১.৪ নাগরকবৃত্তম্‌ (সুনাগরিকের আচরণ)

শাস্ত্রকারই প্রকরণের সম্বন্ধে বলছেন-
'বিদ্যাগ্রহণ করে গার্হস্থ্যাশ্রম প্রাপ্ত হয়ে ব্রাহ্মণ প্রতিগ্রহ, ক্ষত্রিয় বিজয়, বৈশ্য ক্রয় ও শুদ্র নির্ব্বেশ (ভৃতি চাকরী) দ্বারা অধিগত অর্থে বা পিতৃপিতামহগত উপায় ও পূর্বকথিত উপায়, এই উভয়বিধ উপায় দ্বারা অর্জিত অর্থে নাগরকবৃত্তের অনুবর্ত্তন করবে'।।১।।

যেখানে তার বৃত্তি, সেখানেই তার স্থিতি এই কথাটি সাধারণভাবে দেখাচ্ছেন-
'নগরে, পত্তনে (রাজধানীতে), খর্ব্বটে (দুইশত ক্ষুদ্রগ্রাম যে স্থানে অবস্থান করে), অথবা মহৎ সজ্জনাশ্রয় যেখানে, সেখানে অবস্থান করবে। কিংবা যেখানে থাকলে শরীরযাত্রা নির্বাহ হয়'।।২।।

'যে স্থানে গ্রহ করবে, নিকটে জল থাকবে। যে দিকে জল থাকবে, সেস্থানে বৃক্ষবাটিকা থাকা আবশ্যক। গৃহের কর্মানুসারে এক একটি কক্ষ বিভাগ করবে। বাস-গৃহদ্বয় করবে, বা করাবে'।।৩।।

বাইরের বাসগৃহেও অতি সুন্দরদুটি বালিশ ও তার মধ্যে অতি শুভ্র চাদর পাতা শয্যা থাকবে। আর তার নিকটে সেইরূপই কিঞ্চিত ক্ষুদ্রাকার আর একটি শয্যা থাকবে। তার শিরোভাগে তৈলচিত্র যুক্ত কুর্চাসন (ব্রাকেট) স্থাপন কর্তব্য এবং তার পাদদেশে একটি বেদিকা কাষ্ঠময়ী (টেবিল) থাকবে। সেখানে রাত্রের উপভোগযোগ্য অনুলেপন, মাল্য, সিক্‌থকরণ্ডক (মোম দ্বারা বিধৃত পেঁটরা), সৌগন্ধিকপুটিকা (গন্ধের কৌটা, শিশি ইত্যাদি রাখার পেঁটরা), মাতুলুঙ্গত্বক্‌ (দাড়িম্ব বা টেবা বা নারিঙ্গ নেবুর ছাল) এবং পান থাকবে। ভূমি প্রদেশে পতদ্‌গ্রহ (পিক্‌দানী), হস্তিদন্তাবসক্ত বীণা, চিত্র ফলক, বর্ত্তিকাসমুদ্‌গক (চিত্র কর্মোপযোগী তুলিকা রঙ্গ প্রভৃতি), যে কোন পুস্তক, কুরণ্টক (পীটঝাঁটি ফুল) মালা, শয্যার নিকটেই ভূমিতে সমস্তক বৃত্তাস্তরণ (চেয়ার) আকর্ষফলক ও দ্যুতফলক (খেলার ছক), তার বাইরে ক্রীড়াপক্ষীর পঞ্জর সকল (খেলার পাখীর খাঁচা সকল), একটি নির্জন প্রদেশে নৃত্যগীতাদীর স্থান করবে এবং তথায় অন্যান্য স্ত্রীর ক্রীড়ার স্থানও হবে। ভালরূপে আস্তরণ পাতা (চিত্রবিচিত্র বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদিত) সুরভি ছায়াসম্পন্ন প্রেঙ্খাদোলা (দোলা খাইবার দোলা) বৃক্ষ বাটিকার মধ্যেই করতে হবে। সেই গৃহোদ্যান মধ্যেই কুসুমিতলতামন্ডপের নিম্নে চত্ব্বর (চৌতারা) যুক্ত স্থণ্ডিলময়ী—পরিষ্কৃত ভূমিতে পীঠিকা (বেদিকা) একটি করতে হবে। এইরূপে ভবনে আবশ্যকীয় দ্রব্যের বিন্যাস করতে হবে'।।৪।।

'নায়ক প্রাতঃকালে উঠে নিত্যক্রিয়া করবে। পরে দন্তাধাবন পূর্বক কিছু অনুলেপন, ধূপ ও মাল্য গ্রহণ করে, (ওষ্ঠে) অলক্তক দিয়ে, পান খেয়ে, সিক্‌থক দিয়ে, আদর্শে (আয়নায়) মুখ দেখে, মুখবাস ও তাম্বুলপাত্র গ্রহণ করে কার্যানুষ্ঠান করবে'।।৫।।

'প্রত্যহ স্নান, দ্বিতীয়দিনে উৎসাদন-উদ্বর্ত্তন, অর্থাৎ তৈলচন্দনাদি দ্বারা পরিষ্করণ, তৃতীয়দিনে ফেনক অর্থাৎ ফেনকারী স্নেহময় দ্রব্য (সাবান) দ্বারা গাত্রঘর্ষণ, চতুর্থক আয়ুষ্য ঘৌরীকর্ম, পঞ্চমক ও দশমক প্রত্যায়ুষ্য; স্নানাদিপঞ্চক তার সঙ্গে সঙ্গেই থাকবে। সর্বদার জন্য সংবৃত (গুপ্ত) গৃহে ধর্মোপনোদন কর্তব্য। পূর্বাহ্ন ও অপরাহ্ন ভোজন করবে। চারায়ণের মতে পূর্বাহ্নে ও সায়াহ্নে ভোজন কর্তব্য। পূর্বাহ্নে ভোজনান্তর শুকসারিকাকে পড়ান ব্যাপার, লাবক, কুক্কুট ও মেষের যুদ্ধ, আর সেই সেই কলাক্রীড়া এবং পীঠমর্দ্দ বিট বিদুষকাদির সহিত সন্ধিবিগ্রহাদি ও দিবাশয়ন কার্য। নিদ্রা হতে গত্রোত্থান করে কেশপ্রসাধন-পূর্বক বৈকালবেল্য বিহারবেশে গোষ্ঠীতে-–সভাসমিতিতে বিহার। সন্ধ্যাকালে সঙ্গীত, সঙ্গীতের পর বাহিরের বাসগৃহ পুষ্পাদি দ্বারা প্রসাধিত হলে এবং সুরভি ধূপদ্বারা সুবাসিত হলে সহায়ের (সহচরের) সহিত শয্যায় অভিসারিকার প্রতীক্ষা করবে। না আসলে দূতী পাঠাবে। মান করে না আসলে স্বয়ং যাবে। আসলে পরে মনোহর আলাপ ও মনোহর উপচার দ্বারা সহায়কারীগণের সহিত মনতুষ্টি করতে উপক্রম করবে। দুর্দিনে–অর্থাত মেঘাচ্ছন্ন দিনে অভিসারিকারিণীর বৃষ্টিপাত দ্বারা বেশভূষার বিপর্যয় ঘটলে স্বয়ংই আবার সেইরূপ বেশভূষা করে দিবে। অথবা পরিচারক দ্বারা পরিচরণ করাবে। এই অহোরাত্র সাধ্য ব্যাপার'।।৬।।

নৈমিত্তিক বৃত্ত বলছেন–
'যাত্রার ব্যবস্থাপন, গোষ্ঠীতে সমবায়, সকলে মিলে পান ব্যবস্থা, উদ্যানে গমন, সমস্যা ক্রীড়াও প্রবর্তিত করবে। পক্ষে বা মাসে কোন একটি বিজ্ঞাত দিনে সরস্বতীগৃহে নিযুক্তগনের নিত্য সমাজ। আগন্তুক নট-নর্তক-নর্তকীরা তাদের নৃত্যগীতকলা প্রদর্শন করাবে। দ্বিতীয় দিনে তাদের নিকটে নিয়ত পূজা লাভ করবে। তার পর শ্রদ্ধা থাকলে এদের নৃত্যাদি দর্শন করতে পারে বা বিদায় দিতে পারে। কোনরূপ ব্যসন, ব্যাধি বা শোকাদি উপস্থিত হলে বা উৎসব প্রবৃত্ত হলে এদের এককার্যকারিতা থাকা আবশ্যক। যে সকল আগন্তুকের সে স্থলে মিলন হবে, তাদের পূজা ও ব্যসনের সময় উপকারাদি দ্বারা সাহায্য করবে। এই হল গনধর্ম। এই দ্বারা সেই সেই দেবতা বিশেষের উদ্দেশ্যে যে যাত্রা করা হবে, তার ব্যবস্থা করার কথাও ব্যাখ্যাত বা কথিত হল'।।৭।।

গোষ্ঠীসমবায় কি? তা বলছেন–
'বেশ্যার বাড়িতে বা সভায় অথবা অন্যতম নাগরকের বাড়িতে বেশ্যাদের সহিত সমানবিদ্যা, সমানবুদ্ধি, সমস্বভাব, সমধন ও সমবয়স্কগণের অনুরূপ আলাপের সহযোগে যে একাসনে অবস্থান, তার নাম গোষ্ঠী। সেখানে এদের কার্য কাব্যচর্চা বা কোন কলার চর্চা। সেই গোষ্ঠীতে লোকমনহরা কলার নাগরকের পূজা কর্তব্য এবং প্রীতির অনুরূপ তাদের পরিচারিকা দ্বারা সেবা শূশ্রূষাও কার্য'।।৮।।

সমাপন কি? তা বলছেন–
'পরস্পরের বাড়িতে আপানক কার্য'।।৯।।

আপানক বিষয়ে বিধান করছেন–
'তাতে মধু, মৈরেয়, সুরা, আসব এবং বিবিধ লবণ, ফল, হরিত, শাক, তিক্ত, কটু অম্ল ও উপদংশ, বেশ্যাদের পান করাবে এবং পরে পান করবে। ইহা দ্বারা উদ্যানগমন ব্যাখ্যাত হল'।।১০।।

উদ্যানগমন বিষয়ে কিছু বিশেষত্ব আছে, তা বলছেন–
'পূর্বাহ্নেই সুন্দররূপে অলঙ্কৃত হয়ে ঘোটকপৃষ্ঠে আরূঢ় হয়ে বেশ্যাদের সহিত পরিচারকগণকে সঙ্গে লয়ে যাবে। সেখানে দৈনিক যাত্রার উপভোগ করে কুক্কুট যুদ্ধ ও দ্যুত (দাবাখেলা প্রভৃতি) ক্রীড়া ও নটনর্তকের প্রয়োগ প্রত্যক্ষ করে যার যেমন চেষ্টা, সেইরূপ চেষ্টার পূরণ দ্বারা কাল অতিবাহিত করে অপরাহ্নে সেই উদ্যানের চিহ্ন (পুষ্পগুচ্ছ ও মাল্যাদি) গ্রহণ করে সেইরূপেই চলে আসবে। ইহা দ্বারা কুম্ভীরাদিরহিত রচিত জলাশয়ে (দীর্ঘিকাব্যাপী পুষ্করিণী আদিতে) গ্রীষ্মকালে জলক্রীড়াগমন ব্যাখ্যাত হলো'।। ১১।।

সমস্যাক্রীড়া কি? তা বলা যাচ্ছে–
'যক্ষরাত্রি, কৌমুদীজাগর (কোজাগর) ও সুবসম্ভক'।।১২।।

দেশ্যা কি? তা বলা যাচ্ছে–
'সংহার ভঞ্জিকা, অভ্যুষখাদিকা, বিসখাদিকা, নবপত্রিকা, উদকক্ষেড়িকা পাঞ্চালানুযান, একশাল্মলী, কদম্বযুদ্ধ সর্ব্দেশব্যাপী ও প্রদেশমাত্রব্যাপী সেই সেই ক্রীড়া সকল জনসাধারণের উদ্দেশে বিশেষভাবে অনুষ্ঠিত করবে। একেই সম্ভূয় ক্রীড়া কহে'।।১৩।।

নাগরক না হয়েও এ জাতীয় ক্রীড়া করতে পারে–
'ইহা দ্বারা যে একচারী, সে নিজের ধনবল অনুসারে গনিকা ও নায়িকার স্থানে সখী ও নাগরকের সহিত এই রূপ ব্যবহার করতে পারে, ইহা ব্যাখ্যাত হইল।।'১৪।।

লক্ষণ দ্বারা উপনাগরকগণের চরিত কীর্তন করা যাচ্ছে–
'যার কিছু মাত্র বিভব নাই ও পুত্রকলত্রাদিও নাই, শরীর মাত্র সহায়, মল্লিকা, ফেনক ও কষায়মাত্র, পরিচ্ছদধারী, পূজ্য দেশ হতে আগত ও কলায় কুশল, সে ব্যক্তি নাগরক-গোষ্ঠীতে কলার উপদেশ করে বেশ্যাজনোতিচ বৃত্তে আপনাকে সিদ্ধ করবে। ইহাকে পীঠমদ্দ বলে।।'১৫।।

'যে সমস্ত বিভব ভোগ করে (খুইয়ে) বসেছে, গুণবান্‌ এবং দারপরিজনসমম্বিত। বেশ্যাজনোচিত বেশে ও গোষ্ঠীতে (নাগরকগণের) বহুমত প্রকাশ করতে সমর্থ এবং বেশ্যাজনও নাগরকজনকে অবলম্বন করে জীবিকানির্বাহ করতে ইচ্ছুক, তাকে বিট বলা যায়।।'১৬।।

'গীতাদির প্রদেশাভিজ্ঞ, ক্রীড়ানক এবং বিশ্বাসভূমি ব্যক্তিই বিদূষক বা বৈহাসিক নামে অভিহিত হয়।–এগুলি বেশ্যা ও নাগরকগণের সন্ধি ও বিগ্রহকাজে নিযুক্ত মন্ত্রিস্থানীয়।।'১৭।।

'তা দ্বারাই কলাপ্রয়োগে পণ্ডিতা তিক্ষুকী, নাপিতিনী, বন্ধকী ও বৃদ্ধাবেশ্যাও কথিত হল।।'১৮।।

যাত্রাবশত গ্রামবাসীর বৃত্ত (কর্তব্য) কথিত হচ্ছে —
'গ্রামবাসী ব্যক্তি সজাতীয় বিচক্ষণ কৌতুহলপরায়ণ ব্যক্তিগণকে প্রোৎসাহিত করে নাগরক জনের বৃত্ত বর্ণনা করে শ্রদ্ধা জন্মিয়ে তার অনুকরণ করবে। গোষ্ঠীর প্রবৃত্তি করবে। সঙ্গতি থাকলে জনের অনুরঞ্জন করবে। প্রত্যেক কর্মে সাহায্য করে অনুগৃহীত করবে। যথাসম্ভব উপকারও করবে। — এই নাগরকবৃত্ত কথিত হল।।'১৯।।

সেখানে ইহাদের কাব্যসমস্যা ও কলাসমস্যা থাকবে– এই কথা কথিত হয়েছে। তার মধ্যে যা কিছু বিশেষ আছে, তৎসম্বন্ধে কথিত হচ্ছে–
এ বিষয়ে শ্লোক আছে–
'কেবল সংষ্কৃত বা কেবল দেশভাষার সাহায্য লয়ে গোষ্ঠীতে কথা না বললে লোকে বহুমত হবে। যে গোষ্ঠীর উপর লোকের বিদ্বেষ আছে বা যেটি স্বতন্ত্রভাবে প্রবৃত্ত বা যথায় কেবল পরহিংসা পরচর্চাই হয়ে থাকে, বুধব্যক্তি তাদৃশ্য গোষ্টীর অবতারণা করবে না। লোকের চিন্তানুবর্তিণী লোক-চিত্তরঞ্জনকারিণী, ক্রীড়ামাত্রাই যার একটি মুখ্য কাজ, তাদৃশ গোষ্ঠীর সহচর হলে বিদ্বান লোকে–সংসার ক্ষেত্রে সিদ্ধিলাভ করতে সমর্থ হয়।।'২০।।

শ্রীমদ্‌-বাৎস্যায়নীয় কামসূত্রে সাধারণ নামক অধিকরণে
নাগরকবৃত্তনামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত ।। ৪।।

 

Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2