৬.০৮ পুরুষায়িত (নারীর পুরুষোচিত আচরণ)

ষষ্ঠ ভাগ – অষ্টম অধ্যায়

এইরূপে প্রহণনাদি ব্যাপারে আনয়ক পরিশ্রান্ত হইলে, নায়িকা পুরুষের ন্যায় আচরণ করিবে, এই কথায় পুরুষায়িত এবং তদুপযোগী বলিয়া, তদন্তর্গত পুরুষোপসৃপ্তনামক প্রকরণ বলায়, প্রকরণদ্বয়াত্মক এই অধ্যায় আরদ্ধ হইতেছে-
তাহার কারণ দেখান হইতেছে-

নায়ক নিরন্তর কটিচালনাদির অনুষ্ঠানবশত পরিশ্রম প্রাপ্ত হইয়াছে; কিন্তু রাগের উপশম হয় নাই, নায়িকা ইহা বুঝিয়া, নায়কের অনুমতি অনুসারে নায়ককে নিচে অবপাতিত করিয়া, পুরুষবৎ আচরণ দ্বারা নায়ককে সাহায্য প্রদান করিবে। অথবা বিকল্পযোজনার প্রার্থিনী নায়িকা নিজেরই অভিপ্রায়বশে কিংবা নায়কের কৌতুহলচরিতার্থ করিবার জন্য নায়িকা তাদৃশ ব্যাপারে লিপ্ত হইয়া সাহায্য করিতে পারে।।’১।।

সেই পুরুষায়িতব্যাপারে যুক্তযন্ত্রাবস্থায় থাকিয়াই, নায়ককর্তৃক উত্থাপ্যমানা নায়িকা, নায়ককে নিচে অবপাতিত করিবে। এরূপ হইলে, রতব্যাপারের রস অবিচ্ছিন্ন অবস্থায়ই থাকিবে এবং সেইরূপ প্রবৃত্ত হইতেও পারিবে; এই একপ্রকার পথ।
ছাড়িয়া আবার প্রথম হইতেই সেইভাবের আরম্ভের উপক্রম করিবে; ইহা দ্বিতীয় প্রকার পথ।।’২।।

পূর্বে নায়ক যে সকল চেষ্টা দেখাইয়াছিল, নায়িকা কেশকুসুম ছড়াইয়া, শ্বাসের বিচ্ছেদে বিচ্ছেদে হাসিয়া হাসিয়া, বক্ত্রসংসর্গার্থ স্তনদ্বারা বক্ষঃপীড়া উৎপাদন করিয়া, বারংবার মস্তক নামাইয়া নামাইয়া, সেই সকল চেষ্টাই আবার নায়ককে দেখাইবে। যেমন তুমি আমাকে নিচে ফেলিয়া ক্লেশ দিয়াছ, আমিও এখন তোমাকে পাড়িয়া সেইরূপ ক্লেশ দিব।–-এই কথা বলিয়া হাসিবে, তর্জন-গর্জন করিবে ও প্রতিশোধ দিবার জন্য প্রতিঘাত করিবে। আবার মধ্যে মধ্যে স্বীয়স্বভাব লজ্জাও দেখাইবে। শ্রান্ত না হইলেও শ্রম দেখাইবে। রমন করিবার ইচ্ছা থাকিলেও বিরামের ইচ্ছা প্রকাশ করিবে। তারপর, যেমন পুরুষ উপসর্পণ করে, সেইরূপেই করিবে।।’৩।।

পুরুষোপসৃপ্ত যে কি, তাহা পরে বলিতেছি।।’৪।।
এই স্থান হইতেই পুরুষোপসৃপ্ত প্রকরণ আরম্ভ হইল, ইহা দেখাইলেন।।৪।।

পুরুষোপসৃপ্ত দুই প্রকার—বাহ্য ও আভ্যস্তর। তাহার মধ্যে বাহ্যকে অবলম্বন করিয়া বলিতেছেন—

পুরুষ, শয়নস্থ এবং নায়কবাক্যেই যেন বিক্ষিপ্তচিত্ত কামিনীর নীবী (কোমরের বসনরন্ধ) বিশ্লিষ্ট করিবে। তাহাতে নায়িকা ব্যাঘাত জন্মাইতে থাকিলে, কপোলচুম্বনদ্বারা নায়িকাকে পর্যাকুলিত করিয়া তুলিবে। তাহাতেও জাতরাগা না হইলে এবং নিজে সাধনের উচ্ছ্রায়ভাব বুঝিলে কক্ষ, উরু ও স্তনাদিদেশে হস্তদ্বারা স্পর্শ করিবে। যদি প্রথমসঙ্গমে প্রযুক্তা হয়, তবে সংহত উরুদ্বয়ের সন্ধিস্থানে ঘট্টন করিবে। কন্যার সমাগমেও এইরকম বিধেয়। তবে কন্যার পক্ষে বিশেষত্ব এই যে, স্তনযুগলে সংহত হস্তের কক্ষস্থলে, স্কন্ধপ্রদেশে ও গ্রীবায় সঙ্ঘট্টন করিবে। স্বৈরিণীর পক্ষে যথাপ্রকৃতি ও যেমন সম্ভবে, সেইরূপ যোজনা করিবে। নায়িকাকে চুম্বনার্থ অলকপ্রদেশে (কপালের উপরে ছোট চুল যেখানে) নির্দয়ভাবে গ্রহণ করিবে। হনুদেশে অঙ্গুলিসম্পুট দ্বারা দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করিবে। তদ্ভিন্ন যে প্রথমসমাগমে আগতা, তাহার লজ্জা ও চক্ষুনির্মীলন স্বাভাবিক। প্রথমসমাগমে কন্যারও ঐ দুইটি অপরিহার্য; কিন্তু তাহা পূর্বোক্তপ্রকারে অপরারণের চেষ্টা করিয়া, সম্প্রয়োগ করিবে।।’৫।।

রতার্থ যন্ত্রযোগ হইলে, বাহ্য উপায় দ্বারা উপসৃপ্ত নায়িকার অনুরাগ কি করিয়া বুঝিতে পারিবে, এই জন্য আভ্যন্তর প্রয়োগার্থ চেষ্টার পরীক্ষা করিবে।।’৬।।

তন্মধ্যে প্রবৃত্তি কি, তাহা বলিতেছেন—

যুক্তযন্ত্র-পুরুষকর্তৃক নায়িকা উপসৃপ্যমাণা হইয়া, যে স্থানে দৃষ্টিমণ্ডল ঘুরাইবে, সেই স্থান আশ্রয় করিয়া, নায়িকাকে পীড়িত করিবে। যুবতীগণের এটি পরম রহস্য। সুবর্ণনাভ এই প্রকার মত প্রকাশ করেন।।’৭।।
এটি শাস্ত্রকারের মত; কারণ, কোনপ্রকার প্রতিবাদ করেন নাই; সুতরাং গ্রাহ্য।।৭।।

উপসৃপ্যমাণা নায়িকার অবস্থা তিনপ্রকার হইয়া থাকে। প্রাপ্ত, প্রত্যাসন্ন এবং সন্ধুক্ষ্যমাণ। ক্রমশ এই তিনটির লক্ষণ বলিতেছেন—

গাত্রস্রংসন (গা-ঝাড়া মারা), চক্ষুমুর্দ্রিত করা, লজ্জার বিলোপ, সমধিক রতিযোজনা।–-এইগুলি স্ত্রীদিগের ভাব লক্ষণ।।’৮।।

সন্ধুক্ষ্যমান ভাবের লক্ষণ বলিতেছেন—

হস্ত বিধুনন করে (হাত ছোড়ে); স্বিন্ন (ঘর্মাক্রান্ত) হয়; দংশন করে (কামড়ায়); যন্ত্রযোগ হইতে উঠিতে দেয় না; পদদ্বারা আঘাত করে; পুরুষ রতিপ্রাপ্ত হইলে পরে, নায়িকা তাহাকে অতিক্রম করিয়া, নিজের জঘনব্যাপার করিতে থাকে।।’৯।।

তাহার যন্ত্রযোগের পূর্বে করদ্বারা গজের ন্যায় সম্বাধকে ক্ষোভিত করিবে। ধীরে ধীরে আরম্ভ করিয়া, যখন বুঝিবে—সম্বাধের অভ্যন্তর কোমলভাব ধারণ করিয়াছে এবং তদ্দ্বারা তাহারও রতি প্রায় প্রত্যাসন্ন, তখন যন্ত্রযোগ করিবে।।’১০।।

সম্বাধ পরীক্ষা করিয়া দেখিবে; সম্বাধ চারি প্রকার—ভিতরে পদ্মদল স্পর্শ, ভিতরে গুটিকাবৎ স্পর্শ, ভিতরে বলির ন্যায় স্পর্শ এবং ভিতরে গো-জিহ্বার ন্যায় স্পর্শ। ইহার মধ্যে, ভিতরে যাহার কোমল স্পর্শ, তাহার অল্পপ্রয়োগেই রতিপ্রাপ্তি ঘটে, সুতরাং তাহার পক্ষে আন্তর উপসৃপ্তি অপ্রযোজ্য। এইজন্য তাহাকে পরিত্যাগ করিয়া, করিকরাগ্রহস্তে অন্য ত্রিবিধ সম্বাধের আন্তর উপসৃপ্তি করিবে। করিকরাগ্র যথা—অনামিকা ও কনিষ্ঠাকে অঙ্গুষ্ঠের সহিত সম্বন্ধ করিয়া, তর্জনী ও মধ্যমাকে সরল রাখিলে করিকরাগ্রবৎ দেখিতে হইবে।।১১।।

পুরুষোপসৃপ্ত দশ প্রকার—উপসৃপ্তক, মন্থন, হুল, অর্ধমর্দন, পীড়িতক, নির্ঘাত, বরাহঘাত, চটক-বিলসিত এবং সম্পুট। সাধনের সহিত সম্বাধের মিশ্রণ হইলেই উপসৃপ্তক বলা যায়। তার মধ্যে আবার যেটি সরলভাবে সর্বজনবিদিত মিশ্রণ, তাহাকে উপসৃপ্তক বলে। সাধনকে হস্ত স্বারা ধরিয়া চারদিকে ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া মন্থন করিলে তাহাকে মন্থন কহে। স্ত্রীর জঘন নিচ করিয়া, হুল ফুটাইয়া দিবার ন্যায় উপরিভাগ হইতে যে ঘট্টন করা যায়, তাহাকে হুল বলে। সেই ঘট্টন বিপরীত হইলে, অর্থাৎ জঘনকে উচ্চ করিয়া, তাহার উচ্চভাগকে সবেগে ঘট্টন করিলে, তাহাকে অবমর্দন কহে। যোগসহকারে আমূল প্রবিষ্ট করিয়া ঘাতে ঘাতে সম্বাধকে পীড়িত করিবে, ইহাকে পীড়িতক কহে। সাধন বহুদূর উত্তোলিত করিয়া, সবেগে যে সম্বাধে নির্ঘাত করা যায়, তাহাকে নির্ঘাত বলে। সম্বাধের একপার্শ্বে বহুবার দৃঢ় ঘাতে ঘাত করিবে, তাহাকে বরাহঘাত বলা যায়। সেইরূপ ঘাত দৃঢ়ভাবে উভয় পার্শ্বেই পর্যায়ক্রমে বারংবার করিবে, তাহালে বৃষাঘাত কহে। ভিতরে প্রবিষ্ট করিয়া, আর বাহির না করিয়া, কিছু ভাগ উপরে আকর্ষণ করিয়া সেই স্থানেই দুই, তিন, কি চারিবার সংঘট্টন করিবে। যতক্ষণ রতি না হয় ততক্ষণ সেইরূপই বারবার করিবে, ইহাকে চটকবিলসিত কহে। সম্পুটবিষয়ে পূর্বে সকল কথা কথিত হইয়াছে।।’১১।।

সেই সকল উপসৃপ্তকগুলির প্রয়োগ স্ত্রীগণের স্বভাব জানিয়া প্রয়োগ করিতে হইবে। প্রয়োগ অবশ্য মৃদুমধ্যাতিমাত্রভেদে বিকল্পে করিতে হইবে।।’১২।।
এই স্থলে একটু বুঝিতে হইবে যে, পুরুষোপসৃপ্তে যাহা বাহ্য স্ত্রীনীবীমোক্ষণাঙ্গ, তাহা দ্বিতীয় মার্গে (দ্বিতীয় পথে) নায়ককক্ষাবন্ধবিশ্লেষণাদি বাহ্য পুরুষায়িত। আর যাহা আভ্যন্তর উপসৃপ্ত, তাহা মার্গদ্বয়েই (সহজ ও বিপরীত শৃঙ্গারে) আভ্যন্তর পুরুষায়িত বলিয়া ব্যবহার্য।।১২।।

পুরুষোপসৃপ্ত নামক প্রকরণ বলিয়া, তাহার বিশেষত্ব বিধানার্থ পুরুষায়িতবিষয় পুনরায় কীর্তন করিতেছেন–
পুরুষায়িত দ্বিবিধ—বাহ্য ও অভ্যন্তর; প্রথমকে উপলক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন—

পুরুষায়িত সন্দংশ, ভ্রমরক এবং প্রেঙ্খোলিত, এই তিনটি অধিক।।’১৩।।

বড়বাসম্বাধের ন্যায় সম্বাধের ওষ্ঠপুট দ্বারা সাধনটি চাপিয়া ধরিয়া অন্তর প্রদেশে আকর্ষণ বা পীড়নকারিণী নায়িকার যে চিরাবস্থান, তাহাকে সন্দংশ বলা যায়।।’১৩।।

যুক্তযন্ত্রা হইয়া চক্রের ন্যায় ভ্রমণ করিবে। ইহা অভ্যাস করিয়া শিখিতে হয়। ইহাকে ভ্রমরক বলা হয়।।’১৪।।

সেই ভ্রমরকে নায়ক ভ্রমরকসৌকার্যার্থ নিজের জঘন ঊর্ধ দিকে উর্ত্থিত করিয়া ধরিবে।।’১৫।।

সেই অবস্থায় নায়ক স্বীয় জঘনকে দোলায়মান করিয়া, চারিদিকে ভ্রামিত করিবে। ইহাজে প্রেঙ্খোলিতক বলা যায়।।’১৬।।

‘—পৃষ্ঠের দিকে লইয়া, অগ্র দিকে লইয়া; বাম পার্শ্বে লইয়া, দক্ষিণ পার্শ্বে লইবে। ইহা মণ্ডলভাবে ভ্রমিত হইলেই মন্থনান্তর্ভূত। ইহার প্রয়োগ বিকল্পেও হইতে পারে।।’১৭।।

পরিশ্রম বোধ করিলে, ললাটে ললাট রাখিয়া যুক্তযন্ত্রাবস্থাতেই বিশ্রাম করিবে।।’১৮।।

নায়িকা বিশ্রান্ত হইলে পুরুষ আবার সেইরূপে ক্রিয়ার আবৃত্তি করিবে। এই পর্যন্তই পুরুষায়িত প্রকরণ।।’১৯।।

এ বিষয়ে শ্লোক আছে—

লজ্জা স্বারা স্ত্রীজাতির স্বভাব প্রচ্ছাদিত হইলে এবং কামিনীর অভিপ্রায়সূচক আকার গোপিত হইলেও স্ত্রী যদি উপরিবর্তিনী হয়, তবে রাগবশে নিজভাব (অভিপ্রায়) প্রকাশ করিয়াই ফেলে।।’২০।।

নারীর যে প্রকার স্বভাব এবং সে যে প্রকার রতিতে তৃষ্ণা প্রকাশ করে; তাহাকে উপরিবর্তিনী করিয়া, তাহার বিশেষ বিশেষ চেষ্টা দ্বারা, সে সকল জানিয়া লইবে। পরে আবার নিজে সম্প্রযুক্ত হইয়া, সেই সকল বিশেষ বিশেষ চেষ্টা দ্বারা, তাহার রতিলালসার পূরণ করিতে পারিবে।।’২১।।

ঋতুকালে ঋতুমতীকে, অচিরপ্রসূতাকে, মৃগীকে, গর্ভিণীকে এবং অত্যন্ত ‘লম্বা চৌড়া’ (অতিদীর্ঘা) নারীকে পুরুষায়িতে নিয়োজিত করিবে না।।’২২।।
করিলে গর্ভগ্রহণ হইবে না। প্রদর ও কটিনির্গম হইতে পারে। সহ্য করিতে সম্পর্থ হইবে না। গর্ভস্রাব হইতে পারে। ব্যাপার করিতে শক্তিতে কুলাইবে না।।২২।।

ইতি শ্রীমদ্‌-বাৎস্যায়নীয়কামসূত্রে সাম্প্রয়োগিকনামক ষষ্ঠ-অধিকরণে পুরষোপসৃপ্ত এবং পুরুষায়িতনামক অষ্টম অধ্যায় সমাপ্ত।।৮।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2