৬.০৫ দশনচ্ছেদ্যবিধি ও দৈশিক উপচার নির্ণয়

ষষ্ঠ ভাগ – পঞ্চম অধ্যায়

পূর্ব্ব অধ্যায়ে নখচ্ছেদ্যনিরূপণার্থ উপক্রম করিয়া তদধিক দশনচ্ছেদ্যও নির্ণয় করিবার জন্য প্রকরাণানুসারে যথাসম্ভব কথিত হইয়াছে, কিন্তু সেগুলি কাল ও দেশের প্রবৃত্তির অনুরূপ না হইলে রাগবর্দ্ধনের কারণ হয় না; সুতরাং এ অধ্যায়ে দেশপ্রবৃত্তির অনুরূপ উপচার নির্ণয়ার্থ উপক্রম করিতেছেন। এ অধ্যায়ে প্রকরণদ্বয় কথিত হইবে।

তন্মধ্যে পূর্বে  চ্ছেদ্যের স্বরূপ, বিষয় ও কাল নির্দিষ্ট হইয়া গিয়াছে; কিন্তু স্থান নির্ণয় করা হয় নাই। এইজন্য এস্থলে তাহার স্থাননির্ণয় করিতেছেন—

উত্তরৌষ্ঠ, অন্তর্মুখ—জিহ্বা ও নয়ন পরিত্যাগ করিয়া অন্য সকল স্থানগুলিই দন্তবিলেখনযোগ্য বলিয়া জানিবে।।’১।।
ললাট, অধর, ওষ্ঠ, গল, কপোল, বক্ষঃ এবং স্তন, লাটদিগের ঊরুসন্ধি, বাহু ও নাভিমূল দশনবিলেখনের উপযুক্ত স্থান।।১।।

দশনপঙ্‌ক্তির গুণকীর্তন করিতেছেন—

সমান, স্নিগ্ধচ্ছায়া (খস্‌খসে নহে), রাগগ্রাহী (তাম্বুলভক্ষণাদি করিলে লোহিত হয়), উপযুক্ত প্রমাণ (মোটা ঢেবা ইত্যাদি নহে), নিশ্ছিদ্র (বেশ ঘন ঘন গ্রথিত) এবং তীক্ষ্ণাগ্রসম্পন্ন দন্তগুলি হইবে। দশনের গুণ এই প্রকারের জানিতে হইবে।।’২।।
সমানতা ও স্নিগ্ধচ্ছায়াসম্পন্নতা—এই গুণদ্বয় দশনের শোভার্থ। উপযুক্ত প্রমাণতা, ঘনত্ব এবং তীক্ষ্ণাগ্রত্ব; এই তিনটি গুণ শোভার্থ ও ছেদ্যার্থ দ্রষ্টব্য।।২।।

কুন্ঠত্ব (কুড়েমারা, পোকায় খাওয়া, কালাটে ইত্যাদি), যাহার মধ্যে ফাটিয়া রেখা উদ্গত হইয়াছে, পরুষ (ঘস্‌খসে), বিষম (উচ্চনীচভাবের ট্যাডা-বেঁকা ভাবের) শ্লক্ষ্ণ ও পৃথু (ঢেরা চেপটা ইত্যাদি) এবং বিরল (ফাঁক ফাঁক ওঠা), দন্তের দোষ।।’৩।।
যদিও গুণকীর্তন করিলেই তদ্বিপরীতগুলি দোষ ধরিয়া লওয়া যাইত; তথাপি দোষকীর্তন করায় বুঝিতে হইবে, এগুলি প্রধান দোষ। তাহা হইলে, যদি দশনে তাম্বুলরাগ প্রভৃতি গ্রহণ না করিতে পারে, তবে তাহা একান্ততঃ দোষের হইবে না। দেখিয়ে পাওয়া যায়, শুদ্ধদন্ত প্রায়শই বর্ণিত হইয়া থাকে। ইহার মধ্যে রাজ্যূদ্গত। পরুষ ও বিষম, এই তিনটি আননের শোভালোপকারী এবং কুন্ঠতাদি কার্যকরণে অসামর্থ্যবশতঃ দোষপদবাচ্য বলিতে হইবে।।৩।।

গূঢ়ক, উচ্ছূনক, বিন্দু, বিন্দুবালা, প্রবালমণি, মণিমালা, খণ্ডভ্রক এবং বরাহচর্বিতক—এইগুলি দশনচ্ছেদ্যের প্রকার।।’৪।।

সংক্ষেপতঃ দশনচ্ছেদনবিকল্প কথিত হইল। ইহার লক্ষণ ও প্রয়োগ-স্থান বলিতেছেন—

কেবলমাত্র রাগ প্রদর্শিত হয় এবং অনতিলোহিত চিহ্নের দ্বারা বুঝিতে পারা যায় যাহা তাহাকে গূঢ়ক কহে।।’৫।।
একটি শ্রেষ্ঠ দন্ত দ্বারা কামড়াইয়া নিষ্পাদিত করিবে।।৫।।

তাহাই পীড়ন দ্বারা উৎপাতিদ হইলে উচ্ছুনক নামে অভিহিত হয়।।’৬।।
অর্থাৎ চিহ্নপরিমিত স্থান ফুলিয়া উঠিলে উচ্ছুনক নাম হইবে।।৬।।

সেই দুইটিও বিন্দু; এই তিনটি অধরমধ্যে বিনিপাত্য।।’৭।।

উচ্ছুনকের আরও বিশেষ স্থান কথিত হইতেছে–
উচ্ছুনক ও প্রবালমণি, এই দুটি কপোলতলে প্রযোজ্য।।’৮।।

কোন্‌ কপোলে কি বিনিপাত্য, তাহা বলিতেছেন–
কর্ণপূর চুম্বন ও নখদশনচ্ছেদ্য বাম কপোলের অলঙ্কারস্বরূপ হয়।।’৯।।
দন্ত ও ওষ্ঠ সংযোগে বারংবার গ্রহণ করিয়া যে পীড়ন করা যায়, তদ্দ্বারা প্রবালমণির সিদ্ধ হয়।।’১০।।
ইহাদ্বারা ক্ষতবিবর্জিত লোহিত দন্তৌষ্ঠপদবিন্যাস নিষ্পন্ন হইয়া থাকে; তাহাকে প্রবালমণি বলা যায়।।১০।।

এই প্রকার প্রক্রিয়ায় মালাকারে পীড়ন করা হইলে, যে মালাকার লোহিত পদবিন্যাস হয়, তাহাকে মণিমালা বলা যায়।।’১১।।

উত্তর অধর ও দশনাগ্রপ্রয়োগে ত্বকের অল্পদেশমাত্র গ্রহণ করিয়া যে সন্দংশ, অর্থাৎ খণ্ডন করা যায়, তাহাদ্বারা বিন্দুসিদ্ধি হয়।।’১২।।

সমস্ত দশন দ্বারা যে বিন্দুশ্রেণীর উৎপাদন করা যায়, তাহাকে বিন্দুমালা বলে।।’১৩।।

অতএব মালাদ্বয়ই গলদেশ, কক্ষ ও বঙ্‌ক্ষণদেশে নিপাত্য।।’১৪।।
কারণ, ঐসকল স্থানের ত্বক মাংসল নহে, পাতলা।।১৪।।

ললাটে ও ঊরুদ্বয়ে বিন্দুমালা প্রযোজ্য।।’১৫।।

মণ্ডলাকারে—পৃথু, মধ্য ও সূক্ষ্ণ দশন দ্বারা চারিদিকে গ্রহণ করিয়া কেবল স্তনপৃষ্ঠেই পীড়িত করিবে, তদ্দ্বারা যে চিহ্ন জন্মাইবে, তাহাকে খণ্ডাভ্রক নামে অভিহিত করা যায়।।’১৬।।

স্তনপৃষ্ঠের একভাগ হইতে অল্পত্বক গ্রহণ করিয়া দশনসন্দংশ দ্বারা চর্বিত করিবে। সেটি ছাড়িয়া আরও একটি দেশে চর্বণ করিবে। এইরূপ উপর্যুপরি চর্বণ করিতে থাকিলে, নিরন্তর অতিলম্ব বহু—চারিটি কি ছয়টি দশনপদপঙ্‌ক্তির রেখাপাত হইবে। তাহার মধ্যভাগে লোহিতবর্ণ হইয়া যাইবে; সুতরাং তাহাকে বরাহচর্বিতক নামে নির্দেশ করা যায়।।’১৭।।

তদুভয়ই চণ্ডবেগ-নায়ক-নায়িকার প্রযোজ্য। এইরূপে দশনচ্ছেদ্য সম্পাদনীয়।।’১৮।।
ইহার প্রয়োক্ত্রী নায়িকাও হইতে পারে। দেশ, কাল ও কার্যবশে কোন একটি অসাধারণ হইতে পারে; কিন্তু তাই বলিয়া সকলগুলিই যে অসাধারণ হইবে, তাহার কোনও কারণ দেখা যায় না। সমুদায়ে এতগুলিই দশনচ্ছেদ্য সম্প্রয়োগ-প্রযোজক মাত্র।।১৮।।

আকারপ্রদর্শনার্থ সাংক্রান্তিক আভিযোগিক কি, তাহা বলিতেছেন–
ভুর্জপত্রাদিকল্পিত তিলক—বিশেষকে, নীলোৎপলাদিকল্পিত কর্ণপূরে, পুষ্পরচিত আপীড়ে ও শেখরে, সংসঞ্জিত তাম্বুলে এবং সুরভি তমালপত্রে মদনলেখ—কল্পিত কামসূচকপত্রে। তাহাতেই নখচ্ছেদ্য ও দশনচ্ছেদ্য (কোন গোপনীয় অঙ্গে কর্তব্যচ্ছেদ্য নায়িকাকে কৌশলে বুঝাইবার জন্য তাদৃশচ্ছেদ্য ঐ সকল আধারে) করিয়া প্রযোজ্যা নায়িকা বা প্রযোজ্য নায়কের নিকট পাঠাইবে। ইহাকে আভিযোগিক নামে অভিহিত করা যায়।।’১৯।।
অর্থাৎ নায়ক বা নায়িকা, নায়ক বা নায়িকাকে লক্ষ্য করিয়া নিজের মনের ভাব জানাইবার জন্য ঐ সকল দ্রব্যে, যে সকল চ্ছেদ্য গোপনীয় অঙ্গে কর্তব্য, সেইসকল চ্ছেদ্য করিয়া পাঠাইবে। নায়ক বা নায়িকা তাহা দেখিয়া প্রেরণাভিপ্রায় স্পষ্টরূপেই বুঝিবে। ইহাকে আভিযোগিক কহে।।১৯।।

দশনচ্ছেদ্যবিধি এই পর্যন্তই জানিবে।

ইহার পর দেশপ্রবৃত্ত-দেশ্য উপাচার কি, তাহাই বলা যাইতেছে—

দেশের স্বভাব অনুসারে কামিনীদিগের সম্প্রয়োগ উপচার ব্যবহার করিবে।।’২০।।
কামিনীগণও পুরুষদিগের উপচার দেশস্বভাবানুসারে বিধান করিবে।।২০।।

মধ্যদেশে উদ্ভূতা আর্যপ্রায়া কামিনীরা শুচি-উপচারের ব্যবহার করিয়া থাকে। তাহার চুম্বন, নখ ও দন্তপদের চ্ছেদকে দ্বেষ করিয়া থাকে।।’২১।।
হিমালয় ও বিন্ধের মধ্যবর্তী কুরুক্ষেত্রের পূর্ব ও প্রয়াগের পশ্চিমসীমান্তবর্তী দেশই মধ্যদেশ। বাৎস্যায়নের অভিমতও সেইরূপ। তদ্দেশোৎপন্ন কামিনীগণ আলিঙ্গন করিতে ভালবাসে, কিন্তু উক্তত্রয়কে দ্বেষ করিয়া থাকে; কারণ, তাহারা পবিত্রাচারসম্পন্ন আর্যকল্প।।২১।।

সেইরূপ বাহ্লীকদেশজাত ও অবন্তিপুরসন্নিহিতদেশপ্রাদুর্ভব কামিনীগণও।।’২২।।
বাহ্লীকদেশজাতা—উত্তরাপাথিকা। আবন্তিকা উজ্জয়িনীদেশভবা। তাহাদিগকে অপরমালবী কহে। তাহারাও চুম্বনাদি তত ভালবাসে না।।২২।।

কিন্তু ইহারা চিত্ররত ব্যাপারে অতীব অনুরক্ত।।’২৩।।
অন্যন্ত প্রীতিকর বলিয়া ইহারা চিত্ররত বড়ই ভালবাসে। চিত্ররত কি, তাহা পরে বলা যাইবে।।২৩।।

পূর্বমালবজাত কামিনীগণ, আলিঙ্গন, চুম্বন, নখদন্তচ্ছেদ ও চুষণপ্রধান, ক্ষতবর্জিত, প্রহণনসাধ্য রতব্যাপার অত্যন্ত প্রিয় মনে করে।।’২৪।।
শ্রীকন্ঠ কুরুক্ষেত্রাদি ভূমি আভীরদেশ। তদ্দেশজাত কামিনীগণ চুম্বনাদিকে অতিরিক্ত ভালবাসে।।২৪।।

বিপাশা, শতদ্রু, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা ও সিন্ধু—এই ছয়টি নদীর মধ্যবর্তী দেশে জাত কামিনীগণ ঔপরিষ্টক অত্যন্ত ভালবাসে।।’২৫।।
আলিঙ্গন ও চুম্বনাদি ব্যাপার তাহাদের প্রিয় হইলেও তাহারা মুখেই জঘনকার্য শেষ করিয়া থাকে।।২৫।।

পশ্চিম সমুদ্রের সমীপবর্তী দেশে জাত ও অপরমালবদেশের পশ্চিমসীমান্তবর্তী দেশভব কামিনীরা চণ্ডবেগা; কিন্তু সীৎকার ও প্রহার অল্প সহিতে পারে।।’২৬।।

বজ্রবন্তদেশের পশ্চিমে স্ত্রীরাজ্য ও কোশলদেশের কামিনীগণ খরবেগা, দৃঢ়প্রহারসহনশীলা, এবং অপদ্রব্যপ্রধানা।।’২৭।।
সম্প্রয়োগকালে দৃঢ়প্রহারে প্রীতিলাভ করে। কণ্ডূতির আধিক্যবশত তৎপ্রতিকারার্থ কৃত্রিমসাধন অপেক্ষা করে।।২৭।।

নর্মদার দক্ষিণে দক্ষিণাপথ। তাহারই মধ্যে কর্ণাটরাজ্য। সেই রাজ্যের পূর্বে অন্ধ্ররাজ্য। তত্রত্য কামিনীরা স্বভাবত মৃদুশরীর। তাহারা রতিপ্রিয়া; কিন্তু দৃঢ়প্রহণন সহিতে পারে না। তাহাদের আচার শুচি নহে। সদাচার একরূপ নাই বলিলেই হয়।।২৮।।’

নর্মদা ও কর্ণাটরাজ্যের মধ্যবর্তী দেশ মহারাষ্ট্র। তত্রত্য কামিনীগণ পাঞ্চালিকী চতুঃষষ্টি ও গীতাদি চতুঃষষ্টিকলাপ্রয়োগে অনুরাগসম্পন্না, অশ্লীল ও নিষ্ঠুর বাক্য বলে ও সহিতে পারে এবং তাহারা সম্প্রয়োগে ধৃষ্টতা ও উদ্ভটতা-সহকারে বলাৎকারপূর্বক পুরুষকে অভিযুক্ত করে।।’২৯।।

পাটলিপুত্রদেশজাত নায়িকারাও সেইরূপ, তবে নির্জনদেশেই অশ্লীল ও পুরুষবাক্য বলিয়া থাকে। ইহারাও সকলচতুঃষষ্টিকলার প্রয়োগে অনুরাগিণী; কিন্তু বিজন দেশে। আর মহারাষ্ট্রিকেরা প্রকাশ্যভাবে ও নির্জনেও সকল বিষয় প্রকাশ করিয়া থাকে।।’৩০।।

কর্ণাটরাজ্যের দক্ষিণে দ্রবিড়দেশ; তত্রভব কামিনীগণ যন্ত্রযোগের পূর্বে আলিঙ্গনাদি অভিযোগের আরম্ভ হইতেই পুরুষকর্তৃক অন্তরে ও বাহিরে মৃদ্যমান হইলে, অবয়ব শিথিলীকৃত করিয়া অল্প অল্প মুর্ছনাসুখরহিত ক্ষরণ করিতে থাকে। তারপর, অন্তে বিসৃষ্ট হয়। ইহা দ্বারা তাহারা একই রতব্যাপারে পরিতৃপ্ত হইয়া থাকে।।’৩১।।

কৃঙ্কণদেশের পূর্বে বনবাসরাজ্য। তত্রত্য কামিনীরা মধ্যমবেগা, ভাবত ও কালত সমালিঙ্গনাদি সহিতে পারে। নিজশরীরের দোষ ব্যক্তি হইলেও ঢাকিতে ভালবাসে। পরকে উপহাস করিতে ভালবাসে। অশ্লীল ও নিষ্ঠুরবাক্য বলিতে ভালবাসে না। যে তাদৃশ্য নিষ্ঠুর ও অশ্লীলবাক্য প্রয়োগ করে, তাহার সহিত সম্প্রয়োগ করিতে ইচ্ছাও করে না।।’৩২।।

সারস্বত, কান্যকুব্জ, বাঙ্গালা, মিথিলা ও উৎকল—এই পাঁচটি প্রদেশকেই গৌড়দেশ বলা হয়। বস্তুত গৌড়দেশ বলিলে বাঙ্গালা দেশকেই বুঝায়। সেই দেশসম্ভূত কামিনীরা কোমলভাষিণী, অনুরাগবতী ও কোমলকলেরবা। ইহারা মধ্যবেগা। ভাবত ও কালত সমালিঙ্গনাদি সহিতে পারে। ইহারা নিজ অঙ্গের দোষ ঢাকিতে ও পরাঙ্গের দোষ দেখিয়া উপহাস করিতে বড়ই পরিপটু। ইহারা রূপে ও ব্যবহারে কুৎসিত এবং অশ্লীল ও নিষ্ঠুরবাক্য-প্রয়োগকারীকে স্পর্শ করিতে ইচ্ছা করে না বা অশ্লীল ও নিষ্ঠুরবাক্য প্রয়োগ করিতে ভালবাসে না। আর অতীব লজ্জাশীলা।।’৩৩।।

সুবর্ণনাভ বলেন—দেশস্বভাবানুসারে ও প্রকৃতিজাতস্বভাবানুসারে উপচার প্রযোজ্য। তবে সেখানে উভয়সন্নিপাতে বিরোধ উপস্থিত হইবে, সেখানে দেশস্বভাব পরিত্যাগ করিয়া, প্রকৃতিজাত স্বভাবের অনুসারে উপচার প্রয়োগ কর্তব্য; কারণ, দৈশিক স্বভাব অপেক্ষা প্রাকৃতিক স্বভাব বলবান্‌।।’৩৪।।
আচার্যদিগের মত—প্রাকৃতিক স্বভাব পরিত্যাগ করিয়া দৈশিক স্বভাবানুসারে উপচার প্রযোজ্য। সুবর্ণনাভ ঠিক তাহার বিপরীত বলিতেছেন, অথচ বাৎস্যায়ন তাহার কিছুমাত্র প্রতিবাদও করিলেন না। অতএব ইহাদ্বারা বুঝিতে পারা যাইতেছে, বাৎস্যায়নেরও এই মতই স্বীকার্য হইবে; কারণ, এ মতের খণ্ডন তিনি করেন নাই, এস্থলে উপস্থাপিত করিয়াছেন মাত্র।
(দেখা যায়—সমুদ্রপারজাতা বিড়ালাক্ষী কামিনীরা প্রথমত এদেশে আসিয়াও সেই সামুদ্রিক বা সামুদ্রপারিক উপচারেই সম্প্রীত থাকে; কিন্তু বহুকাল এতদ্দেশেই অবস্থান করায়, এতদ্দেশীয় জলবায়ু ও আহার্যরসের গুণে তাহাদিগের প্রকৃতির অনেক পরিবর্তন সাংসাধিত হয়। তখন তাহারা আভিমানিক সামুদ্রপারিক উপচারের পক্ষপাতী হইলেও তাহাকে প্রকৃত প্রীতিলাভ করিতে পারে না। তজ্জন্য তাহারা এতদ্দেশীয় উপচারের অম্বেষণ করে ও তাহার প্রয়োগে পরম প্রীত হয়; সুতরাং প্রাকৃতিক স্বভাব দুই প্রকারের বলিতে পারা যায়ঃ  এক, আভিমানিক, অর্থাৎ পূর্বপ্রকৃতিসম্পন্নার আভিমানিক প্রাকৃত স্বভাব; আর প্রকৃতই প্রাকৃতিকস্বভাব। এই প্রকৃত প্রাকৃতিকস্বভাবও তীব্র, মধ্য ও মন্দদেশ ত্রিবিধ। যাহার প্রকৃতি অতীব তীব্র এবং শারীরিক অবস্থা বেশ স্বচ্ছন্দ, সেই প্রকৃত তীব্র প্রাকৃতিস্বভাবসম্পন্না। সে কামিনী দৈশিক স্বভাবের বিপরীত স্বভাবসম্পন্না হইলে, তাহার পক্ষে দৈশিক স্বাভাবানুসারে উপচার প্রয়োগ করিলে, সেটি প্রীতির অনুকুল হইতে পারে না; কিন্তু তাহা বিপরীত প্রীতিরই হেতু হইবে। আর যাহার প্রকৃতি মধ্যস্বভাব, সে কথঞ্চিৎ অপ্রিয় হইলেও বিপরীত দৈশিক উপচার লইয়া প্রীত থাকিতে পারে। কিন্তু যে মন্দপ্রকৃতিজাত স্বভাবসম্পন্না, সে ত আর স্বীয় স্বভাবানুসারে উপচার লইয়া প্রীত থাকিতে ইচ্ছা করিবে না। তাহার পক্ষে দৈশিক উপচার প্রয়োগই বুদ্ধি ও বিবেচনার কার্য; কারণ, তাহার সেই মন্দপ্রকৃতিজাত স্বভাবকে দৈশিক স্বভাবজাত উপচার দ্বারা অর্চিত করিলে মিশ্রণবশে—কালে স্বভাবের তীব্রতা সংসাধিত হইতে পারে। কিন্তু যদি প্রকৃতিতে স্বাভাবানুসারে তাহার পক্ষে উপচার প্রযুক্ত হয়, তবে আর তাহার স্বভাবের উৎকর্ষসাধনপক্ষে কিছুমাত্র সহায়তা করিতে উপদেশ করা হইল না—ভাষ্যকারের এই চিন্তা করা উচিত ছিল। তাহার পর, সন্নিপাতের কথা। মন্দপ্রকৃতিজাতস্বভাবসম্পন্নার পক্ষে দৈশিক উপচার প্রযুক্ত হইলে সন্নিপাত হইবে না। আভিমানিক প্রাকৃতিকস্বভাবসম্পন্নার পক্ষে দৈশিক উপচারের প্রয়োগও সন্নিপাতের কিছুমাত্র নিদান হইবে না। মধ্যপ্রকৃতিজাত-স্বভাবসম্পন্নার পক্ষেও তথৈবচ। কেবল তীব্র প্রকৃতিজাত-স্বভাবসম্পন্নার পক্ষে দৈশিক উপচারে প্রয়োগ-সন্নিপাতের চিন্তা; কিন্তু সেও যদি তৎকালে স্বভাবত দুর্বলই থাকে বা শোকাদিপরিভূর থাকে, তবে ত সন্নিপাতের কিছুমাত্র আশঙ্কা নাই। সুস্থ হইলেই সন্নিপাতের আশঙ্কা; কিন্তু ভাবিয়া দেখিলে, সে সন্নিপাতের জন্য তাদৃশ চিন্তিত হওয়ার কোনই হেতু দেখিতে পাওয়া যায় না; কারণ, প্রকৃতির গঠন অবশ্য আহার্যরসের অংশ হইতেই হয়। আহার্যগুলি যে দেশের জলবায়ু কি রসাদি দ্বারা লালিত-পালিত ও বর্ধিত, তাহারা কি তদ্দেশের প্রকৃতিসম্পন্ন না হইয়া পারিবে? কখনই নহে; সুতরাং প্রকৃতিজাত স্বভাবের উপচারের সহিত দেশজস্বভাবের উপচারের এমন কোনই বিরোধের গুরুত্ব উপলব্ধি করিতে পারা যায় না, যদ্দ্বারা দৈশিক স্বভাবের উপচারকে সন্নিপাতস্থলে পা দিয়া ঠেলিতে হয়। অতএব ভাষ্যকারের প্রদর্শিত মত সম্বন্ধে মণিষীগণ পূর্বেই বলিয়া আসিয়াছেন—‘দেশসাত্ম্যাচ্চ যোষিত উপচরেৎ।’ দৈশিক উপচারেই কামিনীগণের অর্চনাদি করিবে। তাহার অর্থ কি অতি অল্পদূরে আসিয়াই বিস্মৃত হওয়া ভাষ্যকারের যুক্তিসঙ্গত হইয়াছে? সুতরাং সুবর্ণনাভের মতটি পরিশেষে দেখানর উদ্দেশ্য বোধহয় পরিগ্রহের নিমিত্ত নহে। যদি পূর্বে নিজের মত প্রকাশ না করিতেন, অথচ পরে সুবর্ণনাভের মতটিই দেখাইয়া স্থির থাকিতেন, তবে বলিতে পারিতাম—এ মতটি গ্রহণের জন্য প্রদর্শিত হইয়াছে। যখন সেরূপ নহে, তখন বোধহয় সে মতটি পরিগ্রহের জন্য নহে। বোধহয়ই বা কেন? নিশ্চয়ই পরিগ্রহের জন্য নহে; কিন্তু বিরুদ্ধস্বভাবমাত্র প্রদর্শন করিয়া উপেক্ষাএ জন্যই বলিতে হইবে)।।৩৪।।

কালের গতিবশে একদেশ হইতে অন্যদেশ, উপচার, বেশ এবং লীলা (চেষ্টাবিশেষ)—এই সকলের অনুগমন হইয়া থাকে, সুতরাং সেসকল জানিয়া রাখিবে।।’৩৫।।
এরূপ না করিলে, বিপরীত উপচারাদি দেখিয়া মনে করিবে, এ নায়ক বা নায়িকা সেই দেশজাত (যে দেশের সেই উপচারাদি)। তাহাতে নায়ক বা নায়িকার চৈতন্য ঘটিতে পারে। অতএব সঞ্চারি-বেশ-উপচারাদি পরিত্যাগ করিয়া, তদ্দেশপ্রভব স্থায়ী বেশ-উপচারাদি নির্দ্ধারিত করিয়া, তাহা প্রকৃতিসুখকর, তাহারই ব্যবহার করিবে।।৩৫।।

উপগূহনাদিষ্টকের পূর্ব পূর্ব গুলি রাগবর্দ্ধন এবং উত্তর উত্তর গুলি বিচিত্র।।’৩৬।।
অর্থাৎ আলিঙ্গন, চুম্বন, নখদশনচ্ছেদ্য, প্রহণন ও সীৎকৃত—এই ছয়টির পূর্ব পূর্ব অর্থাৎ শ্রুতিরমণীয় সীৎকৃত অপেক্ষা প্রহণন স্পর্শকর; সুতরাং রাগবর্দ্ধন। তদপেক্ষা দশনচ্ছেদ্য, তদপেক্ষাও নখচ্ছেদ্য, তদপেক্ষা চুম্বন এবং তদপেক্ষাও সার্বাঙ্গিক আলিঙ্গন অতিস্পর্শকারী; সুতরাং অতি রাগবর্দ্ধন। পর পর বিচিত্র, অর্থাৎ আলিঙ্গন হইতে চুম্বন, চুম্বন হইতে নখচ্ছেদ্য ইত্যাদি। যে হেতু, উপগুহন অতিশয় স্থূল কর্ম, তদপেক্ষা চুম্বন কুটিল কর্ম। তদপেক্ষা নখচ্ছেদ্য, তদপেক্ষা দশনচ্ছেদ্য অতি কুটিল। তদপেক্ষা প্রহণন; কারণ, তাহাতে হস্তলাঘব আবশ্যক। তদ্দ্বারা মন্দকর্মের পরিহার করিয়া রাগদীপন করা যায়। তদপেক্ষাও সীৎকৃত; কারণ, তাহার বারংবার উপদেশ করিলেও অতিকষ্টে গ্রহণ করা যায়।।৩৬।।

এইরূপে দৈশিক স্বভাবানুসারে পরস্পর উপচার প্রযুক্ত হইলে, কদাচিৎ কলহও হইতে পারে। তখন প্রীতিস্থিরতারক্ষার জন্য চেষ্টিতবিশেষের কীর্তন করা আবশ্যক। সেই চেষ্টিত দ্বিবিধ; নির্জন-সেবা ও প্রকাশ-সেবাস্থলে—নির্জন-চেষ্টিত ও প্রকাশ-চেষ্টিত। তাহার মধ্যে প্রথমটিকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন–
আঙ্গিক, বাচিক বা অভিনয়-চেষ্টিত দ্বারা বীর্যবান হইয়াও নায়ক যদি পরে ক্ষত করে, তবে নায়িকা তাহা না সহিয়া সেই ক্ষতের দ্বিগুণ ক্ষত প্রয়োগ করিবে।।’৩৭।।

কাহার কি দ্বিগুণ, তাহা বলিতেছেন—
বিন্দুর প্রতিকারার্থ বিন্দুমালা, তাহার জন্য অভ্রখণ্ডক, অভ্রখণ্ডকের প্রতিকারে বরাহচর্বিতক ইত্যাদি প্রকারে যেন ক্রোধে আবিষ্ট হইয়াই প্রদর্শনার্থ কলহান্তর করিতে প্রবৃত্ত হয়।।’৩৮।।

তাহার পর একহস্তে কেশপাশ ধারণ করিয়া, অপর হস্তে চিবুকদেশ ধরিয়া, মুখখানি উঁচু করিয়া ধরিয়া অধরপানব্যাপারে চুম্বন করিবে, দৃঢ় আলিঙ্গন করিবে এবং সেই সেই স্থানে ছেদ্যপ্রয়োগ করিবে। অথবা নায়িকা যে যে স্থানে দষ্ট হইয়াছে, সেই সেই স্থানেই ছেদ্যপ্রয়োগ করিবে; প্রয়োগকালে যেন মদিরামত্তের ন্যায় অতি প্রমত্তভাবেই প্রয়োগ করে।।’৩৯।।

কান্তের বক্ষঃস্থলী একখানি বাহুপাশ দ্বারা আবেষ্টিত করিয়া কেশপাশ ধরিয়া মুখ উচ্চ করিয়া দ্বিতীয় হস্ত দ্বারা চিবুক ধরিয়া, কন্ঠপ্রদেশে মণিমালার প্রয়োগ করিবে। তদ্ভিন্ন আরও যাহা কিছু প্রযোজ্য বলিয়া লক্ষিত হইয়াছে, তাহাও প্রযোজ্য।।’৪০।।

প্রকাশে চেষ্টিত প্রকার বলিতেছেন—
নায়িকা রাত্রে যে চিহ্ন করিয়া দিয়াছে, তাহা এই জনসম্বাধমধ্যে দিনের বেলায় কি করিয়া প্রচ্ছাদিত করি—এই প্রকারের ভাব-আকার গ্রহণ করাইবে। দুষ্টের পক্ষে এইরূপ নিগ্রহই উপযুক্ত—এইভাব গ্রহণ করাইয়া স্বয়ঙ্কৃত চিহ্ন দেখিয়া ও তাহাই উদ্দেশ্য করিয়া অন্যের অলক্ষিতভাবে নায়িকাও উপহাস করিবে।।’৪১।।

সে নায়িকাও তৎকৃত চিহ্ন দেখাইবে।
ব্যর্থচুম্বন করিবার জন্য মুখ সঙ্কুচিত করিয়া, ভ্রূনয়ন-বিকারদ্বারা স্বগাত্রস্থ চিহ্ন সকল দেখাইবে এবং অত্যন্ত অসূয়াপরবশ হইয়াছে—যেন বলিতেছে, ইহার ফল পাইবে—এইভাবের ভাবে দেখাইয়া নায়ককে তর্জিত করিবে।।’৪২।।
অথবা, যে না জানে, সে এমন কাজ করিতে যায় কেন, যেন কথা দ্বারা নায়কের অনভিজ্ঞতা খ্যাপন করিয়া তর্জন করিবে।।৪২।।

পরস্পরের আনুকূল্যে পরস্পর এইরূপ লজ্জামান হইলে, শতবর্ষেও তাহাদিগের প্রীতির কিছুমাত্র ক্ষতি হইতে পারে না।।’৪৩।।
যাহারা এই আনুকূল্য কামনা করে, তাহাদিগের উভয়েরই বিদগ্ধতা-শিক্ষার জন্য কিছু-না-কিছু সময়ের অপব্যয় করা আবশ্যক। এই শাস্ত্র পাঠ করিয়া, সেই বিদগ্ধতার উপচয় করিতে পারিলে ও উপযুক্তকালে সেই-বিদগ্ধতাসহকারে নায়ক বা নায়িকা পরস্পরকৃত অপরাধের পরিশোধার্থ ঈদৃশ প্রতিকারোপায়ের প্রয়োগ করিলে, তাহাদিগের প্রীতিবৃদ্ধি ভিন্ন কোনরূপেই প্রীতিভেদ হইতে পারে না; সুখে জীবন অতিবাহিত হইতে পারে।। ৪৩।।

 

ইতি শ্রীমদ্‌-বাৎস্যায়নীয়কামসূত্রে সাম্প্রয়োগিকনামক ষষ্ঠ-অধিকরণে দশনচ্ছেদ্যবিধি ও দৈশিক-উপচার-নির্ণয়-নামে পঞ্চম অধ্যায় সমাপ্ত।।৫।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2