয়াছিলেন, তখন তাহার বয়স অল্প এবং খৃষ্টপূর্ব ৩২ বর্ষ সময়ে মহাবীর আলোকসান্দার পাঞ্জাবে পদার্পন করেন; সুতরাং বর্তমান ১৯০৬ খৃষ্টাব্দ হইতে গণনা করিতে হইলে ১৯০৬+৩২৭=২২৩৩ বর্ষ হয়। এই ২২ শত ৩৩বর্ষ পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত রাজা হন এবং এই সময়েই আলোকসান্দারের শিবিরে থাকিয়া গ্রীকদিগের সমরকৌশল শিক্ষা করিয়াছিলেন। অতএব চাণক্যও তৎকালে বা হার কিছুপূর্বেই প্রাদুর্ভুত হইয়াছিলেন। কাহারও মতে ৩১৬ খৃষ্ট পূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত চাণক্য নামক একজন অসাধারণ বুদ্ধিমান মন্ত্রীর সাহায্যে নন্দবংশ বিনষ্ট করিয়া মগধের রাজা হইয়াছিলেন। সুতরাং ১৯০৬+৩১৬=২২২২ বর্ষ পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্য প্রাদুর্ভুত হইয়াছিলেন। জষ্টিনস্ লিখিয়াছেন-৩১৭ খৃষ্ট পূর্বাব্দে চন্দ্রগুপ্ত জাতীয় স্বাধীনতা উদ্ধারের জন্য দেশীয় সামন্তবর্গকে উত্তেজিত করিয়া ভারত হইতে গ্রীকদিগকে বিতাড়িত ও পঞ্জাব অধিকার করেন। এই কার্য অবশ্যই চাণক্যের ‍রাজনৈতিক প্রতিভার প্রভাবেই ঘটিয়াছিল; সুতরাং অধুনা খুঃ অঃ ২২২৩ বর্ষ পূর্বেই চাণক্যের আবির্ভাব হইয়াছিল উইলসন, কোলব্রূক, টার্ণার, প্রিন্সেপ প্রভৃতি পাশ্চাত্য প্রত্নতত্ত্ববিদগণও চন্দ্রগুপ্তের প্রকৃত সময় নিরুপনে যথেষ্ট আয়াস স্বীকার করিয়াছেন, অবশেষে প্রসিদ্ধ বৌদ্ধশাস্ত্রবিদ্ রিস্ডোডিভ স্থির করেন যে, চন্দ্রগুপ্ত প্রায় ৩২০ খৃষ্ট পূর্বাব্দে রাজা হন। তাহা হইলে ২২২৬ বর্ষ হয়। এই ২২২৬ বর্ষ পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত ও চাণক্যের আবির্ভাব কাল নির্ণয় করিতে হয়। এই ক্ষণে দেখা যাইতেছে যে, পূর্বোক্ত মতগুলির মধ্যে কোনটির সহিত কোনটিরও মিল নাই, সুতরাং এক্ষেত্রে কেহই ঐ সকল মত সত্য বলিয়া স্থির করিতে কিংবা স্বীকার করিতে পারেন নাই। এই কামসূত্র মধ্যে প্রধাণত কামের মীমাংসা থাকিলেও ধর্ম ও অর্ধর সম্বন্ধ ছাড়িয়া দেওয়া হ্য় নাই। বাৎস্যায়ন প্রথমেই সংক্ষেপে প্রতিপাদ্য বিষয়গুলি তালিকার আকারে উপস্থাপিত করিয়া তাহার ফলস্বরূপ ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি নামক একটি প্রকরণ নির্দিষ্ট করিয়াছেন। তাহাতে দেখাইয়াছেন যে, মানবের প্রকৃতি অনুসারে যেমন কামের সেবা অবশ্য কর্তব্য সেইরূপ অর্থ ও ধর্মও স্বভাবত অবশ্য সেবনীয়। নতুবা স্বীয় কর্তব্যর অবহেলা করায় মানব মনুষ্যত্বহীন হইয়া পড়ে, সুতরাং বাৎস্যায়নের মতে, সকল বৃত্তিগুলিরই সমানভাবে পরিষ্ফুরণ এবং নিয়মন না করিতে পারিলে প্রকৃত শান্তিসহযোগে মনুষ্যত্বলাভ বা জগতের কিছুই উকার করিতে পারা যায় না। প্রথমে যে সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রদান করিয়াছেন, তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে দেখিতে পাওয়া যায়, তাহাতে দুইটি অংশ আছে। প্রথমটি তন্ত্র এবং দ্বিতীয়টি আবাপ নামে অভিহিত হইয়াছে। প্রথম ও দ্বিতীয় বলিবার কারণ এই যে, কামসূত্রে করিতেও পারেন না। অতএব আমাদিগের প্রাচ্যটীকাকার বহুদর্শী বহুশাস্ত্রাভিজ্ঞ সুপন্ডিতগণেরও মত এই স্থানেই উদ্ধার করিয়া এই বিষয়ের সমন্বয় করা আবশ্যক। ভাগবত ১২শ স্কন্দীয় ২য় অধ্যায়ের ২১ শ্লোকের টীকাকালে প্রসিদ্ধ টীকাকার শ্রীধর স্বামী বলিয়াছেন। 'বর্ষ সহস্রং পঞ্চদশোত্তরং শতঞ্চেতি কয়াপি বিবক্ষয়া অবান্তরংখ্যেয়ম। বস্তুতস্তু পরীক্ষিতনন্দয়োরতরং দ্বাভ্যামুনং বর্ষানং সার্দ্ধসহস্রং ভবতি; যতঃ পরীক্ষিৎ সকমালং মাগধং মাব্জারিমারভ্য রিপুঞ্জয়ান্তা বিংশতী রাজনঃ সহস্রসংবৎসরং ভোক্ষ্যন্তি ইত্যুক্তং নবমস্কন্ধে যে বার্হদ্রথভুপালা ভাব্যাঃ সাহস্রবৎসরমিতি। ততঃপঞ্চ প্রদ্যোতনা অষ্টত্রিংশং শতম্ শিশুনাগাশ্চ ষষ্ট্যুত্তরশতত্রয়ং ভোক্ষ্যন্তি পৃথিবীমিত্যত্রৈবোক্তত্বাৎ।'

অর্থাৎ (ভাগবতের মূল ম্লোক মধ্যে) ১১ শত ১৫ বৎসর অন্তর যে বলিয়াছেন, ইহা কিছু একটা বলিবার ইচ্ছায় তাড়াতাড়ি অবান্তর সংখ্যা ধরিয়া বলিয়াছেন। বাস্তবিক পরীক্ষিৎ হইতে নন্দের, অর্থাৎ পরীক্ষিতের জন্ম হইতে নন্দের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত ১৪৯৮ বৎসর অন্তর হইবে। কারণ নবমধ্যায়ে বলিয়াছেন-পরীক্ষিতের সমসাময়িক মাগধবংশীয় মার্জারিকে আরম্ভ করিয়া রিপুঞ্জয় পর্যন্ত বিংশতিজন রাজা সহস্য সংবৎসর পৃথিবী ভোগ করিবেন। তারপর পাঁচজন প্রদ্যোতন নামক রাজা ১৩৮ বৎসর, শিশুনাগগন ৩৬০ বৎসর পৃথিবী ভোগ করিবেন, অর্থাৎ ১০০০+১৩৮+৩৬০= ১৪৯৮ বর্ষ ভোগকাল, ইহাই এইখানেই কথিত হইয়াছে।

তাহা হইলে কলির ১২০০ বর্ষ অতীত হইলে পরীক্ষিত জন্মগ্রহণ করেন, ১৪৯৮ বৎসর পরে নন্দ রাজা হন এবং নয়জন নন্দের রাজ্যকাল ১০০ বর্ষ; সুতরাং ইহাদের সমষ্টিতে ১২০০+১৪৯৮+১০০=২৭৯৮ বৎসর কলির অতীত হইলে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্যাভিষ্ক্তি হইয়াছিলেন। (ইহা পরে কথিত হইবে)

এইরূপ মূল বিষ্ণুপুরাণে ও মূল ভাগবতেও কথিত হইয়াছে; সুতরাং এক্ষণে বর্তমান কল্যব্দ ৫০০৭ হইতে ২৭৯৮ বিয়োগ করিলে ২২০৯ বৎসর হয়, তাহার পূর্বে চন্দ্রগুপ্তের অভিষেক হইয়াছিল বলিতে হইবে কামেরই প্রাধান্য। তন্ত্রভাগে কামের বিষয় বর্ণিত হইয়াছে এবং আবাপভাগে যে উপায়ে স্ত্রী ও পুরুষকে লাভ করিয়া কামবৃত্তি চরিতার্থ করিতে পারা যাইবে সেই সকল উপায়্রে উপন্যাস করা হইয়াছে। সুতরাং আবাপভাগের মধ্যে কন্যা সম্প্রযুক্তক, ভার্যাধিকারিক, পারদারিক ওবৈশিক অধিকরণ স্থান পাইয়াছে। আর প্রাথমিক সাধারণ অধিকরণ এবং সম্পম ঐপনিষদিক অধিকরণ এই দুইটিও ঐ তন্ত্র ও আবাপের মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। ষষ্ঠ সাম্প্রয়োগিক অধিকরণ, ইহাকেও তন্ত্রনামে অভিহিত করা হয়। কারণ সেই অধিকরণে কাম ও রতির বিষয় বিস্তৃতরূপে ব্যাখ্যা করা হইয়াছে। ইহার মধ্যে প্রথম, সাধারণ অধিকরণে শান্ত্র-সংগ্রহ ত্রিবর্গপ্রতিপত্তি, বিদ্যাসমূন্দেশ, নাগরকবৃত্ত এবং নায়কসহায়দূতীকর্ম- বিমর্ষ নামক পাঁচটি অধ্যায়ে  পাচঁটি প্রকরণ কথিত হইয়াছে। তাহাতে দেখান হইয়াছে ধর্ম, অর্থ ও কাম কাহাকে বলে এবং কি কি উপায়ে উক্ত ত্রিবর্গ লাভ করিতে পারা যায়? পরন্তু তন্মধ্যে বিশ্বনাথ চক্রবর্তীও ভাগবতের টীকাকার, কিন্তু তিনি শ্রীধরস্বাসীর সহিত একমত হইতে পারেন নাই। তিনি বলিতেছেন-

'এতদ্বর্ষসহস্রমিত্যেষৈব সংখ্যা প্রমাণীকত্তর্ব্যা। পরীক্ষিতসমকালবত্তিমাজ্জারি প্রভৃতিনামানন্দাৎ ভোগকালসংখ্যায়া তু কিঞ্জন্ন্যুনং সর্দ্ধসাহস্রং যদ্বর্যানি ভবন্তি, ভত্তেষাং খন্ডমন্ডলপতীনাং বিনাপ্যানন্তর্য্যেণ সংখ্যাতানীতি জ্ঞেয়ম।'

অর্থাৎ এই শ্লোকে যে ১হাজার ১শত ১৫ বৎসর বলা হইয়াছে, তাহাই প্রমাণযোগ্য। পরীক্ষিতের সমসাময়িক মাগধবংশীয় মার্জারি প্রভৃতির নন্দরাজ্যাভিষেক পর্যন্ত ভোগকাল সংখ্যানুসারে কিঞ্চিৎন্যুন সাদ্ধসহস্র, অর্থাৎ স্বামী-কথিত ১৪৯৮ বৎসর হয় বটে, কিন্তু তাহাতে এক রাজার রাজত্বকালের অনন্তর আর এক রাজার রাজত্বকাল এত বর্ষ, এইরূপ ভাবে রাজত্বকালের আনন্তর্ষ ধরিয়া গণনা করা হয় নাই যে, তিনি যত কাল ভোগ করিয়াছেন তত কালের সহিত, অন্যে যত কাল ভোগ করিয়াছেন তত কালের যোগ করিয়াই ঐ কিঞ্চিৎন্যুন সার্দ্ধসহস্রবর্ষ অর্থাৎ ১৪৯৮ বৎসর গণনা করা হইবে। ইহার তাৎপর্য এই যে, পৃথিবী ভোগকাল আর রাজত্বভোগকাল এই দুইটি স্বতন্ত্র বিষয়। কারণ একজনের জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত সময়কেই তাহার ভোগকাল বলে; কিন্তু এই সময় মধ্যেই বাল্য, যৌবন, রাজত্ব এবং বার্ধক্য প্রভৃতি সকল কালই ভোগ হইয়া থাকে। অতএব মার্জারাদির ১৪৯৮ বৎসর ভোগকাল মধ্যে সম্ভবত তাহাদিগের একটা শৈশব ও বাল্য প্রভৃতি কাল ধার্য করিয়া ঐ পৃথিবী ভোগকালের সমষ্টি হইতে বিয়োগ করিলেই ১১১৫ বৎসর রাজত্বকাল নির্ধারিত হইয়া যাইবে। সেই ভোগ্যকাল ১৪৯৮ হইতে বাল্যদি ভোগকাল অনুমান ৩৮৩ বৎসর বিয়োগ করিলেই ১৪৯৮-৩৮৩=১১১৫ ঐ এক হাজার এক শত পনের বৎসরই তাহাদিগের রাজত্বকাল বলিয়া স্থির করিতে হইবে। তাহা হইলে বিশ্বনাথের অভিপ্রায়মতে পরীক্ষিতের জন্ম হইতে ১১১৫ বৎসর পরে নন্দরাজা হন এবং ১২০০ বর্ষ রাজত্ব করেন। ইহার সমষ্টিতে অর্থাৎ ১১১৫+১২০+১০০=২৪১৫ বঙ্গাব্দে চন্দ্রগুপ্ত রাজা হইয়াছিলেন। প্রত্যেকটিই উল্লেখযোগ্য, বিশেষত চতুঃষষ্টি কলাবিদ্যা; ইহা এখন প্রায় বিলুপ্ত হইয়াছে। যদি বাৎস্যায়নের কামসূত্র না থাকিত তাহা হইলে নিশ্চয়ই বলিতে পারা যায়, কলাবিদ্যার নামমাত্র শুনিয়াই স্থির থাকিতে হইত, কলাবিদ্যা যে কি, তাহা জানিবার আর উপায় থাকিত না। কিন্তু অধুনা বাৎস্যায়নের অনুগ্রহে সেই কলাবিদ্যা সকলেই জানিতে সক্ষম হইতে পারিতেছেন। এই কলাবিদ্যার সাহায্যে ভিন্ন মানব নিজের সৌভাগ্যে নিজে লাভ করিতে পারে না। এইজন্যই বাৎস্যায়ন দেখাইয়েছেন এবং কন্ঠোক্তি করিয়া বলিয়াছেন যে, কলাবিদ্যার গ্রহণ ব্যতীত ধর্ম, অর্থ ও কাম কিছুই লাভ করিতে পারা যায় না। কলাবিদ্যার গ্রহণ করিলে অর্থাগমের পথ উন্মূক্ত হয়, ধর্মের পথ পরিষ্কৃত হয় এবং কাম ও রতি তাহাকে আশ্রয় করিয়া সফলতা লাভ করে, বস্তুত কথাটি সম্পূর্ণই সত্য। পুত্র এবং কন্যা কলাবিদ্যা গ্রহণ করিয়া অর্থোপার্জনের সক্ষম হইলে যৌবনোম্মেষের সঙ্গে সঙ্গেই পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হইবে। পরিণয় অবশ্য বর ও কণ্যার প্রকৃতি অনুসারেই হইয়া থাকে। সুতরাং তাহাকে আট প্রকারে বিভক্ত করিয়া সমাজকে সতেজও প্রবল উন্নত রাখবার জন্য গান্ধর্ব বিধানের বিবাহকে শ্রেষ্ঠ বলিয়া প্রশংসা করিয়াছেন। বর্তমান কলাব্দ ৫০০৭-২৪১৫=২৫৯২ বৎসর পূর্বে ই চন্দ্রগুপ্তের প্রাদুর্ভাব স্থির করিতে হয়। কারণ ভাগবতে কথিত হইয়াছে-

'আরভ্য ভবতো জন্ম যাবন্নন্দাভিষেচনম।
এতদ্বর্ষ সহস্রন্তু শতং পঞ্চদশোত্তরম্ ।।

ভাঃ ১২স্কঃ, ২অঃ, ২৩ শ্লোক।'

আপনার (পরীক্ষিতের) জন্ম হইতে আরম্ভ করিয়া নন্দের রাজ্যাভিষেক পর্যন্ত কালের ১১১৫ বৎসর অন্তর হইবে।

'তে ত্বদীয়ে ‍দ্বিজাঃ কালে অধুনা চাশ্রিতা মঘা।' ২২ শ্লোক

সেই সপ্তর্ষিমন্ডল এখন তোমার রাজত্বকালে মঘানক্ষকে আশ্রয় করিয়াছেন।

'যদা দেবর্ষয়ঃ সপ্ত মঘাসু বিচরন্তি হি।
তদা প্রবৃত্তস্তু কলি দ্বদশাব্দশতাত্মকঃ।' ২৫ শ্লোক।

এখন সপ্তর্ষিমন্ডল যখন মঘানক্ষত্রে বিচরণ করিতেছেন, তখন কলি এখন দ্বাদশ মত বর্ষ প্রবৃত্ত হইয়াছে। এই দুইট শ্লোকে দেখিতে পাওয়া যাইতেছে, পরীক্ষিতের রাজত্বকালে কলির দ্বাদশ শতবর্ষ অতীত হইয়াছিল।

'প্রজা ইমা স্তব পিতা ষষ্টিবর্ষান্যপালয়ৎ।
মহাভারত, আদিপর্ব, ৫০ অধ্যায়,' ১৭ শ্লোক।

পরীক্ষিত যে ৩৬ বৎসরে রাজত্বভার প্রাপ্ত হন, ইহা ভারতে কথিত হইয়াছে এবং প্রসিদ্ধ টীকাকার নীলকন্ঠও এই শ্লোকের টীকাকালে লিখিয়াছেন-

'ষষ্টিবর্ষাণি জন্মতঃ ষষ্টিবর্ষং যাবৎ;
নতু রাজ্যলাভাৎ, অপালয়ৎ পালিতবান্ ।
ষষ্টিত্রিংশে বর্ষে লব্ধরাজ্যশ্চত্তর্ব্বিংশতি
বর্ষপর্য্যন্তং তৎপালনস্য দৃষ্টত্বাৎ।।'

কারণ বর ও কন্যার উৎকন্ঠাবেশে পরস্পর পরস্পরকে পরিণয়সুত্রে আবদ্ধ করে এবং কাল যে সন্তান প্রসব করে সে উৎফুল্ল-চরিত, অসঙ্কীর্ণ-চেতা, কর্মবীর ও উৎসাহশীল হয়। এই প্রসঙ্গে বর ও কন্যা উভয়ের দোষগুন মীমাংসা করিয়া গ্রাহ্যগ্রাহ্যত্বও নির্ণয করিয়াছেন। ইহাতে অনেক শিক্ষা পাইবার বিষয় লুক্কায়িত আছে। তারপর একচারিনী ভার্যার কর্তব্য সম্বন্ধে উপদেশের কথা। এ সম্বন্ধে বলিবার বিষয়ও বহু এবং ভাবিবার বিষয়ও অনেক। যদি কেহ ভার্যাকে গৃহিনীপদে সমাসীন করিয়া সুখে ও স্বচ্ছন্দে হাসিতে হাসিতে জীবনযাত্রা নির্বাহ করিতে চাহেন, তবে যেন তিনি কামসূত্রের ভার্যাধিকারিক অধিকরণটি ভার্যার কন্ঠস্থ করাইতে সচ্ষ্টে হন এবং কর্মক্ষেত্র কীদৃশ সফলতা লাভ করিয়া যাইতে পারিলেন, তাহার ইতিহাসটি যেন তিনি নিজেই লিখিয়া যান। বস্তুত, বলিতে হইলে বলিতে হয় যে, সংসার করিতে অগ্রসর হইয়া আমরা বৃথাই বিড়ম্বনা ভোগ করিতেছি। সংসার যে কিরূপে পরিচালিত করিতে হয়, তাহার কিছুই জানি না। বিশেষত গৃহলক্ষ্মীরা কিছুই জানেন না, অথচ সংসার করিয়া থাকেন। তাহারা তদুর্ভোগ ভুগিয়া থাকেন, অধিকন্তু গৃহীকেও তাহাদের অনুগামী করিয়া তাহার ভাগী করেন। কি বিড়ম্বনা! এইখানে স্বামী প্রবাসী হইলে, কি করিতে হয়; সপত্নী থাকিলে, কোন উপায়ে সুখে সংসার করিতে পারা যায়, দুর্ভগা হইলে কি উপায়ে সৌভাগ্য লাভ হয়-ইত্যাদি বিষয় অতি বিচক্ষণতার সহিত মীমাংসিত হইয়াছে।

হে জনমেজয়! তোমার পিতা পরীক্ষিত এই সকল প্রজাকে ষাট বৎসর পালন করিয়াছিলেন। ষাট্ বৎসর জন্ম হইতে আরম্ভ করিয়া ষাট্ বৎসর পর্যন্ত পালন করিয়াছিলেন কিন্তু রাজ্যলাভ কাল হইতে নহে। কারণ অন্যত্র দেখিতে পাওয়া যায়, ছত্রিশ বৎসর বয়সে রাজ্যলাভ করিয়া চব্বিশ বৎসর প্রজাপালন করিয়াছিলেন। তাহা হইলে, কলির অতীত বর্ষ ১২০০ পরীক্ষিতের জন্ম হইতে নন্দের রাজ্যা-ভিযেক কালের অন্তর ১১১৫ বর্ষ। আর নয়জন নন্দের রাজ্যকাল ১০০ বর্ষ। এই তিনের সমষ্টিতেই ১২০০+১১১৫+১০০=২৪১৫ বৎসর হয়। এক্ষণে পরীক্ষিতের জন্ম হইতে রাজ্যকাল ৩৬ বৎসর ত্যাগ করিলে ২৪১৫-৩৬=২৩৭৯ বর্ষ কলির অতীত হইলে, অর্থাৎ বর্তমান ৫০০৭ কল্যব্দ হইতে ২৩৭৯ পরিত্যাগ করিলে ২৬২৮ বৎসর পূর্বে চন্দ্রগুপ্ত রাজা হন।

বিষ্ণুপুরানে কথিত হইয়াছে-

'যাবৎ পরীক্ষিতো জন্ম যাবন্নন্দাভিষেচনং
এতদ্বর্ষ সহস্রন্তু জ্ঞেয়ং পঞ্চদশোত্তরম্ ।'

পরীক্ষিতের জন্মকাল হইতে নন্দের রাজ্যাভিষেক কাল ১ হাজার ১৫ বৎসর পরিমিত। পরীক্ষিত যখন রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছেন, তখন কলির ১২শত বর্ষ অতীত হইয়াছে। এই কথাও বিষ্ণুপুরানে পাওয়া যায়-

'তদা প্রবৃত্তশ্চ কলির্দ্বাদশাব্দশতাত্মক।।'
বিষ্ণুপুরান চতুথাংশ, ২৪ অঃ, ৩৪ শ্লোক!

তারপর পারদারিক অধিকরণ। ইহা পাঠ করিয়া লম্পট পামরের হস্ত হইতে নিষ্কৃতির পন্থা আবিষ্কার করিতে, পাতিব্রত্য অক্ষুন্ন রাখিতে এবং অপরের ভয়াবহ হইতে শিক্ষা করা কর্তব্য। পক্ষান্তরে লম্পটও স্বীয় ব্যবসায়ে প্রতিপত্তি লাভ করিতে শিক্ষা করিতে পারে। এই অধিকরণ যষ্টির ন্যায় সাহায্যকারী ও পরের ভয়াবহ। এটি অবশ্য পাঠ্য। বৈশিক অধিকরণও তথৈব চ। বেশ্যা কয় প্রকার, কোন নীতি অবলম্বন করিয়া বেশ্যা চিরসুখিনী ও গন্যমান্যা হইতে পারে, কি উপায়ে পরপুরুষকে সংগ্রহ করিতে এবং সর্বস্বাপরহরণ করিয়া তাহাকে বিদায় দিতে হয়-ইত্যাদি বিষয় বিশদরুপে বর্ণিত হইয়াছে। ইহাতে বেশ্যা ও লম্পট আত্মরক্ষা করিতে এবং বেশ্যা নিজের ব্যবসায়ে প্রতি পত্তিশালিনী হইতে পারিবে; সুতরাং ইহা দ্বারা সমাজকে শিক্ষা দেওয়াও যথেষ্ট হইয়াছে। নয়জন নন্দ একশত বর্ষ যাবত রাজ্যভোগ করিয়া কৌটিল্যের কুট মন্ত্রণায় নিহত হন। পরে কৌটিল্য বা চাণক্য চন্দ্রগুপ্তেকে রাজ্যে অভিষেক করেন।

'মহাপদ্মঃ তৎপুত্রাশ্চ (অষ্টৌ) একং বর্ষশতমবনীপতয়ো ভবিষ্যন্তি।
নবৈব তান্ নন্দান, কৌটিল্যো ব্রাক্ষ্মনঃ সমুদ্ধরিষ্যতি। ৬ ।
তেষামভাবে মৌর্ষ্যাশ্চ পৃথিবীং ভোক্ষ্যন্তি।
কৌটীল্য এব চন্দ্রগুপ্তং রাজ্যেই ভিষেক্ষ্যতি। ৭।'
বিষ্ণু পুরাণ, ৪র্থাংশ, ২৪ অঃ।

তাহা হইলে ১২০০+১০১৫+১০০=২৩১৫ বৎসর। এই ২৩১৫ বর্ষ কলির অতীত হইলে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। চাণক্যেই সেই রাজ্যাভিষেক কার্য সর্বতোভাবে সম্পাদন করিয়াছিলেন। ইহা দ্বারা স্থির হইতেছে যে, কলি অব্দের ২৩১৫ বৎসর পরে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্যে অভিষিক্ত হইয়াছিলেন। এখন কলির ৫০০৭ অব্দ, তাহা হইলে ৫০০৭-২৩১৫=২৬৯২ বৎসরে, অথবা কিছুয পরে চাণক্য চন্দ্রগুপ্তেরে রাজ্যে অভিষিক্ত করেন। এবিষয়ে আরও একটি অকাট্য প্রমাণ ঋষিগণ বিষ্ণু ও ভাগবত পুরানে সংগৃহীত করিয়া গিয়াছেন। সেটি এই-

'সপ্তর্ষীনাঞ্চ যৌ পূব্বো দৃশ্যেতে উদিতৌ দিবি।
তয়োস্তু মধ্যে নক্ষত্রং দৃশ্যতে যৎ সমং নিশি।
তেনৈব ঋষয়ো যুক্তাস্তিষ্ঠন্ত্যব্দশতং নৃণাম।
তে ত্বদীয়ে দ্বিজা কালে অধুনা চাশ্রিতা মঘাঃ॥ ' ২২

অর্থাৎ হে রাজন্ পরীক্ষিত সপ্তনক্ষত্রাত্মক সপ্তষিমন্ডলের মধ্যে উদয়সময়ে যে ‍দুইটি নক্ষত্ররূপে ঋষিকে আকাশ মন্ডোলে প্রথম উদিত হইতে দেখিতে পাওয়া যায়, তদুভয়ের মধ্যে সমদেশাবস্থিত যে অম্বিন্যাদি এক একটি নক্ষত্রকে দেখা যায়, তাহার এক একটির সহিত যুক্ত হইয়া ঐ সম্পষিমন্ডল মনুষ্যপরিমাণের এক এক শত বৎসর অবস্থিতি করেন। সেই সকল ঋষিরা অধুনা তোমার সময়ে মঘানক্ষত্রকে আশ্রয় করিয়া রহিয়াছেন।

'যদা দেবর্ষয়ঃ সপ্ত মঘাসু বিচরন্তি হি।
ত্বদা প্রবৃত্তস্তু কলিদ্বাদশাব্দশতাত্মকঃ।' ২৫।

যখন হৃতসর্বস্ব লম্পটকে নিষ্কাসিত করিবার উপায়গুলি বিবৃতি করা হইয়াছে, তখনকার সেই সকল উপায়ের প্রতি যাহার চক্ষু উম্মীলিতভাবে পড়িবে, সে বিশেষরূপেই শিক্ষা পাইবে সন্দেহ নাই। তবে যে জাগিয়া ঘুমাইবে, তাহার পক্ষে কিছু ফলোপধায়ক না হইলেও সে স্থলে এই গ্রন্থ বেশ্যার পক্ষেই ফলপ্রসু হইবে। জগতের স্থিতি, সৃষ্টির উপর নির্ভর করে। সৃষ্টির স্থাবর ও জঙ্গমাত্নক জগতে স্ত্রী ও পুরুষ ভিন্ন হইতেই পারে না। অথচ সমাজের সুরৃচি প্রভাবে অপ্রকাশিত থাকায় সেই সৃষ্টিতত্ত্ব সম্বন্ধে আমরা কিছুই অবগত নহি। পশুর ন্যায় আমরা সৃষ্টি অর্থাৎ যখন সপ্তদেবর্ষিমন্ডল এখন মঘানক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছেন, তখন কলি এখন দ্বাদশ শত বৎসর অতিক্রম করিয়াছে।

'যদা মঘাভ্যো যাস্যন্তি পূর্ব্বষাঢ়াং মহর্ষয়ঃ।
তদা নন্দাৎ প্রভৃত্যেষ কলিবৃদ্ধিং গমিষ্যতি।' ২৬।

অর্থাৎ সপ্তমহষিমন্ডল যখন মঘাকে পরিত্যাগ করিয়া গতিবশে পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে যাইবেন, সেই সময়ে নন্দের রাজ্যাভিষেক হইবে এবং সেই নন্দের সময় হইতেই কলির বৃদ্ধি হইবে। (ভাগবত ১২স্কন্ধ, ২ অধ্যায়)।

ইহা দ্বারা বুঝিতে পারা যাইতেছে যে, মঘানক্ষত্র হইতে পূর্বাষাঢ়া গণনায় ১১ হয়; সুতরাং এই ১১র সহিত, সপ্তষিমন্ডলের অবস্থিতি ১০০ বৎসর গুন করিলে  ১১০০ বৎসর হয়, আর পূর্বে প্রবৃত্ত কলির ১২০০ বৎসর এবং নন্দরাজ্য একশতবর্ষ; ইহার সাকুল্যে ১২০০+১১০০+১০০=২৪০০ বৎসর কলির অতীত হইলে, তবে চাণক্য নন্দ-বংশ ধ্বংস করিয়া চন্দ্রগুপ্তকে নন্দের সিংহাসনে আরুঢ় করেন। তারপর রাজ্যের শাসনসুশৃঙ্খলা, নন্দমন্ত্রী রাক্ষসের সহিত পূর্বপ্রবৃত্ত প্রতি হিংসাজনিত বিবাদের নিষ্পত্তি, রাক্ষসকে চন্দ্রগুপ্তের প্রধান অমাত্যপদে বরণ, শান্তি-ব্যবস্থাপন বিদায়, নীতিশাস্ত্র-প্রনয়ন, শব্দশাস্ত্র-ব্যাখ্যান, বৈদ্যকবিরচন এবং ন্যায়শাস্ত্রের ভাষ্যরচনা ও সর্বশেষে কামসূত্রের সঙ্কলন প্রভৃতি বহুবিধ ক্রিয়া নিষ্পাদন করিতে অনুমান ২২ বৎসরও লাগিয়াছিল সুতরাং ২৪০০+২২=২৪২২ কল্যব্দে যে, কামসূত্র রচনা শেষ করিয়াছিলেন ইহা নিতান্ত অসম্ভব নহে। তাহা হইলে বর্তমান কল্যব্দ ৫০০৭-২৪২২=২৫৮৫ বৎসর পূর্বে কামসূত্র রচনা হইয়াছে।

(কেহ কেহ বলিয়া থাকেন, সম্পষিমন্ডল কতকগুলি নিশ্চল তারামাত্র, তাহাদিরে গতি নাই। আমরাও বলি, তাহাই সত্য; কারণ যে মন্ডল একশত বৎসরে একটি নক্ষত্রকে ভোগ করে, তাহার গতি বস্তুত নাই বলিলেও অত্যুক্তি হয় না। তবে যাহারা বিশেষ নিপুনতার সহিত লক্ষ্য করিয়াছেন, তাহারা নিশ্চয়ই স্বীকার করিবেন যে, সপ্তষিমন্ডল বহুদূরে অবস্থিত ও বহুকাল ধরিয়া এক একটি নক্ষত্রকে ভোগ করায় তাহাদের গতি স্থির করা বড়ই দূরুহ অসম্ভব নহে। ২২৫ বৎসরে যখন একটি রাশিকে অতিক্রম করে তখন পূর্বোক্ত মতবাদীদিগের কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিবার যোগ্য নহে। তাই বলিয়া স্বীকারও করিতে পারা যায়না।)

এক্ষণে দেখা যাইতেছে যে-

বিষ্ণুপূরানের মতে লিখিত কথানুসারে ২৩১৫ কল্যব্দে চন্দ্রগুপ্ত রাজা হন।

বিষ্ণুপুরানের নাক্ষত্রিকগণনানুসারে ২৪০০ কল্যাব্দে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্য হন।

তত্বের ব্যবহার এবং আলোচনা করি। ইহা কি কর্তব্য না সমূচিত? যাহার সদ্ব্যবহারে জগৎরক্ষা ও ঈম্বরের উন্দেশ্যসিদ্ধি, যাহার কুৎসিত ব্যবহারে পরিণাম ঘোর অন্ধকারময় ও ভুয়োভূয়ঃ অধর্ম সেই সৃষ্টিতত্ত্বটিকে গাঢ়তমস্যচ্ছন্ন রাখা, কখনই উচিত নহে; সুতরাং ন্যায়ত ধর্মত এই উপায়গুলি যে অবশ্য জানা উচিত, তাহা মুক্তকন্ঠে সকলকেই স্বীকার করিতে হইবে। সেইজন্যেই সাম্প্রয়োগিক অধিকরণে রতি সম্বন্ধে যাহা কিছু জ্ঞাতব্য থাকিতে পারে, তৎসমুদয়ই বাৎস্যায়ন অতি গম্ভীরভাবে মীমাংসিত করিয়াছেন; সুতরাং ইহা পাঠ না করিলে কখনই মানবের সৃষ্টিবিষয়ে পশুক্তনষ্ট হয় না। ভাগবতের মতে লিখিত কথানুসারে ২৩৭৯ কল্যব্দে রাজপদে চন্দ্রগুপ্ত সমাসীন হন। ভাগবতের নাক্ষত্রিকগণনানুসারে ২৪০০ কল্যব্দে চন্দ্রগুপ্ত রাজ্য প্রাপ্ত হন। পরীক্ষিতের জন্ম হইতে রাজ্যপ্রাপ্তির কাল, ৩৬বাদে বিষ্ণুপুরাণের লিখিতমতানু সারে চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যলাভ ২৩১৫-৩৬=২২৭৯ কল্যব্দ। পরীক্ষিতের জন্ম হইতে রাজ্যপ্রাপ্তির কাল, ৩৬ যোগে ভাগবতের লিখিত মতানুসারেও রাজ্যলাভ ২৪১৫ কল্যব্দ। যাহাই হউক, যখন পূরানকার ঋঝিগণ ঐ গননায় সন্তুষ্ট না হইয়া নিজেই জ্যোতিষিক গণনার কথা সর্বশেষে লিখিয়া গিয়াছেন, তখন আর আমাদিগের তাহার উপর কথা বলিবার ক্ষমতা নাই। বোধ হয়, কাহারও ক্ষমতায় কুলাইবেও না। প্রথমত প্রত্যেক বা সমষ্টি রাজগণের রাজ্যভোগকাল বলা হইয়াছে। পরে দ্বিতীয়ত সাকুল্যে একটা অঙ্ক-লিখিত সময়ের কথা লিপিবদ্ধ করা হইয়াছে। তাহার উপরেও সন্দেহ হইলে সেই সন্দেহ অপনোদন করিবার জন্য তৃতীয়ত, জ্যোতিষিক নিয়মের সঙ্কলন করিয়া তাহার সহিত আদি মধ্যাবসানিক সময়কে যোগ করিয়া দিয়াছেন। ইহার উপরেও সন্দেহ করিতে হইলে, আর ইতিহাস পর্যালোচনা করিতে যাওয়া চলে না; সুতরাং নিঃসন্দিন্ধচিত্তে আমরা চন্দ্রগুপ্তের রাজ্যাভিষেক কাল ২৪০০ কল্যব্দে স্থির নিশ্চয় করিতে পারি এবং সেই সঙ্গে বাৎস্যায়নকেও ঠিক সেই সময়ের লোক বলিয়া স্থির করিতে পারি। অধিকন্তু বাৎস্যায়ন কামসূত্রের উপসংহারকালে যে ৮টি শ্লোক পাঠ করিয়া গ্রন্থ সমাপ্তি করিয়াছেন তাহার প্রথম শ্লোক এই-

'পূর্ব্বশাস্ত্রাণি সংহৃত্য প্রয়োগানুপসৃত্যচ।
কামসূত্রমিদং যত্নাৎ সংক্ষেপেণ নিবেশিতম।' ১।

অর্থাৎ পূর্বশাস্ত্রের সংগ্রহ ও প্রয়োগের অনুসরণ করিয়া যত্নপূর্বক সংক্ষেপে আমি এই কামসূত্র রচনা করিলাম। পঞ্চম শ্লোক এই-

'বাভ্রবীয়াংশ্চ সূত্রার্থানাগমং সুবিমৃষ্যচ।
বাৎস্যায়নশ্চকারেদং কামসূত্রং যথাবিধি।' ৫।

অর্থাৎ, বাভ্রব্যের সূত্রার্থ ও আগম ভাল করিয়া পাঠ ও চিন্তা করিয়া বাৎস্যায়ন যথাবিধি এই কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন। এই শ্লোকের প্রকৃত অর্থ অন্যরূপ। ইহা শ্লেচ্ছিতকবিকল্পকলা অনুসারে রচিত হইয়াছে; সুতরাং ইহার অর্থ এইরূপ শব্দে বায়ু, তাহার সংখ্যা ১৫। অভ্র শব্দে তারপর ঔপনিষদিকে কতকগুলি বাজীকরণ ও বশীকরণ প্রভৃতি প্রক্রিয়ার কথা কথিত হইয়াছে। এই গ্রন্থখানিকে উপলক্ষ করিয়া বলিতে পারা যায় যে, কামমীমাংসায় মানব শিক্ষিত হইলে ধর্মত, অর্থত এবং অভিলাষের চরিতার্থতায় নিশ্চয় সাফল্যলাভ করিতে এবং ঐহিক ও পারত্রিক সুখে সুখী হইয়া অন্তে অনায়াসে সংসার বন্ধন হইতে মুক্তিলাভ করিয়া স্বাধীন সম্রাটরূপে বিরাজমান হইতে সক্ষম হইবে। কাম-মীমাংসার প্রথম সঙ্কলয়িতা মহাদেবের অনুচর নন্দী। তিনি বেদ হইতে সঙ্কলন করেন। তাহার পর ঔন্দালকি শ্বেতকেতু, ইনি একজন ব্রক্ষ্মজ্ঞ। ছান্দোগ্যোপ নিষদ্ ও মহাভারতে ইহার যথেষ্ট পরিচয় পাওয়া যায়। তারপর পঞ্চাদেশের রাজা বাভ্রব্য, ইনি অথববেদের একজন বংশঋষি বা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি বা সংহিতাপ্রণয়ন কর্তা। তারপর চারায়ন, সুবর্ণনাভ, গোটকমুখ, গোনর্দীয়, গোণিকাপুত্র, দত্তক ও কুচুমার নামক সাতজন আচার্য খন্ডে খন্ডে সেই পূর্বোক্ত সঙ্কলনের এক এক অংশ পৃথকভাবে সঙ্কলন করেন। তাহা দেখিয়া বাৎস্যায়ন বাভ্রব্যের সঙ্কলিত গ্রন্থ অবলম্বন করিয়া সংক্ষেপে ও অল্পমাত্রায় এই কামসূত্রখানি সঙ্কলিত করেন। মাধবাচার্যের শঙ্করবিজয় নামক গ্রন্থে বর্ণিত আছে যে, ভগবান শঙ্করাচার্য এই কামসূত্র পাঠ করিয়াই পরমবিদুষী ভারতীকে বিচারে পরাস্ত করিয়াছিলেন। শূণ্য ব শব্দে বরুন তাহার সংখ্যা ২৪। তাহা হইলে সমুদায় সংখ্যাকে ক্রমে স্থাপন করিতে হইবে অর্থাৎ ১৫র পরে ০, তাহার পরে ২৪ বসাইলে ১৫০২৪ হয়। এই ক্ষণ অঙ্কের বামাগতি এই নিয়মানুসারে ৪২০৫১, ইহাই হয়। ইহার উপরে অর্থ শব্দে দ্বিতীয় বর্গ, তাহার সংখ্যা ২কে সুত্রিত করিতে হইবে। তাহা হইলে ৪২০৫১২ অঙ্কসমষ্টি হইল।

এত অঙ্ক, কল্যব্দের আগামী অঙ্ক হইবে।

কল্যব্দ ৪৩২০০০। তাহার মধ্যে হইতে ৪২০৫১২ অঙ্ক বিয়োগ করিলে ১১৪৮৮ অঙ্ক অবশিষ্ট থাকিল। এইক্ষণ আগং অং সুবিমৃষ্য চ দেখা যাউক। অ শব্দে বিষ্ণু তাহার সংখ্যা ২২। অগ শব্দে নাগ, তাহার সংখ্যা ৮। তদুভয়ের সমাহারে বা যোগে হইবে ৩০। আর তাহার পরে আর ২২ সংখ্যা বসিবে। তাহা হইলে ৩০২২ অঙ্ক হইল। পৃথক পৃথক বলায়, এখানে আর বামাগতির মর্যাদা নাই। এখন ঐ অবশিষ্ট ১১৪৮৮ অঙ্ককে সুচারুরুপে বিয়োগ করিতে হইবে, অর্থাৎ ১১৪৮৮ অঙ্কের মধ্যে হইতে ঐ ৩০২২ অঙ্ক যতক্ষণ বিযুক্ত হইতে পারে, ততক্ষণ বিয়োগ করিতে হইবে। ২৪২২ অবশিষ্টের মধ্যে আর ৩০২২ বিযুক্ত হয় না; সুতরাং ২৪২২ কল্যাব্দে বাৎস্যায়ন এই কামসূত্র গ্রন্থ রচনা করিয়াছেন। বর্তমান ১৩১৩ বঙ্গাব্দে কল্যব্দ ৫০০৭ বৎসর হইতে ২৪২২ বিযুক্ত করিলে ৫০০৭-২৪২২‍=২৫৮৫ বৎসর পূর্বে বাৎস্যায়ন কামসূত্র রচনা করিয়াছিলেন, ইহাই স্থির হয়। ইহাই বিশেষ বিবরণ বা ব্যাখ্যা মূল কামসূত্রের উপসংহারে দ্রষ্টব্য। বাসবদত্তা নামক নাটকেও ইহার নামোল্লখ দেখিতে পাওয়া যায়। ভবভূতিও ইহা হইতে কতকগুলি সূত্র উদ্ধার করিয়া মালতীমাধব নামক নাটকে কোন প্রস্তাবের প্রমাণ করিয়াছেন। কালিদাস এই কামসূত্রোক্ত নীতি অবলম্বন করিয়া নাটক লিখিয়াছেন ও শকুন্তলার কামভাব ব্যক্ত করাইবার জন্য ইহার প্রসঙ্গ উন্থাপন করিয়াছেন। সুপ্রসিদ্ধ দন্ডী তাঁহার দশকুমার চরিত্রে এই গ্রন্থ-বর্ণিত বিষয়েরই বাহুল্য প্রদর্শন করিয়াছেন। ক্ষেমেন্দ্ররাজ প্রনীত ঔচিত্যবিচারচর্চা নামক গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া যায় যে, তিনি ইহার একখানি সার-সংকলন করিয়া তাহার বাৎস্যায়ন সূত্রসার নাম দিয়াছেন-ইত্যাদি বহুশত মনীষীই এই কামসূত্রের সাদরে পূজা করিয়া গিয়াছেন; সুতরাং ইহা যে কীদৃশ আদরের বস্তু তাহা ব্যক্ত করিয়া বলিবার আমার যোগ্যতা নাই।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2