মন্তব্য

ঔপনিষদিক অধিকরণের ভাষ্য থাকিলেও যশোধর তাহার ভাষ্যনেয়ায়ী টীকা করেন নাই, কারণ তাহার মধ্যে যে সকল যোগের কথা বলা হইয়াছে, তাহা সমাজের মধ্যে প্রকাশিত হওয় তাহার অভিপ্রেত ছিল না। আমরা এ মতের পক্ষপাতী নহি; কারণ আচার্য বাৎস্যায়ন চাণক্য একজন ঋষি ছিলেন। তিনি জানিতেন, কিসে সমাজের মঙ্গল ও কিসে অমঙ্গল; সুতরাং তিনি যখন সেই অধিকরণের অবতারণা করিয়া গিয়াছেন, তখন নিশ্চয় তাহার উপকারিতার প্রতি সন্দিহান হইবার কোনই কারণ থাকিতে পারে না। আমরা এক একটি করিয়া যোগের নাম কীর্তন করিব এবং তাহার উদাহরণ দিয়া বুঝাইতে চেষ্টা করিব।

১ম-ইহার প্রথমাধ্যায়ের প্রথম যোগ হইতেছে সুভগঙ্করণ। যন্দ্বারা রূপে, গুনে বয়ঃক্রমে ওত্যাগে সুভগ হওয়া যায়, যাহা হইলে লোকে সৌভাগ্যশালী বলিয়া মনে করে ও নিজে নিজেকে সৌভাগ্যবান বলিয়া মনে করিতে পারে, তাহাকে সুভগঙ্করণযোগ বলা যায়। যেমনঃ তগরাদি যোগের অবলম্বন করিলে রূপে সুভগ হয়। রূপ সৌভাগ্য যে সমাজের প্রয়োজনীয় নহে, এ কথা বলিতে বোধ হয় কেহই সাহসী হইবে না। দেখা যায়, কোন একটি কন্যা বা পুত্র কুৎসিতরূপ হইলে, তাহার বিবাহের জন্য পিতা বা মাতা কতই কষ্ট পাইয়া থাকেন, কিন্তু যদি সেই কন্যা বা সেই পুত্রকে তগরাদিযোগের সাহায্যে রূপসুভগ করা যায়, তবে তাহাকে যে দেখিবে সেই আনন্দে বরণ করিয়া লইতে চাহিবে। অতএব এই সুভগঙ্করণ যোগটি সামাজিকের পক্ষে একটি নিত্য প্রয়োজনীয় ইহা স্বীকার করিতেই হইবে। তবে লম্পটেরাও ইহার ব্যবহার করিয়া থাকে বটে; কিন্তু কিছু দোষের বলিয়া কি সকল দ্রব্যই সমাজ ত্যাগ করিয়াছেন; সুতরাং দোষ অপেক্ষা গুণের মাত্রা অধিক হইলে সে দ্রব্য নিশ্চয়ই সমাজের আদরনীয় হইবে।

২য়- সেইরূপ সৌভাগ্যবর্ধনযোগও দুষ্পরিহার্য। এ বিষয়ে সমাজ আপত্তি উন্থাপন করিলেও করিতে পারে; কিন্তু তাহার উত্তরে বাৎস্যায়নের বক্তব্য এই যে, সমাজ যখন কেবল শান্ত তপোবন হইতে দুচারিটি মুনিঋষি লইয়া গঠিত নহে, তখন পরিচারিকার গর্ভে কন্যা উৎপাদন করিয়া, সেই কন্যার সৌভাগ্যসম্পাদন ও সৌভাগ্যবর্ধন করিতেও সে প্রভু নিশ্চয়ই বাধ্য। অতএব তাহার একটা সমাজের সহিত সম্বন্ধহীনভাবে ব্যবস্থা থাকা নিশ্চয়ই আবশ্যক। বোধ হয় অনেকে জানেন, এই যোগটি আজকাল সমাজে বহুপরিজ্ঞাত নহে বলিয়া অনেক পরিচারিকার কন্যা গুহস্থকন্যার ন্যায় ব্যবহৃত হইয়া গিয়াছে ও হইতেছে ইহা কি নিশ্চয় অনুচিত নহে।যে পরিচারিকা লজ্জা ও ধর্মের মাথা খাইয়া, প্রভুর ঔরসজাত কন্যাকে গর্ভে ধারণ করিতে পারিয়াছে এবং কুলবহির্ভূতও হয় নাই, সে বা তাহার কন্যা কি গৃহস্থের অপেক্ষাহীন ও বেশ্যার অপেক্ষা উচ্চ ব্যবহারের পাত্র নহে? অতএব নিশ্চয়ই এ সম্বন্ধে বাৎস্যায়নের এই ব্যবস্থা সমাজের পক্ষে বিশেষ উপযোগী।

৩য়- তারপর বেশ্যার পানিগ্রহণবিধি ও সৌভাগ্যবর্ধনযোগ। এটি দ্বারা লম্পট যুবকদিগের চক্ষুফুটাইয়া দেওয়া হইয়াছে। লম্পট যুবকেরা মনে করে, বেশ্যার কন্যার প্রণয়লাভ করিয়া সুখী হইবে; কিন্তু বাৎস্যায়ন দেখাইয়াছেন যে, তাহা অসম্ভব। ফাকি দিয়া লাভ করাই বেশ্যাদিগের স্বাভাবিক ইচ্ছা ও তাহারা তাহাই করিয়া থাকে। এ বিষয়ে প্রত্যেক যুবকের চক্ষু ফোটান আবশ্যক; সুতরাং সমাজের সম্মূখে এ চিত্র ভাল করিয়া ধরা উচিত। যাহারা সে চিত্র দেখিয়াও দেখিবে না, তাহারই বেশ্যা প্রেমান্নির ইন্ধনসার হইবে। পক্ষান্তরে, তাহারা যখন এই সমাজেরই উপাঙ্গ, তখন তাহারও কিছু বিধিব্যবস্থা ন্যায়ত চাহিতে পারে এবং সমাজেরও উচিত, সমাজ এতাদৃশ বিধিব্যবস্থা করিয়া মধ্যবর্তী ভেদক রেখাটাকে পরিষ্ফুট করিয়া রাখেন। এখন এই ব্যবস্থাটা সমাজের পরিচালনসীমার বহির্ভূত রহিয়াছে বলিয়া বেশ্যাকন্যার বিবাহও সামাজিকের বিবাহের ন্যায় অবাধে চলিয়া যাইতেছে। ইহা কি জীবিত সমাজের বাঞ্ছনীয় হওয়া একান্ত অনুচিত নহে? এই জন্যেই এই যোগটিকেও পরিত্যাগ করা উচিত নহে।

৪র্থ- তারপর বশীকরণের কথা। এ সম্বন্ধে মতান্তর থাকিলেও সকলেই স্বীকার করিতে বাধ্য যে, ভিন্ন রূচিসম্পন্ন স্ত্রী ও পুরুষে মিলিয়া সংসারযাত্রা নির্বাহ করিতে হইলে দৈনিক আহার বিহারের ন্যায় বশীকরণযোগও নিতান্ত গ্রাহ্য। স্ত্রী যদি পুরুষের উপর সর্বদাই আসক্তি প্রকাশ করে বা পুরুস যদি স্ত্রীর উপর অত্যন্ত অনুরক্ত হয়, তবে সে সংসারে কখনও দম্পতিকলহ হয় না বা ব্যভিচারদোষ সে কুলে প্রবেশ করিতে সমর্থই হয় না। তাহার বিপরীত হইলেই ফলও বিপরীত হয়, ইহা বোধ হ্য় প্রত্যেক সামাজিকের সুপরিজ্ঞাত; সুতরাং কুলকে বিশদ রাখিবার পক্ষে বশীকরণযোগটি একান্ত প্রয়োজনীয়। মহর্ষি পারষ্কর, আচার্য গোভিল, আম্বনায়ন, সঙ্কখ্যায়ন, কাত্যায়ন, যাজ্ঞবল্ক্য, মনু ও বষ্ণিআদি মহর্ষিগন একবাক্যে দারোপগমন কালে ঔষধের আশ্রয় গ্রহণ করিতে অনুমতি করিয়া গিয়াছেন। তাহার কারণ আর কিছুই নহে, কেবল স্ত্রীকে পুরুষের সম্প্রয়োগর পক্ষপাতী করিবার জন্যই ঐ কথাটি তাহারা বলিয়াছেন। এখন বলুন দেখি, কোন সামাজিক হৃদয়ে হাত দিয়া বলিতে পারেন যে, হাঁ, আমার স্ত্রী আমার সম্প্রয়োগের একান্তপক্ষপাতিনী। একথা বলিতে কেহই সাহসী হবেন না। কেন সাহসী হইবেন না? না তাহারা বশীকরনযোগ্যর কোন সন্ধানই রাখেন না। কুলাশ্রিত কামিনীগণকে সতী করিয়া রাখিবার পক্ষে এটি একটি বিধি প্রদত্ত অমোঘ উপায়- ইহা সকলেই মানিতে বাধ্য। তবে ইহার বিপরীত ব্যবহারও আছে সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া কি ইহার অনাদরই করিতে হইবে? তাহা হইলে যে অনেক বিষয়েই পরিত্যাগ করিতে হয়। তাহা কি সকলে করিয়া থাকেন? সুতরাং যতদূর সম্ভব, দোষের হাত এড়াইয়া গুনের অংশই গ্রহনীয়।

৫ম- ইহার পরই বৃষ্যযোগ। বৃষ্যযোগ না জানায় আজকালকার যুবক-যুবতীরা প্রায়শ অকালেই কালগ্রাসে পড়িতেছে। পিতামাতার কর্তব্য পুত্র ও পুত্রবধুরা সমর্থ হইলেই যখন তাহারা পরস্পর সম্প্রয়োগরত হইবে, তখন তাহারা যাহাতে বৃষ্যযোগের অধীন হইয়া চলে, তাহার উপায় করেন, কিন্তু হায়, কালের কি কলুষকটাক্ষ! মাতাপিতা পুত্রের বিবাহ দিয়াই ভারহীন হইলেন মনে করেন, কিন্তু গৃহ্যসূত্রকারেরা স্পষ্টাক্ষরে গর্ভাধানকালে এই বৃষ্যযোগের সেবা করিয়া সম্প্রযুক্ত হইবার আদেশ করিয়া দিয়াছেন। সমাজ সুরুচিসম্পন্ন হইয়া উঠিয়াছে যে, সূত্রকার, ত্রিকালদর্শী, হিতৈষণাসম্পন্ন ঋষিগণের অনভিপ্রায়েই চলিতে আরম্ভ করিয়াছে এবং তাহার ফল যে অকালমৃত্যু তাহাও উপভোগ করিতেছে। হায়! ইহার কত দিনে শান্তি হইবে? তবে মাতৃগণ এখনও সমাজের অন্ধকার কোনে বসিয়া কতক কতক অনুষ্ঠান করিয়া থাকেন। দেখা যায়, নবীন জামাতা শ্বশুরবাটী আসিলে মাতৃগণ টিটে প্রভৃতি করিয়া খাওয়াইয়া থাকেন। যেমন- সরুচুকালি, আদোসা, গোকুলপিটে ইত্যাদি। এই পিটেগুলির যে সকল উপাদান, সেগুলি পূর্বে এই বাৎস্যায়নোক্ত বৃষ্যযোগরে অনুগতই আছে। বশীকরণযোগের৫/৬/৭/৮ ও ৯ম যোগ দেখ। এখনও জামাতাকে অনেক স্থলে প্রায় একপ্রকার ভোজনের ব্যবস্থা করিয়া দেওয়া হয়। তারপর নতুন জামাতাকে ঠাট্টাতামাসা করিবার জন্য নানাপ্রকার অখাদ্য-কুখাদ্য সংগ্রহ করিয়া দিতে দেখা যায়। ইহা সেই পূর্বোক্ত বৃষ্যযোগের পরিবর্তে অজ্ঞানের ব্যবহার করা হয় মাত্র। পূর্বে শ্যালিকারাই ভগিনীপতির বৃষ্যযোগের পরিবর্তে অজ্ঞানের ব্যবহার করা হয় মাত্র। পূর্বে শ্যালিকারাই ভগিনীপতির বৃষ্যত্বকর ভোক্ষ্য ভোজ্যের আয়োজন করিয়া তাহারই উপলক্ষ্যে হাস্য-পরিহাসাদি করিত; কিন্তু সমাজকুম্ভকর্ণঘোর নিদ্রায় সমস্তই ভুলিয়াছে, রাখিয়াছে কেবল নাকের ঘড়ঘড়ানির স্থানীয় ঐ অকারণ হাস্য-পরিহাসাদি মাত্র। কখনও কি এ নিদ্রা ভাঙ্গিবে না? সম্প্রযুক্ত যুবক-যুবতীর পিতামাতারা কি তাহাদিগের কল্যাণার্থ বৃষ্যযোগটির সুন্দর ব্যবহারের ব্যবস্থা করিবে না? অবশ্য ইহার লম্পটব্যবহারও আছে সত্য; কিন্তু তাই বলিয়া ইহা যে অগ্রাহ্য বোধ হয় একথা কেহই বলিতে সাহস করিবে না।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2