৬.০৩ চুম্বন-বিকল্প

ষষ্ঠ ভাগ – তৃতীয় অধ্যায়

 পূর্বোক্তপ্রকারে আলিঙ্গন করিয়া চুম্বনাদির প্রয়োগ করিবে। তাহার মধ্যে প্রথমেই চুম্বন, কি নখচ্ছেদ্য, কিংবা দশনচ্ছেদ্য; অথবা পরেই চুম্বন প্রযোজ্য? এইরূপ সন্দেহ হইতে পারে। সেই সন্দেহনিরাকরণার্থ বলিতেছেন যে, উহার মধ্যে অগ্রপশ্চাৎকর্তব্যতা নাই।

চুম্বন ও নখ-দশনচ্ছেদ্যের অগ্রপশ্চাৎকর্তব্যতা কিছুই নাই; কারণ, তাহা অনুরাগবশেই প্রযোজ্য হইয়া থাকে। তবে যন্ত্রযোগের পূর্বেই এগুলির প্রধানতঃ প্রয়োগ করা আবশ্যক। আর প্রহণন ও সীৎকৃতের প্রয়োগ সম্প্রয়োগকালে কর্তব্য।।’১।।
রাগাবিষ্ট ব্যক্তি ক্রমের অপেক্ষা করে না; সুতরাং যন্ত্রযোগের পূর্বেই আলিঙ্গন ও চুম্বনাদির প্রধানতা; আর যন্ত্রযোগে ইহার প্রধানতা নাই, কিন্তু প্রহণন ও সীৎকৃতের প্রাধান্য আছে। তাহার মধ্যে আবার যন্ত্রযোগভিন্নকালে প্রহণন ও সীৎকারেরও বিশেষ প্রাধান্য নাই। অন্যসময়ে নায়ক ও নায়িকা অত্যন্ত প্রবৃদ্ধরাগ হয় বলিয়া তখন ঘাতসহন করিতে সমর্থ হয়। প্রহণনের যদি স্বীকার করা হয়, তবে সীৎকৃত তাহার জন্য বলিয়া, তৎকালে সীৎকারপ্রাধাণ্য ও অন্যকালে সাধারণকর্তব্যমধ্যে পরিগণিত।।১।।

বাৎস্যায়ন বলেন—অনুরাগের অপেক্ষায় যখন এগুলি প্রযোজ্য, তখন ইহার কাল-নির্দেশ যুক্তিসঙ্গত নহে; সুতরাং আবশ্যকানুসারে সমস্তই সমস্ত সময়েই প্রযোজ্য হইতে পারে।।’২।।

সেগুলি রতব্যাপারের আরম্ভকালে অত্যন্ত পরিব্যক্ত থাকে না; সুতরাং অনুরক্ত নায়িকার সেগুলি বিকল্পে প্রযোজ্য; কারণ, রাগ প্রথমে মন্দভাবাপন্ন থাকে। তাহার পর, রাগের বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অত্যন্তত্বরাসহকারে বিশেষ নিপুণতা অবলম্বন করিয়া সমস্তগুলি একসঙ্গে প্রয়োগ করা উচিত; কারণ, তদ্বারা রাগের তীব্রবেগতা সম্পাদিত হইবে।।’৩।।

এইক্ষণে চুম্বন কয়প্রকার ও কোন কোন স্থানে প্রযোজ্য, তাহা নির্ণয় করিতেছেন–
ললাট, অলক, কপোল, নয়ন, বক্ষঃ, স্তন, ওষ্ঠ এবং ওষ্ঠান্তর্মুখে চুম্বন কর্তব্য। উরুসন্ধি, বাহুমূল ও নাভিমূলেও চুম্বন করা লাটদিগের মত আছে।
অনুরাগবশে তত্তদেশপ্রবৃত্ত যে যে স্থান বিখ্যাত আছে, সেই সেই স্থানে অধিকার করিয়াই চুম্বন কর্তব্য। তাহা সর্বজনপ্রযোজ্য নহে।–বাৎস্যায়ন এই কথাই বলেন।’৪।।
নাভিমূল—বরাঙ্গ (সম্বাধযন্ত্র ও সাধন)। লাটদিগের মতে চুম্বনের স্থান একাদশ। তত্তদেশের প্রবৃত্তি অনুসারে যথায় যে যে স্থানে চুম্বিত হয়, তাহাই চুম্বন করা বিধেয়। যেমন লাটগন ঊরুসন্ধি-প্রভৃতি স্থান চুম্বন করে; কিন্তু তাহা সর্বজনসম্মত নহে; কারণ, তাহা সকলেই চুম্বন করিতে সমর্থ হয় না। শিষ্টগন সেস্থানে অশুচি বলিয়া চুম্বন করিতে পারেন না। (এই কথাটি অতীব শ্রদ্ধেয় বলিয়া বিবেচনা করা যায় না; কারণ, রাগান্ধ শিষ্টেরাও সম্বাধ-চুম্বনে মত্ত হইয়া থাকেন।–ইহা বহুশঃ দেখিতে-শুনিতে পাওয়া যায়।) তাঁহাদিগের পক্ষে ঐ অষ্টবিধ স্থানই বিজ্ঞেয়।।৪।।

মুকুলীকৃত বক্ত্রের (মুখের) সংযোজনকে চুম্বন বলিয়া থাকে; কিন্তু তাহার স্থানবিশেষে যে গ্রহণকর্ম, তাহার ভেদেই চুম্বনের ভেদ হয়। তন্মধ্যে চুম্বনের স্থানে মুখেরই প্রাধান্য বলিয়া, সেই স্থানেরই চুম্বন বলা যাইতেছে। তাহার মধ্যেও আবার উত্তর, অধর, সম্পুটক-ভেদে চুম্বন ত্রিবিধ। তথায় কর্মের বাহুল্যহেতু প্রথমে অধরকে অবলম্বন করিয়া বলিতেছেন–
অপ্রাপ্তসঙ্গমা অজাতবিশ্রম্ভা কন্যার চুম্বন তিনপ্রকার—নিমিতক, স্ফুরিতক এবং ঘট্টিতক।।’৫।।
কন্যাই নায়িকা এবং এই চুম্বনের প্রয়োক্ত্রী।।৫।।

বলাৎকারপূর্বক চুম্বনে নিযুক্ত হইয়া মুখে মুখ স্থাপিত করে; কিন্তু চুম্বন করিতে চেষ্টা করে না। ইহাকে নিমিতক বলা যায়। নিমিতক, অর্থাৎ পরিমিত চুম্বন।।’৬।।

নায়িকার মুখে নায়ক নিজের অধর প্রবেশিত করিলে, অল্পমাত্রার লজ্জা ভাগ শিথিল করিয়া অনুগ্রহণ করতে ইচ্ছা করে; কিন্তু নিজের ওষ্ঠ ছাড়াইয়া লইবার চেষ্টা করে এবং নায়কের অধরও নিজ অধর-স্থানে রাখিতে দেয় না। আবার যদি নায়ক নিজেই নিজ অধর বাহির করিয়া লইবার চেষ্টা করে, তখন আবার নিজে অধরোষ্ঠ দিয়া চাপিয়া রাখিবার চেষ্টা করে। ইহাকে স্ফুরিতক-চুম্বন কহে।।’৭।।

আর করদ্বারা নায়কের নয়ন আচ্ছাদিত করিয়া নিজেও বিনিমীলিতনয়ন হইয়া নায়কের অধরপ্রান্ত অল্পভাবে ধরিয়া জিহ্বাগ্রহদ্বারা চারিদিকে ঘুরাইয়া দেখে। ইহাকে ঘট্টিতক কহে।।’৮।।

অপর পণ্ডিতগণ বলেন, চুম্বন চারি প্রকার—সম, বক্র, উদ্‌ভ্রান্ত এবং অবপীড়িতক।।’৯।।
সমান সমান মুখ রাখিয়া যে অধরোষ্ঠ গ্রহণ, তাহাকে সম, মুখ ঘুরাইয়া অধরোষ্ঠ বর্তুলাকার করিয়া যে গ্রহণ, তাহাকে তির্যক বা বক্র এবং চিবুক ও মস্তকে ধরিয়া মুখ ঘুরাইয়া যে অধরোষ্ঠগ্রহণ, তাহাকে উদভ্রান্ত, আর সেই অবস্থায় যদি অত্যন্ত অবপীড়িত করিয়া চুম্বন করা যায়, তবে তাহাকে অবপীড়িতক বলে। তাহার মধ্যে উভয়েই যদি উভয়কে অবপীড়িত করে, তবে তাহাকে শুদ্ধপীড়িত ও জিহ্বাগ্রসহ যদি পীড়িত করা যায়, তবে তাহাকে চুম্বন ও অধরপান নামে ব্যবহৃত করা যায়।।৯।।

পঞ্চমগ্রহণবিশেষ বলা যাইতেছে–
অঙ্গুলিসম্পুটকদ্বারা অধরোষ্ঠকে পিণ্ডীকৃত করিয়া, না কামড়াইয়া ওষ্ঠপুটদ্বারা অবপীড়িত করিবে। ইহাকে পঞ্চম অবপীড়িতক বলা যায়। সম্প্রয়োগে ইহা পঞ্চম করণ।।’১০।।
অঙ্গুষ্ঠ ও তর্জনী সম্পুটদ্বারা পিণ্ডিকৃত করিয়া। এখানে পীড়ন থাকিলেও বহির্দেশে পিণ্ডিত করিয়া আকর্ষণ করা বিশেষ ব্যাপার। পঞ্চকে এটির নাম ‘আকৃষ্টচুম্বন’।।১০।।

এইরূপ কর্মভেদে অষ্টবিধ চুম্বন কথিত হইল। তন্মধ্যে তিনটি কন্যা-চুম্বন ও পাঁচটি গ্রহণচুম্বন।

কর্মবিশেষ দ্বারা চুম্বনের বিশেষত্ব নানাপ্রকারে দেখাইয়া এখন অবসরপ্রাপ্ত অধরচুম্বনে দ্যুত খেলিতে বলিতেছেন–
এই অধরচুম্বনে দ্যুতখেলা প্রবর্তিত করিবে।।’১১।।

দ্যুতের ফল জয় ও পরাজয় বলিয়ে দ্যুতের লক্ষণ বলিতেছেন–
অভিমত একটি বিষয়কে পণ রাখিয়া জয়ের জন্য এইরূপ স্থির করিবে যে, আমরা উভয়েই চুম্বন করিতে থাকিব, ইহার মধ্যে যে প্রথমতঃ গ্রহণ-বিধি অনুসারে চুম্বনসম্পাদন করিতে পারিবে, সে-ই এটিকে জয় করিয়া লইতে সমর্থ হইবে।।’১২।।
দ্যুত দুই প্রকার; কপটদ্যুত ও অকপটদ্যুত। লৌকিক চুম্বন দ্বারা দুইজনেই পরস্পরের অধর চুম্বন করিলে, সেটি অকপট চুম্বন হইল। সেই অকপট চুম্বনে দ্যুত প্রবর্তিত হইলে, নায়ক প্রথমেই অন্যতম বিধানানুসারে নায়িকার অধর গ্রহণ করিবে। চুম্বন করিতে করিতে অধর গ্রহণ করিতে পারিলেই নায়িকা পরাজিত হইবে। অকপটদ্যুতে নায়িকা অবলা বলিয়া পরাজিত না হইলেই শোভা পাইবে; কিন্তু কপটদ্যুতে নায়িকাকে জয়লাভ করিতে দেওয়া কর্তব্য নহে; কারণ, সেটি তাহা হইলে অননুরূপ হইয়া পড়িবে।।১২।।

তদুভয়ের মধ্যে একজনের জয় ও পরাজয় হইলে, নিশ্চয় কলহ উপস্থিত হইবে, কারণ, দ্যুতমাত্রেই বিবাদের আস্পদ; সুতরাং অনুরাগের উদ্দীপনার্থ কলহযোজন—নায়ক ও নায়িকা কিরূপে পরস্পর কামনা করিয়া প্রণয়কলহ বাধাইয়া দিবে, তাহার প্রকার উভয়কে অবলম্বন করিয়া বলিতেছেন;–
নায়িকা অকপটদ্যুতে পরাজিত হইয়া কৃত্রিম অর্ধরুদিতের সহিত (কাঁদ কাঁদ ভাবে) অধর পীড়াখ্যাপনার্থ কর কল্পিত করিবে, তর্জ্জন করিবে, নায়ককে ঠেলিয়া ফেলিবে, তাহাতেও যদি নায়ক আলিঙ্গন করিয়া মুখে মুখ দিয়ে চুম্বন করিতে যায়, তবে দন্তদ্বারা খণ্ডিত করিবে, অধর কামড়াইয়া দিবে; যদি মুখদ্বারা কামড়াইতে সমর্থ না হয়, তবে অধর ছাড়াইয়া লইবার জন্য কার্য্যে ঘুরাইয়া লইবে এবং ‘তুমি-ত জয় করিতে পার নাই, আমিই অগ্রে জিতিয়াছি দেখিয়া তুমি বলাৎকারে আমারে ঠকাইয়াছ, তুমি বড় খল,’ ইত্যাদি বলিয়া বিবাদ বাধাইয়া দিবে। যখন দেখিবে, নায়কই জয় করিয়াছে বলিয়া অত্যন্ত কথা-কাটাকাটি আরম্ভ করিয়াছে, তখন বলিবে, ‘ভাল, আবার পণ কর; দেখি, কে জয়লাভ করে?’ এই বলিয়া আবার নূতন পণে নূতন করিয়া ক্রীড়া করিবে। বলিবে, পূর্ব পণ হইতে এ পণ কিন্তু নূতন। যদি তাহাতেও নায়িকা পরাজিত হয়, তবে দ্বিগুণভাবে অর্ধরোদনের সঙ্গে সঙ্গে করবিধুননাদি করিবে।।’১৩।।

কপটদ্যুত কী, তাহা বলিতেছেন–
প্রণয়কহলে ব্যাপৃত বা কপট-বিশ্বাস উৎপাদন দ্বারা প্রমাদপ্রাপ্ত (অসাবধান) নায়কের অধর গ্রহণ করিয়া দশন মধ্যে স্থাপিত করবে, বাহির না করিয়াই হাসিবে, চেঁচাইবে, তর্জন করিবে, ভাবভঙ্গির সহিত অঙ্গবিক্ষেপ করিয়া চাপিয়া চাপিয়া ধরিবে, সখীদিগকে ডাকিবে বা বয়স্যগণকে ডাকিবে, নৃত্য করিবে, প্রনর্ত্তিতভ্রুবিশিষ্ট বিচলিত নেত্রে মুখে উপহাস করিয়া সেই সেই কথা বলিবে। চুম্বনদ্যুতকহল এইরূপে সাধিত হইবে।।’১৪।।
নায়িকা নানাপ্রকার বাক্যোপষ্টদ্ভ (গল্পগুজব) পাড়িয়া নায়কের বিশ্বাসোৎপাদন করিবে বা প্রমত্ত করিয়া তুলিবে। তখন নায়ক বিশ্বাস করিয়া প্রমাদবশে যেই অন্যমনস্ক হইবে, আর অমনি সেই অবসরে নায়কের অধর অষ্টপুটদ্বারা গ্রহণ করিয়া এমনভাবে দশন দ্বারা চাপিয়ে ধরিবে, যেন অধর ছাড়াইয়া বাহির না করিতে পারে; কারণ, অপরাধ করিয়াছে। যদি নায়িকা পরে অধরগ্রহণ করে বা ধরিয়া ছাড়িয়া দেয়, তবে যথাসম্ভব পরে আবার ধরিয়া উত্তর দিবার চেষ্টা করিবে। নায়িকা প্রমোদবশে অধর ধারণে স্খলিত হইলেও কপটদ্যুতে তাহারই জয় হইতে দেখা যায়। এইরূপে কপটে জয়লাভ করিয়া হাসিবে। সশব্দে হাস্যে—(খল খল করিয়া) হাসিয়া উঠিবে। অত্যন্ত পরিতোষসহকারে মৃদুহাস্যই বা করিবে। ‘আমি জয় করিয়াছি’ বলিয়া ফুকরাইবে। ধরা পড়িয়াছ, এখন তোমার অধর কামড়াইয়া দিই; এই বলিয়া তর্জন করিবে। হাবভাবসহকারে ‘আড়ামোড়া’ খাইবে; কিন্তু নায়কের গায়ের উপর ঢুলিয়া ঢুলিয়া পড়িবে, নায়ককে ঠেলিয়াই ফেলিবার চেষ্টা করিবে। অন্য সখীকে ডাকিয়া বলিবে, যাও একবার দেখ গিয়া, আমি কি করিয়াছি। পরিতোষসহকারে নৃত্য করিবে। সভ্রুভঙ্গে কটাক্ষপাত করিয়া কুটিলমুখে উপহাস করিবে; কারণ, এই সময়ে কলহের অবসান করিতে হইবে এবং অনুরাগদীপন সেই সেই কথাও বলিবে।–এই-ত গেল একপক্ষের ব্যাপার। এইক্ষণে উভয়পক্ষের কলহপ্রকার বলা যাইতেছে।–

যদি নায়কই পরাজিত হইয়া থাকে বা জয় করিয়াই থাকে, তথাপি সেইরূপ চেষ্টাই করিবে, নতুবা কলহ হইবে না।–দৃঢ়ভাবে অধর পীড়িত করিয়া সীৎকারের সহিত মস্তক কাঁপাইবে। ঠেলিয়া ফেলিলেও ধরিতে ছাড়িবে না। যদি কামড়ায়, তথাপি ছাড়িবে না, কামড়াইবে। ফিরিয়া থাকিলেও আবার ফিরিয়া লইবে। বিবাদ করিতে থাকিলে, বিবাদ করিতে কুন্ঠিত হইবে না। ‘এই অপর পণ, বলিয়া পণ রাখিয়াছে, এখন তাহা দাও’ বলিয়া ধরিবে। জেতা পণ আদায়ের জন্য দ্বিগুণ আয়াস করিবে। যাহাতে দ্বিগুণ পণ আদায় হয়, তাহার চেষ্টা করিবে। যদি—পরাজিত হয়, তথাপি বিলক্ষণভাবে উপহাস করিবে। আমিই জয় করিয়াছি, আমিই জয় করিয়াছি, এই বলিয়া নায়িকা ফুকারিলে, মিথ্যা মিথ্যা বলিয়া ফুকরাইবে। নায়িকা ধরিয়া—‘এইবার এখন কামড়াই’ বলিয়া তর্জন করিতে থাকিলে, ‘এইবার এখন আমি কামড়াই,’ বলিয়া প্রতিতর্জন করিবে। হাবভাবসহকারে গায়ে গড়াইয়া পড়িবে ও ঠেলিয়া ফেলিবার চেষ্টা করিবে। সখীকে ডাকিতে থাকিলে মিত্রগণকে ডাকিতে আরম্ভ করিবে। নায়িকা নাচিতে থাকিলে, নায়কও হাতে তালি দিয়া নাচিতে থাকিবে। উপহাস করিয়া সেই সেই কথা বলিতে থাকিলে, তাহার প্রতিষেধার্থ নায়কও সেই সেই কথা বলিতে থাকিবে। এ সম্বন্ধে কথিত হইয়াছে—যদি নায়িকা কর্তৃক জিত হইয়াই থাকে বা নায়িকাকে পরাজিত করিতে পারিয়া থাকে, তাহা হইলেও চুম্বনদ্যুতকর্ম নায়িকার সম্পূর্ণ চেষ্টার অনুকরণ করিয়া কলহ বাধাইয়া দিবে।।’১৪।।

ইহা দ্বারা নখচ্ছেদ্য, দশনচ্ছেদ্য এবং প্রহণনদ্যুতকলহও ব্যাখ্যাত হইল।।’১৫।।

নায়ক ও নায়িকা চণ্ডবেগ হইলে, এই কলহের প্রয়োগ হইতে পারে। তাহারাই এরূপ বিমর্দ সহিতে সক্ষম, মন্দবেগেরা সহিতে সক্ষম হইবে না।।’১৬।।

ইহার পর উত্তরোষ্ঠবিধি কী, তাহা বলিতেছেন–
নায়িকা চুম্বন করিতে থাকিলে, নায়কও উত্তর গ্রহণ করিবে। ইহাকে উত্তর-চুম্বিত কহে।।’১৭।।

উভয়েই যুগপৎ যাহা করিতে পারিবে, তাহার বিধান করিতে হইলে, উভয়েই উভয়ের ওষ্ঠদ্বয় গ্রহণ করিয়া মুখের মখের মধ্যে লইয়া উভয় ওষ্ঠকেই চুম্বন করিবে। এইরূপ স্ত্রীর পক্ষে সম্পুটক পুরুষের প্রয়োজন। সেইরূপ পুরুষের পক্ষে যদি শ্মশ্রু না জন্মিয়া থাকে, তবে স্ত্রীর প্রয়োজন।।’১৮।।

এইরূপে—ত্রিবিধ ওষ্টচুম্বন বলিয়া, সম্পূটান্তর্গত বলিয়া এখন অন্তর্মুখচুম্বনের বিশেষত্ব বলিতেছেন–
সেই সম্পুটচুম্বনে নায়ক বা নায়িকা জিহ্বা দ্বারা নায়ক ও নায়িকার দশনগুলি মার্জিত করিবে। সেইরূপ জিহ্বা উপরের দিকে প্রসারিত করিয়া তালু ও জিহ্বাকে সংমার্জিত করিবে।।’১৯।।
ইহাকে জিহ্বাযুদ্ধ কহে।

ইহাকে অন্তর্মখচুম্বন, দশনচুম্বন, জিহ্বাচুম্বন এবং তালুচুম্বন কহে। ইহা দ্বারা বলপূর্বক বদনগ্রহণ, রদনগ্রহণ ও দান (বদন-গ্রহণ—মুখচুম্বন, রদন-গ্রহণ—দন্তচুম্বন এবং চুম্বনার্থ মুখ ও দন্ত কিরূপে দিতে হইবে তাহা) ব্যাখ্যাত হইল।।’২০।।
হঠাত বদন দ্বারা বদনের ও রদন দ্বারা রদনের যে পরস্পর-যুদ্ধ—একজন চুম্বন করিতে হঠাত বদন দিবে কিংবা গ্রহণ করিলেই অন্যে গ্রহণ করিবে—এইরূপে উভয়ের গ্রহণ ও দান লইয়া মহাসংগ্রাম হইবে। তাহাতে বদনযুদ্ধ ও রদনযুদ্ধ দুইপ্রকার সাধিত হইবে।।২০।।

স্থানবিশেষসম্বন্ধানুসারে অবশিষ্টাঙ্গুলির সম, পীড়িত, অঞ্চিত ও মৃদুচুম্বন হইবে। ইহাদ্বারা চুম্বনের সমগ্র ভেদ প্রদর্শিত হইল।।’২১।।
ঊরুসন্ধি (কুঁচকি), কক্ষ, ও বক্ষঃস্থলে সমচুম্বন, কপোল, কর্ণমূল ও নাভিমূলে (সম্বাধযন্ত্রে) পীড়িতচুম্বন, ললাট, চিবুক ও কক্ষ পর্যন্ত প্রদেশে অঞ্চিত চুম্বন এবং ললাটে ও নেত্রে মুখচুম্বন।।২১।।

সেইসকল চুম্বন অবস্থাভেদে নামান্তর প্রাপ্ত হয়।–
সুপ্তনায়কের মুখ অবলোকন করিয়া নায়িকা স্বাভিপ্রায়ানুসারে যে চুম্বন করিবে, তাহাকে রাগদীপন কহে।।’২২।।
স্বাভিপ্রায়ানুসারে—অর্থাৎ যাহা হইলে নিজে ধৈর্যাবলম্বন করিতে পারিবে, এরূপভাবে চুম্বন করিবে। এরূপ করিলে নায়িকার অনুরাগ উদ্দীপিত হইবে। এইজন্য এই চুম্বনকে রাগদীপন বলা যায়। ইহাতে চুম্ব্যমান নায়ক প্রতিবোধিত হইয়া উঠিতে। জাগ্রতনায়কের পক্ষেও ইহা প্রযোজ্য হইতে পারে; তবে তদবস্থায় তাহা সাম্প্রয়োগিকই হইবে।।২২।।

গীত ও আলেখ্যাদিতে প্রসন্নচিত্ত নায়কের প্রমাদব্যাঘাতার্থ, নায়িকার সহিত বিবদমান নায়কের বিবাদব্যাঘার্থ, অন্যদিকে অভিমুখ নায়কের অন্যদিকে দৃষ্টি ব্যাঘাতার্থ, নিদ্রা যাইতে ইচ্ছুক নায়কের নিদ্রাব্যাঘাতার্থ যে চুম্বন করা যায়, তাহাকে চলিতক কহে।।’২৩।।

অসময়ে বা অধিকরাত্রে সমাগত নায়ক, শয্যায় সুপ্ত নায়িকার স্বাভিপ্রায়ানুসারে যে চুম্বন করে, তাহাকে প্রাতিরোধিক চুম্বন বলা যায়।।’২৪।।

নায়িকা নায়কের অনুরাগ জানিবার জন্য আগমনকাল জানিতে পারিয়া ছলক্রমে নিদ্রা যাইবে।।’২৫।।
নায়ক আসিয়া যদি প্রাতিবোধিক চুম্বন দেয়, তবেই জানিতে পারিবে—নায়ক অনুরক্ত।।২৫।।

দর্পণে, আলোকযুক্ত কুড্যে (দেওয়ালে), বা জলে পতিত নায়িকার ছায়ামুখে নিজভাবসূচক আকারপ্রদর্শনার্থ চুম্বন করিবে।।’২৬।।

নিজক্রোড়ে বালকের, আলেখ্যের বা মৃচ্ছিলাকাষ্ঠদিময় প্রতিমার মুখচুম্বন ও প্রযোজ্যা নায়িকার সম্মুখে তাহাদিগের আলিঙ্গনকে সংক্রান্তক বলা যায়।।’২৭।।
স্পর্শগোচরাভীত অপ্রাপ্তসম্ভাষণ বেওং অলব্ধসমাগম নায়ক-নায়িকার পক্ষে ইহা প্রয়োজন।।২৭।।

সেইরূপ আকার প্রদর্শনার্থ রাত্রে প্রেক্ষণকস্থলে (যাত্রারঙ্গালয়ে), স্বজনসমাজে (জ্ঞাতিবন্ধগন একত্র মিলিত হইলে) নিজের নিকটে উপবিষ্ট নায়ক বা নায়িকার, কিংবা নিজের নিকটে আগত নায়ক বা নায়িকার হস্তাঙ্গুলি চুম্বন বা নায়িকার নিকটে শায়িত নায়কের পাদাঙ্গুলি চুম্বন কর্তব্য।।’২৮।।
হস্তাঙ্গুলি-চুম্বনের প্রয়োক্তা উভয়েই, পাদাঙ্গুলিচুম্বনের প্রয়োক্ত্রী কেবল নায়িকাই; (ইহা ঠিক নহে, সুবিধা হইলে নায়িক গর্হিতাচরণ দ্বারা নায়কাকে আয়ত্ত করিতে পারে) নায়ক নহে, কারণ, ঐ ব্যাপারটি গর্হিত।।২৮।।

নায়কের সম্বাহনকারিণী নায়িকা তাহার ভাবসূচক আকার জানিবার জন্য যেন নিদ্রাবশে, যেন ইচ্ছা না করিয়াই, নায়কের ঊরুযুগলে মুখ রাখিবে ও ঊরু চুম্বন করিবে, এবং পাদাঙ্গুষ্ঠ চুম্বন করিবে। ইহার নাম আভিযোগিক। ইহার প্রয়োজন অভিযোগ। আমি তোমায় ভালবাসি; কিন্তু তুমি আমায় ভালবাস কিনা জানি না। ভালবাস কী?—যেন এই অভিযোগ, ইহা দ্বারা ব্যক্ত হইয়া থাকে।।’২৯।।

এ বিষয়ে শ্লোক আছে—প্রয়োক্ত্রী সাম্প্রয়োগিক বা অভিযোগিক প্রযুক্ত করিলে, তাহার প্রতিকার করিবে। তাড়িত বা চুম্বিত করিলে তদনুরূপ প্রতিতাড়িত বা প্রতিচুম্বিত করিবে। নায়িকা যে উপায়ে তাড়ন বা চুম্বন করিবে, নায়কও সেই উপায়ে তাড়ন বা চুম্বন করিবে। অন্যথা নায়িকা নায়ককে স্তম্ভের বা পশুর ন্যায় মনে করিয়া বিরক্ত হইবে।।’৩০।।

 

ইতি শ্রীমদ্‌-বাৎস্যায়নীয়কামসূত্রে সাম্প্রয়োগিকনামক ষষ্ঠ-অধিকরণে আলিঙ্গনবিচার নামক তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।।২।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2