৪.৬ অর্থানর্থানুবন্ধসংশয়বিচারাঃ ও বেশ্যাবিশেষাঃ (লাভ ও ক্ষতি)

চতুর্থ ভাগ – ষষ্ঠ অধ্যায়

অপরিগ্রহা বেশ্যা, অর্থোপার্জন করিতে থাকিলে, তাহার সহিত অনর্থ, অনুবদ্ধ ও সংশয়ও উপস্থিত হইয়া থাকে।।’১।।

বুদ্ধিদৌর্বল্যহেতু, অতিরিক্ত অনুরাগবশত, অভিমানপ্রযুক্ত, অতিরিক্ত দম্ভের জন্য, অত্যন্ত সরলতার জন্য, অতিশয় বিশ্বাসবশত, অতিরিক্ত ক্রোধের জন্য, অনবধানতার জন্য, অবিমৃষ্যকারিতার জন্য ও দৈবযোগবশত সেই অনর্থ, অনুবন্ধ ও সংশয় আসিয়া উপস্থিত হয়।।’২।।

সেইসকল কারণের উপস্থিতিতে এইসকল ফললাভ করিতে হয়;–যে ধন সঞ্চয় করা গিয়াছে, তাহার ব্যয় ও কৃতব্যয়ের নিষ্ফলতা, প্রভাবহানি, আগমিষ্যমাণ অর্থের নিবৃত্তি প্রাপ্তধনের নিষ্ক্রমণ, নিষ্ঠুরতাপ্রাপ্তি, গম্যতা (সাধারণ্যে পরচয়), শরীরের বিনাশ, কেশচ্ছেদন, বন্ধ ও তাড়ন ও কর্ণনাসাচ্ছেদাদি অঙ্গবৈকল্য, সুতরাং সেইসকল কারণের প্রথমতই পরিহারের ইচ্ছা করিবে ও তাহাতে যদি প্রচুর অর্থলাভের আশা থাকে, তবে তাহার পরিত্যাগ করিবে, উপেক্ষা করিবে।।’৩।।

এইক্ষণ নিরনুবন্ধ অর্থের বিচার করিতেছেন—
অর্থ, ধর্ম ও কাম—এই হল অর্থত্রিবর্গ। অনর্থ, অধর্ম ও দ্বেষ, এই হল অনর্থত্রিবর্গ। তাহার অনুষ্ঠান দ্বারা অর্জন করিতে হইলেই অন্য একটির নিষ্পত্তি হয়, সেই নিষ্পদ্যমান অন্যতমকে অনুবন্ধ বলা যায়।
ফলপ্রাপ্তি সন্দিগ্ধ হইলে, হইবে কি না, এইরূপ যে সন্দেহ তাহা শুদ্ধ।
ফলপ্রাপ্তি বিষয়ে সন্দেহ না থাকিলেও ধর্ম হইবে কি অধর্ম হইবে ইত্যাদি সন্দেহ সঙ্কীর্ণ।
একটি ক্রিয়মান হইলে, যে কার্যদ্বয়ের উৎপত্তি হয়, তাহাকে উভয়তোযোগ বলা যায়।
আর যে কোনও একটি কার্য করিলে, যদি সকলগুলিই উৎপত্তি হয়, তবে তাহাকে সমন্ততোযোগ বলা যায়।
এসকলের উদাহরণ দিয়া বুঝাইবার চেষ্টা করা যাইতেছে।।’৪।।

ত্রিবর্গ দ্বিবিধ—পূর্বে যেরূপ বিচার করিয়া নির্ণয় করা গিয়াছে, সেইরূপ অর্থত্রিবর্গ ও অনর্থত্রিবর্গ তাহারই বিপরীত।।’৫।।

যে উত্তম নায়কের অভিগমন করিলে, প্রত্যক্ষত অর্থ লাভ হয়, লোকের নিকট উপাদেয় হওয়া যায়, গৌরব বৃদ্ধি হয়, তৎকালীন ব্যক্তির আগম হয় ও গম্যের প্রার্থনীয় হওয়া যায়, সেই অর্থই অর্থানুবদ্ধ বলিয়া কথিত হইতে পারে।।’৬।।

কেবল তৎকালীন লাভের জন্য যে, যে কোনও গম্যের অভিগমন করা যায়, সে অর্থ নিরনুবন্ধ।।’৭।।

যদি কোনও সক্ত নিঃসার অন্য ধন অপহরণ করিয়া আনিয়া দেয়, তবে সেই অর্থের গ্রহণ করিলে, প্রভাবহানি ও পূর্বসঞ্চিত অর্থের নিষ্ক্রমণ করাইয়া থাকে। অথবা লোকবিদ্বিষ্ট নীচজাতির অভিগমন প্রভাবহানিকর বলিয়া সে অর্থ অনর্থানুবন্ধ।।’৮।।

নিজের ব্যয়ে শূর বা প্রভাবশালী মহামাত্রের অথবা লুব্ধের নিকট অভিগমন নিষ্ফল হইলেও ব্যসনপ্রতীকারের জন্য ও মহান্‌ অর্থঘ্ন নিমিত্তের প্রকাশনকর বা প্রভাববৃদ্ধিকর বলিয়া সে অনর্থ অর্থানুবদ্ধ।।’৯।।

সেইরূপ নিজব্যয়ে কদর্য্য, সুভগাভিমানী, কৃতত্ন বা ছলে সদ্ধানপর ব্যক্তির আরাধন অন্তে নিষ্ফল বলিয়া সে অনর্থ নিরনুবন্ধ।।’১০।।

সেইরূপ নিজব্যয়ে সেইসকল রাজবল্লভ বা অধিকক্রূর প্রভাবশালী ব্যক্তির আরাধান অন্তে নিষ্ফল বলিয়া নিষ্কাসন দোষকর; সুতরাং সে অনর্থ যে অনর্থানুবন্ধ, তাহা বলাই বাহুল্য।।’১১।।

এইরূপে ধর্ম্ম ও কামের অনুবন্ধযোগ করিবে।।’১২।।

বিরুদ্ধ ত্যাগ করিয়া পরস্পরের সহিত সঙ্কীর্ণ করিবে। এইরূপে চতুর্বিংশতি প্রকার সঙ্কীর্ণানুবন্ধ হইবে।।’১৩।।

শুদ্ধ সংশয়ের বিষয় বলা যাইতেছে—
পরিতোষিত হইলেও দিবে কিনা, এইরূপ অর্থসংশয়। অর্থশোধন যাইতেছে না, সুতরাং ইহার গমন বিরাগকর হইবে কিনা, এরূপ সন্দেহকে বিদ্বেষসংশয় বলা যাইতে পারে।।’১৪।।

এইক্ষণ সঙ্কীর্ণ সংশয়ের নির্ণয় করা যাইতেছে।।’১৫।।
পূর্বে যে বলা হইয়াছিল,–এটি হইবে, কি এটি হইবে, সেখানে এইরূপ সংশয় হয়; সেই খানেই সঙ্কীর্ণ সংশয় ব্যাখ্যাত। এখন তাহার উদাহরণ দ্বারা নির্ণয় করা যাইতেছে।।১৫।।

কোনও একটি আগন্তুক আসিয়াছে, কিন্তু সে অজ্ঞাতকুলশীল, কোনও প্রভবিষ্ণু বল্লভের আশ্রিত বা নিজেই প্রভাবশালী ব্যক্তি সমুপস্থিত হইয়াছে, এখন তাহার অভিগমন বা আরাধন অর্থকর, কি অনর্থকর, এইরূপ সংশয়। শ্রোত্রিয়, ব্রহ্মচারী, দীক্ষিত, ব্রতী, বা সন্ন্যাসী আমাকে দেখিয়া কামাতুর হইয়াছে, বা মিত্রের কথানুসারে মুমূর্ষুর অনুকূলতাবিধানার্থ অভিগমন, ধর্মের জন্য, কি অধর্মক্‌ এইরূপ সংশয়। এ ব্যক্তি গুণবান্‌ কিনা, তাহা নিজে না দেখিয়া বা নির্ণয় না করিয়া, কেবল অনিশ্চিত লোকপ্রবাদের উপর নির্ভর করিয়া, গুণবান্‌ বলিয়া ধরিয়া লইলে অভিগমন করিলে কামলাভ করা যাইবে, বা দ্বেষ উৎপাদন করা হইবে কি না হইবে?—এইরূপ সংশয়।
ইহাও আবার সংকীর্ণ হইতে পারে। অতএব পরস্পরকে পরস্পরের সহিত সঙ্কীর্ণ করিবে।।’১৬।।
ইহা বিরুদ্ধসঙ্কীর্ণত্রয় কথিত হইল।।১৬।।

ইতি সঙ্কীর্ণসংশয়।

যে স্থলে পরের অভিগমনে অর্থ ও স্পর্ধ্যমান অনুরক্ত সক্তের নিকটে অর্থ পাওয়া যায়, সেখানে সেটি উভয়তো অর্থ। যে স্থলে নিজ ব্যয়ে নিষ্ফল অভিগমন ও অনুরক্ত ব্যক্তিকে কোনও ক্রমে ক্রুদ্ধ করিয়া তাহার নিকট হইতে ধন গ্রহণ করা যায়, সেইটি উভয়তো অনর্থ। যে অভিগমনে অর্থ হইবে কিনা, এইরূপ আশঙ্কা এবং সক্ত ব্যক্তিও স্পর্ধ্যমান হইয়া ধন দিবে কিনা, সে সন্দেহ স্থলে সেটি উভয়তো অর্থসংশয়। যে স্থলে ব্যয় করিয়া অভিগমন করিলে পূর্ব নায়ক ক্রোধে বিরুদ্ধ হইয়া অপকার করিবে কিনা, সন্দেহ এবং সক্ত ব্যক্তিও কোনক্রমে ক্রুদ্ধ হইয়া পূর্বদত্ত ধন প্রত্যাদান করিবে কিনা সন্দেহ; সে স্থলে সেটি উভয়তো অনর্থসংশয়। ঔদ্দালাকি এইরূপ উভয়তোযোগ সকল প্রদর্শন করিয়া থাকেন।।’১৭।।

বাভ্রব্যের মতাবলম্বীরা বলিয়া থাকেন,–যে স্থলে অন্যের অভিগমনে অর্থ ও অভিগমন না করিলেও সক্তের নিকট অর্থলাভ করা যায়, সে স্থলে সে অর্থ উভয়তো অর্থ। যে অভিগমনে নিষ্ফল ব্যয় ও অনভিগমনে প্রতীকারের অযোগ্য অনর্থ উপস্থিত হয়, সেস্থলে সেটি উভয়তো অনর্থ। যে অভিগমনে ব্যয় নাই, অথচ দিবে কিনা, এইরূপ সংশয় ও অনভিগমনে সক্ত ব্যক্তি দিবে কিনা সন্দেহ, সেস্থানে উভয়তো অর্থ সংশয়। যে অভিগমনে ব্যয় আছে; কিন্তু পূর্ব্ব নায়ক প্রভাববান্‌ বিরুদ্ধ হইবে কিনা সন্দেহ এবং অভিগমন না করিলে এ ব্যক্তি হয়ত ক্রোধে অপকার করিতে পারে, নাও করিতে পারে, এইরূপ সংশয়, সেটি উভয়তো অনর্থ সংশয়। এইরূপ কথিত হয়।।’১৮।।

ইহাদিগের পরস্পর ব্যতিকরে (সম্মিশ্রণে) একতো অর্থ, অন্যতো অনর্থ; একতো অর্থ ও অন্যতো অনর্থসংশয়; অন্যতো অর্থ, এবং অন্যতো অনর্থ সংশয়,–এইরূপে ছয় প্রকার সঙ্কীর্ণভাব হইয়া থাকে।।’১৯।।

সেই সকল শুদ্ধ ও সংকীর্ণ মধ্যে পূর্বোক্ত সহায়ের সহিত পরামর্শ করিয়া যে স্থলে প্রচুর অর্থ, অর্থ সংশয় বা গুরুতর অনর্থ প্রশম হইবে, সেই স্থলেই প্রবর্তিত হইবে।।’২০।।

এইরূপে ধর্ম ও কামেরও যুক্তি দিয়ে উদাহরণ দিবে। পরস্পর সংকীর্ণ করিবে ও ব্যতিষক্ত (মিলিত) করিয়া প্রকরণনির্ণয়ও করিবে। ইহা উভয়তযোগ।।’২১।।
সমুদায়ে ষন্নবতি (৯৬) প্রকার হইবে।।২১।।

শুদ্ধ, সংকীর্ণ ও ব্যতিষক্ত কথিত হইল। এইক্ষণ সমন্ততোযোগ বলা যাইতেছে—
বিটগন মিলিত হইয়া একটি বেশ্যাকে পরিগৃহীত করিবে;–ইহাকে গোষ্ঠীপরিগ্রহ বলে। সেই বেশ্যা তাহাদিগের মধ্যে এক, দুই বা বহুর সহিত সংসর্গ করিয়া, প্রত্যেককে স্পর্দ্ধিত করিবে ও প্রত্যেককের নিকট হইতে অর্থ লাভ করিতে চেষ্টা করিবে। মাতা দ্বারা বলাইবে, সুবসন্তাদি সময়ে বা বিশেষ কোন যোগের সময় যে আমার এই বা ঐ বিষয় সম্পাদন করিবে, আমার দুহিতা আজ তাহার নিকট গমন করিবে। তাহাদিগের মধ্যে অভিগমের সংঘর্ষ উপস্থিত হইলে লাভালাভ বিবেচনা করিবে।–এক প্রকারে অর্থ, কি সর্বপ্রকারের অর্থ, এক প্রকারের অনর্থ, কি সর্বপ্রকারের অনর্থ; অর্থরূপে অর্থ, কি সর্বরূপে অর্থ? অর্থরূপে অনর্থ কি সর্বরূপে অনর্থ উপস্থিত। যেটি বেশী দেখিবে, হয় সেটি গ্রহণ করিবে, না হয় পরিত্যাগ করিবে।।’২২।।

ইতি সমন্ততোযোগ।

পূর্বের ন্যায় অর্থসংশয় ও অনর্থসংশয়েরও যোজনা করিবে। সেইরূপ ধর্ম ও কামের সংকীর্ণভাবও ঘটাইবে।।’২৩।।

ইতি অর্থানর্থানুবন্ধসংশয়বিচারনামক প্রকরণ।

বেশ্যাবিশেষ প্রকরণ।

কুম্ভদাসী, পরিচারিকা, কুলটা, স্বৈরিণী, নটি, শিল্পকারিকা, প্রকাশবিনষ্টা, রূপজীবা এবং গনিকা—এই কয়টি বেশ্যা বিশেষ।।’২৪।।

কুম্ভদাসী—সামান্যকর্মচারী। পরিচারিকা—প্রভুর পরিচর্য্যাকারিণী। কুলটা—পতিভয়ে গৃহান্তরে যাইয়া যে প্রচ্ছন্নভাবে অন্যের সহিত সম্প্রযুক্ত হয়। স্বৈরিণী—যে পতিকে তিরস্কার স্বগৃহে বা অন্যগৃহে যাইয়া অন্য ব্যক্তির অভিগমন করে। নটি—রঙ্গযোষিত। শিল্পকারিকা—রজক, তন্তুবায়ভার্য্যা ইত্যাদি। প্রকাশবিনষ্টা—পতি মৃত বা জীবিত থাকেতেই সংগ্রহণধর্ম গৃহীত হইয়া কামাচার প্রবৃত্তিতে চলিয়া থাকে। এই ছয়টি রূপজীবার মধ্যেই অন্তর্ভুক্ত। তদ্ভিন্ন কুম্ভদাসী ও গনিকা, এই দুই প্রকারই বেশ্যা জানিবে।।’২৪।।

সকল বেশ্যাই অনুরূপ গম্য নায়ক, অনুরূপ সহায়, তাহার উপরঞ্জন, অর্থাগমোপায়, নিষ্কাসন ও পুনঃসন্ধান, লাভবিশেষানুবন্ধ এবং অর্থানর্থানুবন্ধ, সংশয়বিচারও অনুরূপ আছে।।’২৫।।

ইতি বৈশিক অধিকরণ।।

এ বিষয়ে দুইটি শ্লোক আছে—
যে প্রকারে রতি প্রয়োজনের অনুভব করিয়া থাকে এবং যে প্রকারে যে স্ত্রী প্রয়োজন বোধ করে; এই শাস্ত্র অর্থ প্রধান বলিয়া সেই পুরুষের সহিত সেই স্ত্রীর যোগই কর্তব্য। অনেক স্ত্রী আছে, যাহারা কেবল অনুরাগ ভালবাসে এবং আরোও অনেক স্ত্রী আছে যাহারা কেবল অর্থই ভালবাসে। তাহাদিগের মধ্যে যাহারা রাগ ভালবাসে, তাহাদিগের পক্ষে অর্থপ্রাপ্তিকর বেশ্যাযোগ বৈশিক অধিকরণে বর্ণিত হইল। সেই অনুসারে অর্থযোগ সাধিত করিবে।।’২৬।।

ইতি শ্রীমদ্‌বাৎস্যায়নীয় কামসূত্রে বৈশিকনামক চতুর্থ অধিকারণে অর্থানর্থানুবন্ধসংশয়বিচার ও বেশ্যাবিশেষনামক ষষ্ঠ অধ্যায় সমাপ্ত।।৬।।

চতুর্থ বৈশিক অধিকরণ সমাপ্ত।।৪।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2