৫.৪ দুতীকর্ম্মাণি (দৌত্য)

পঞ্চম ভাগ – চতুর্থ অধ্যায়

রক্ষিতা প্রভৃতি স্ত্রীগণের উদ্দেশে অভিযোগ প্রয়োগ করা ততদূর সম্ভবপর নহে। এইজন্য দূতীকর্মপ্রকরণের এখন আরম্ভ করা যাইতেছে—

যাহাকে লক্ষ্য করিয়া ইঙ্গিত ও আকার প্রদর্শিত করা হইয়াছে, অথচ তাহার দর্শন লাভ করা বড়ই কঠিন ব্যাপার; কিন্তু সে নায়িকা কোনরূপ আকার প্রদর্শন করে নাই; তাদৃশ নায়িকাকে দূতী দ্বারাই নিজের কাছে আসিতে বাধ্য করাইবে।।’১।।

দূতী তিন প্রকার : নিসৃষ্টার্থা—যে দূতী নায়কের বা নায়িকার অভিপ্র্যয়ানুসারে উদ্ভাবনা শক্তি সাহায্যে আপনা হইতে নানাবিধ কৌশল অবলম্বন করিয়া কার্য্যসিদ্ধি করিতে পারে। পরিমিতার্থা—যে দূতী নায়কের বা নায়িকার কথিত বিষয়ের মাত্র বহন ও তাহারই প্রয়োগ করিতে চতুরতার পোষণ করিয়া থাকে। তৃতীয় কেবলমাত্র পত্রহারিণী। ইহাদিগের সামান্যতঃ যে কর্ম কর্ত্তব্য, তাহাই কীর্তন করা যাইতেছে—

সেই দূতী প্রথমতঃ নায়িকার বিশ্বাস উৎপাদনার্থ শীলবতী হইয়া প্রবেশ করিবে। প্রবেশ করিতে পারিয়া, প্রথমতঃ চিত্রপট ও যাহার প্রদর্শিত করিবে, তাহার সম্বন্ধে যাহা কিছু আখ্যান আছে, তাহারই বর্ণনা করিবে। সেই সঙ্গে সঙ্গে সুভঙ্গকরণ যোগ (ঔপনিষদিক অধিকরণে বক্তব্য) দ্বারা বশীভূত করিবার চেষ্টা করিবে! তাহাতে লোকগণের বৃত্তান্ত খ্যাপন, পুরাণপ্রসঙ্গের অবতারণা ও কবিগনরচিত নায়ক-নায়িকার প্রবৃত্তিপ্রকাশকর কথার আলোচনা করিবে। সেই প্রসঙ্গে নায়িকার রূপ, বিজ্ঞান, দাক্ষিণ্য ও শীলের অনুপ্রশংসার যোজনা করিয়া নায়িকাকে ক্রমশঃ অনুরঞ্জিত করিবে। ক্রমশঃ ক্রমশঃ কথাপ্রসঙ্গে যেন বিস্মিত হইয়াছে, এইভাবে বলিবে—তুমি এইরূপ গুণবতী ও রূপবতী; কিন্তু তোমার পতি এরূপ কেন? এইরূপ কথাদ্বারা ক্রমশঃ তাহার পতি যে তাহার অনুরূপ নয়, সে সম্বন্ধে তাহার একটি পাকা সংস্কার জন্মাইয়া দিবে। কেবল তাহাই নহে—উহার মধ্যে অবসরমতে কোন কোন দিন বলিবে—দেখ সুভগে! তোমার পতি তোমার দাস্য করিবারও যোগ্য নহে। তারপর, সময়মত নায়িকার নিকট তাহার পতির মন্দবেগতা, ঈর্ষালুত্ব, শঠতা, অকৃজ্ঞতা, অসম্ভোগশীলতা, কদর্যতা, চপলতা এবং অন্যান্য যেসকল গুপ্ত দোষ আছে, সেগুলি অতিশায়িত করিয়া প্রকাশ করিতে থাকিবে। যে দোষ দেখাইলে অন্যন্ত উদ্বিগ্না হয় মনে করিবে, সেই দোষ বারংবার শ্রবণ করাইবে ও তাহার দ্বারা অতিরিক্ত উদ্বিগ্ন করিতে চেষ্টা পাইবে। যদি নায়িকা মৃগী হয়, তবে স্বামীর শশতা দোষ নহে। সেইরূপ বড়বা ও হস্তিনীর সম্বন্ধে জানিয়া প্রয়োগ করিবে।’২।।

দূতীদ্বারা নায়িকাকে নিজের নিকট আনাইবে—এই কথা বলা হইয়াছে; কিন্তু এসম্বন্ধে গোণিকাপুত্রের দর্শনে কিছু কিছু বিশেষ কথিত হইয়াছে; সুতরাং তাহার প্রদর্শন করা অতীব সঙ্গত বিবেচনায় এসম্বন্ধে তাঁহার অভিমত ব্যক্ত করিতেছেন—
গোণিকাপুত্র বলেন—যে নায়িকা চরিত্রখণ্ডনার্থ প্রথমতঃ সাহস করিতেছে ও যে নায়িকা সূক্ষ্মভাবা, তাহাদিগের নিকটেই দূতী পাঠাইতে হইবে; কিন্তু তাহাদিগের বিশ্বাস্যতা জানিয়া প্রেরণ করাই ভাল।।’৩।।
ইহা শাস্ত্রকারের স্বীকার্য মত বলিয়াই বোধ হয়; কারণ, এ সম্বন্ধে শাস্ত্রকার বিশেষ কিছু প্রতিষেধাদি করেন নাই।–ইহা ভাষ্যকার বলেন।।৩।।

দূতী নায়কের চরিত, অনুকূলতা ও কামিত বিষয়ে কীর্তন করিবে। তাহাতে নায়িকার ভাবোচ্ছ্বাস জন্মিয়াছে জানিতে পারিয়া, যুক্তির আশ্রয় লইয়া কার্যশরীর (যাহার জন্য দূতী প্রয়োগ করা হইয়াছে, তাহা) এইরূপে বলিবে।–‘দেখ সুভগে! একটা বড়ই আশ্চর্য কথা বলিতেছি, শোন! অমুক ব্যক্তি অমুক স্থানে তোমাকে দেখিয়া এত বড়ঘরের ছেলে হইলেও চিত্তোন্মাদ অনুভব করিতেছে। সে বড়ই স্বভাবতঃ সুকুমার, সে কখনও অন্য কাহাকে দেখিয়াও এমন আসক্ত হয় নাই ও এমন ক্লেশও পায় নাই। এখন দেখিতেছি, তোমার জন্য সমস্তই ত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসীর মত হইয়াছে। এখনও যদি তোমাকে না পায়, তাহা হইলে হয়ত মরিয়া শরীর জুড়াইতেও পারে।।’৪।।
এইরূপ উৎকট আসক্তির কথা বর্ণনা করিবে। যদি সে কথায় সন্ধিলাভ করিতে পারে; তবে পরদিন বাক্যে, মুখে ও নয়নে প্রসাদভাব অবলোকন করিয়া আবারও কথা পাড়িবে। যদি সেসকল কথা শুনিতে উৎসুক্য প্রকাশ করে, তবে ‘অহল্যা গৌতম ঋষির ভার্য্যা হইয়াও অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া দেবরাজকে উপভোগার্থ কামনা করিয়াছিল। অগ্নিহোত্রক ঋষির ভার্য্যা অগ্নিপরিরক্ষণার্থ নিযুক্ত হইয়াছিল। কদাচিৎ কুণ্ড হইতে উত্থিত অগ্নি মূর্ত্তিপরিগ্রহ করিয়া উপভোগার্থ সেই ঋষিপত্নীর সম্প্রয়োগের কামনা করিয়া সিদ্ধিলাভ করিয়াছিল। তাহার আভাস পাইয়া, তাহার শ্বশুর কালে অনুসন্ধান করিয়া জানিতে পারেন, তাহাই সেই পুত্রবধু অগ্নিসংযোগে গর্ভবতী হইয়াছে।–ইহা জানিতে পারিয়া কুলদোষভয়ে, তিনি পুত্রবধূকে বনে যাইয়া ছাড়িয়া দিয়া আসেন। জাতগর্ভা যুবতী বিধবা বনমধ্যে একটি পুত্র যথাসময়ে প্রসব করিল ও কোনও শবরসেনাপতি নিরপত্যবিধায় সেই সন্তানকে নিজেরই মনে করিয়া লালনপালন করিয়া বর্ধিত করিল। বালক বাল্যকাল হইতে ছাগপাল ও মেষপালের সহিত ক্রিড়াদি করিত ও (প্রচুর পরিমানে ছাগী ও মেষীর দুগ্ধ খাইয়া) বিলক্ষণ বলশালী হইয়াছিল। এমন বলশালী হইয়াছিল যে, হাত দিয়া ধরিয়াই বাল্যাবস্থাতেই ছাগল ও মেষ মারিয়া ফেলিত। সেইজন্য শবর-সেনাপতি ও ঐ বালকের নাম অবিমারক রাখিয়াছিল। তারপর ক্রমশঃ সে যৌবনকালে পদার্পণ করিলে কদাচিৎ সেই বিপিনেই সমাবাসিত (তাহাদিগের সহিত আবাস করিতে বাধ্য করিয়াছিলেন যাহাকে) সেই রাজার কন্যাকে মারিতে একটি হস্তী উদ্যত হইলে অবিমারক সেই হস্তী মারিয়া সেই কন্যাকে জীবনদান করিয়াছিল। সেই ব্যাপারে রাজনন্দিনী অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া নিজেই তাহার পাণিগ্রহণ করিয়াছিল। সুতরাং পারদারিক ব্যাপার মনের ভাব লইয়া; দেখ শকুন্তলা কণ্বঋষির কন্যা হইয়াও মহারাজাধিরাজচক্রবর্ত্তী দুষ্মন্তরাজার রূপলাবণ্য-সৌভাগ্যাদি দর্শন করিয়া অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়া প্রিয়ম্বদা ও অনুসূয়ার সাহায্যে রাজাকে নিজের ইষ্টসিদ্ধি বিষয়ে একান্ত অনুরাগী করিয়া অতুল সুখভোগ করিয়াছিল। ইহাতে মনের প্রবৃত্তির মিনিময়। যে মনের ভাব মনে মনে লুকাইয়া রাখিয়া পুড়িয়া মরে, মৃত্যু তাহার নিকটে আসিয়া উপস্থিত হয়; কিন্তু যে মনে যাহা উদিত হয়, তাহার অভিব্যক্তি করিয়া কার্য্যে পরিনত করিবার সবিশেষ চেষ্টা করে, সেই তো প্রকৃত মানুষ-চরিত্রের বিশ্লেষণে নিপুণ ও মনুষ্যত্ব রক্ষা করিতে সক্ষম হয়। ইত্যাদি ও অন্যান্য লৌকিক নানাবিধ আখ্যান বলিবে ও সেটি যে নিতান্ত যুক্তিযুক্ত, তাহা বুঝাইয়া দিবার জন্য চেষ্টা করিবে। নায়ক যে সম্প্রয়োগে সকলকে পরাস্ত করিতে পারে ও চতুঃষষ্টিকলাবিশারদ এবং নিতান্ত সৌভাগ্যশালী লোক, তাহা বর্ণনা করিবে। তদ্ভিন্ন তাহাকে পাইলে যে স্ত্রীজন্ম শ্লাঘনীর হইবে ও অত্যান্ত প্রচ্চন্নভাবে সম্প্রয়োগ হইতে পারে—এই কথা এমনভাবে বুঝাইবে যে নায়িকা যেন মনে করে যে, নায়কের সহিত তাহার পূর্বে সম্প্রয়োগ হইয়াছে, তাহাই এখন দুটি কথায় বর্ণনা করিতেছে। আর মধ্যে মধ্যে নায়িকার আকার লক্ষ্য করিবে। যখন যাদৃশ আকার লক্ষ্য করিবে, তখনই সেই প্রকারের কথা বলিয়া মনকে আয়ত্ত করিবার চেষ্টা করিবে।।৪।।

তাহার আকারাবয়ব নির্দেশ করিতেছেন—
দেখিয়া বিহসিতের (মধুর হাস্য) সহিত সম্ভাষণ করে। দেখিবামাত্রই আসন দিয়া তাহাকে বসিবার জন্য সাদর আহ্বান করে। কোথায় ছিলে, কোথায় শয়ন করিয়াছিলে, কোথায় ভোজন করিয়াছিলে, কোথায় কোথায় বেড়াইলে, কী বা করিলে, এইসকল কথা জিজ্ঞাসা করে। নির্জন স্থানে নিজের সহিত দূতীর সন্দর্শন করায়। আখ্যানাদি বলিতে নিযুক্ত করে। চিন্তা করিতে করিতে নিশ্বাস ফেলে ও বিজৃম্ভণ করে। প্রীতিদায় (প্রীতিপূর্বক যাহা দেওয়া যায়) দান করে। ইষ্ট উৎসবে দূতীকে স্মরণ করে। আবার আসিও বলিয়া বিদায় দেয়। ‘সাধুবাদিনী হইয়া একি অশোভন কথা বলিতেছ’ এই কথা বলে। নায়কের শঠতা ও চপলতা সম্বন্ধে দোষ দেয়। পূর্বে প্রবৃত্ত নায়কের সন্দর্শন, কথা এবং অভিযোগ নিজে না বলিয়া সে বলিলে শুনিতে ভালবাসে। নায়কের মনোরথ কথ্যমান হইলে থাকিলে সপরিভব হাস্য করিতে থাকে, অর্থাৎ ‘সে দিন কি হইবে—যে, পায়ে ধরিয়া প্রসাদিত করিয়া অধর-সুধাপানে হৃদয়তাপের প্রশমন করিতে পারিবে?’ নায়ক এই কথা বারংবার বলে—দূতী এইরূপ বলিলে, নায়িকা যদি এই কথা বলেন—তিনি ভারি দুষ্টু, তাঁর মত ধূর্ত্ত আর-ত দেখি না, তাও নাকি আবার মানুষ পারে? ইত্যাদি কথা বলিয়া যদি পরাস্ত করিবার অভিপ্রায়ে হাস্য করে; কিন্তু নিশ্চয়ই তাহার মনোরথ সিদ্ধ হইবে, এরূপ কথা যদি না বলে।।’৫।।

এরূপে বিশেষ ভাব নায়িকার লক্ষ্য করিতে পারিলে ফল কি হইবে, তাহা বলিতেছেন—
দর্শিতাকারা নায়িকাকে দূতী পূর্বপ্রবৃত্ত অভিজ্ঞান দ্বারা অত্যন্ত অনুরক্ত করিবে। আর যাহার সহিত কখনও নায়কের পরিচয় হয় নাই, তাহাকে নায়কের গুণগান বর্ণনা করিয়া অনুরাগবর্দ্ধক কথা দ্বারা কার্যসিদ্ধিত অনুকূলে আনয়ন করিবে।।’৬।।

এ বিষয়ে আচার্যগণের মতভেদ রয়েছে। তাহা ক্রমশঃ ক্রমশঃ দেখাইতে প্রস্তাব উত্থাপন করিতেছেন—
ঔদ্দলকি বলেন—যাহার সহিত পরিচয় হয় নাই, বা যাহার আকারও পরিদৃষ্ট হয় নাই, তাহার সিদ্ধিবিষয়ে দূতীর কর্ম কিছুই নাই।
বাভ্রব্যের মতাবলম্বীরা বলিয়া থাকেন—পরিচিত না হইলেও যদি আকারের সংসর্গ কিছুমাত্রও থাকে, তবে দূতীর কর্ম সেখানে নিশ্চয়ই আছে।
গোণিকাপুত্র বলেন—পরিচিত, কিন্তু কখনও আকার প্রদর্শিত হয় নাই, সেইরূপ স্থলেও দূতীর কর্ম অবশ্যই আছে।
বাৎস্যায়ন বলেন—পরিচিত ও দৃষ্টাকার হউক, আর নাই হউক, সকলস্থলেই দূতীদ্বারা কার্যসিদ্ধি হইতে নিশ্চয় পারে।।’৭।।

নায়িকা অপরিচিত হইলে, তাহাকে নায়কের প্রহিত বা প্রেরিত মনোহর উপায়ন (উপঢৌকন) সকল, তাম্বুল, অনুলেপন, মাল্য, অঙ্গুরীয়ক ও বসন দানার্থ দেখাইবে। তাহাকে নায়কের যথাসম্ভব নখদশনপদচ্ছেদ্যসকল চিহ্নিত থাকিবে। কাপড়ে কুঙ্কুমচিহ্নিত অঞ্জলি থাকিবে। নানাবিধ অভিপ্রায়-সংসূচী পত্রচ্ছেদ্যসকল প্রদর্শন করিবে। তাহার মধ্যে মধ্যে মদনলেখ-পত্র থাকিবে। কর্ণপত্র ও আপীড় (ফুলের কাণবালা ও মুকুট) থাকিবে। তাহাতে নিজের মনোরথ প্রকাশ করিবে। তাহার উত্তরদানের জন্য দূতী নায়িকাকে প্রবৃত্তি দ্বারা নিয়োজিত করিবে। এইরূপে নায়ক ও নায়িকা পরস্পর প্রতিগ্রহ করিতে প্রবৃত্ত হইলে, তখন দূতীই মধ্যবর্তী হইয়া উভয়ের সমাগমে সহায়ক করিবে।।’৮।।

কোনও দেবতা দর্শনের জন্য যাইয়া, যাত্রায়, উদ্যানক্রীড়ায়, যেখানে বহুজন স্নানার্থ জলে অবতরণ করে, বিবাহে, যজ্ঞে, ব্যসনে ও উৎসবে, অগ্নির উৎপাত হইলে, চৌরবিভ্রমে, যানে আরোহণ করিয়া জনপদ প্রদক্ষিণ করিতে স্বীকার করিলে, প্রেক্ষাব্যবহারে (সঙ্কেতদ্বারা) ও অন্যান্য নানাবিধ কার্যে নায়কের অলক্ষিতভাবে সমাগম সাধিত করিবে।–বাভ্রব্যের মতাবলম্বীরা এই কথা বলিয়া থাকেন।
গোণিকাপুত্র বলেন—সখী, ভিক্ষুকী, ক্ষপণিকা (সন্ন্যাসিনী) এবং তাপসীর গৃহে লইয়া যাইয়া উভয়ের সমাগম করা অতীব সুখকর উপায়সাধ্য।
বাৎস্যায়ন বলেন—সেই নায়িকার বাটীতেই যদি প্রবেশ করিবার ও নিষ্ক্রম করিবার পথ-পরিজ্ঞান থাকে এবং যাহা হইলে কোনরূপেই বিপদের কিছুমাত্র সম্ভাবনা না থাকে, সেইরূপে প্রতিকার করা যাইতে পারিলে, সেইপ্রকারে সাধারণের অবিজ্ঞাতকালে প্রবেশন ও নিষ্ক্রমণ একান্ত যুক্ত। অবশ্য প্রবেশন ও নিষ্ক্রমণ কিছু নিত্যই হইতে পারে না; কারণ নায়িকা যে সকল সময়েই সে স্থানে উপস্থিত থাকিতে পারিবে, তাহা-ত কোনরূপেই সম্ভবপর হইতে পারে না; সুতরাং এইরূপে নায়িকার বাটীতেই সমাগম বিধেয় এবং সেই সমাগমই সুখকর উপায়সাধ্য। তবে সে বিষয়ে বিশেষ সাবধানতা অবলম্বন করিতে হইবে, ইহা স্বতঃসিদ্ধ।।’৯।।

এখন দূতীভেদ নির্ণয় করিতেছেন;–
নিসৃষ্টা, পরিমিতার্থা, পত্রহারী, স্বয়ংদূতী, ভার্য্যাদূতী, মূকদূতী ও বাতদূতী, এইগুলি দূতীবিশেষ।।’১০।।

নায়ক ও নায়িকার যথাভিলষিত বিষয়ের উপলব্ধি করিয়া নিজের বুদ্ধি অনুসারে যে কার্যসম্পাদন করে সেই নিসৃষ্টার্থা দূতী নামে অভিহিত হয়।।’১১।।

ইহার বিষয় কি তাহা বলিতেছেন—
সেই নিসৃষ্টার্থা দূতী প্রায়শঃ যাহাদিগের পরস্পর কথোপকথনাদি হইয়াছে,–তাহাদিগের পক্ষেই উপযুক্ত। তদ্ভিন্ন যাহাদিগের সম্ভাষণ ও পরিচয় হয় নাই, তাহাদিগের মধ্যে নায়িকাদ্বারা নিসৃষ্টার্থাদূতী প্রযূক্ত হইতে পারে। আর তদ্ভিন্ন যখন নিসৃষ্টার্থা দূতীর মনে কৌতুক উদিত হইবে যে, এই নায়ক ও এই নায়িকা, ইহারা বয়সে, রূপে, গুণে ও শীলে সমান, সুতরাং ইহারা পরস্পর পরস্পরের প্রণয়ে সুখী হউক না কেন? কেন মিথ্যা মিথ্যা কষ্ট পায় ও নিরর্থক যৌবন ক্ষয় করে? এইরূপ কৌতুকবশতঃ দূতী, নায়ক ও নায়িকা যদিও পরস্পরের অপরিচত, তথাপি তাহাগিগের সমাগমের জন্য নিযুক্ত হইতে পারে।।’১২।।

নায়ক ও নায়িকার আচরিত কার্য্যৈকদেশ অভিযোগের একদেশ উপলব্ধি করিয়া অবশিষ্ট কার্য ও অভিযোগ যে সম্পাদন করিতে পারে, সে পরিমিতার্থা।।’১৩।।

ইহার বিষয় কি তাহা কথিত হইতেছে—
সেই পরমিতার্থা দূতী,–যাহাদিগের আকার প্রদর্শিত হইয়াছে কিন্তু তাহার পরে আর দর্শন পাওয়া কঠিন, তাহাদিগের কার্য সমাপদন করিবে।।’১৪।।

সংবাদ প্রদান করিবে। তদ্ভিন্ন আর কিছুই করিতে সমর্থা নহে, সে পত্রহারী।।’১৫।।

তাহার কার্য এইমাত্র যে, সে প্রগাঢ়সদ্ভাব পরস্পরসংসৃষ্ট নায়ক ও নায়িকার দেশ ও কাল বিষয়ের বিজ্ঞাপনমাত্র করিবে।।’১৬।।

স্বয়ংদূতী দুই প্রকার—আত্মার্থা ও পরার্থা। তন্মধ্যে যে পর দ্বারা প্ররিত, সে পরার্থা। আর যে নিজের জন্য প্রেরিত, সে আত্মার্থা। তাহার কর্ত্তব্য কি, তাহা কথিত হইতেছে—

অন্যা নায়িকা কর্ত্তৃক দৌত্যকার্যে প্রহিত হইয়া যে নিজেই নায়কের সহিত উপভোগে প্রবৃত্ত হয়, অথবা অজানতীর ন্যায় স্বপ্নে সেই নায়কের উপভোগ-সুখে অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হইয়াছে—বলে। গোত্রস্খলিত হইলে—অর্থাত তাহাকে ডাকিতে যাইয়া নায়কের স্ত্রীর নাম ধরিয়া ডাকিলে, তাহাতে দূতী বলিবে, বাহবা! আমার নাম তোমার এমনই মনে লাগিয়াছে, যে তোমার স্ত্রীকে ডাকিতে যাইয়াও আমার নাম আর ভুলিতে পারিলে না! যাক, নাহয় তাহাও স্বীকার করিতাম; যদি তোমার স্ত্রী আমার রূপের কাছে লাগিত। অমন বামনমুখী, কোটরাচোখী পোড়া অঙ্গারখানিকে ডাকিতে কিনা আমার নাম ধরিলে। এ তোমারও ভাল হয় নাই। একথা আমার কানে শোনাও ভাল হয় নাই। যা হোক ভাই, অমন কাজটি আর যেন না হয়। এইরূপে নায়কের স্ত্রীর নিন্দা করিবে। সেইস্থলে ঈর্ষ্যা প্রদর্শন করিবে, অথবা নখের বা দশনপদের কিছু চিহ্ন করিয়া দিলে সিদ্ধা হইবে। তখন বলিবে—আমি মনে মনে আপনাকে এরূপ চিহ্ন করিয়া দিতে অগ্রেও চাহিয়াছিলাম—একথা বলিবে। আরও বলিবে, আচ্ছা, জিজ্ঞাসা করি—আমি ও তোমার ভার্য্যা, এই দুইজনের মধ্যে কে বেশী রমনীয়? নির্জনে এইরূপে পর্যনুযোগ করিবে। যে এইরূপ করিবে, তাহাকেই শাস্ত্রে স্বয়ংদূতী বলিয়া অভিহিত করা হয়। নির্জন প্রদেশেই তাহার দর্শন ও পরিগ্রহ করিবে। প্রতিগ্রহচ্ছলে অন্যাকে অভিসন্ধান করিয়া তাহার সংবাদ শ্রবণ করান ছলে নায়ককে সাধিত করিবে এবং তাহাকে উপহত করিবে অর্থাৎ দণ্ডিত ও তিরস্কৃত করিবে; সেও স্বয়ংদূতী। ইহাদ্বারা অন্য দূতনায়কও ব্যাখ্যাত হইল।।’১৭।।

মুগ্ধা নায়কভার্যার বিশ্বাস উৎপাদন করিয়া, সেই বিশ্বাস সাহায্যে অনুপ্রবিষ্ট হইয়া নায়কের চেষ্টিত প্রকার জিজ্ঞাসা করিবে। কলাযোগ নায়কভার্যাকে শিক্ষা দেবে। আকারের (কামজ অভিব্যক্তি ভাবের) সহিত মণ্ডন বিন্যাস, অর্থাৎ অলঙ্কার দ্বারা সাজাইয়া দিবে, যদ্দ্বারা নায়কের নিকটে তাহার আকার প্রকাশ হইতে পারে। তোমার স্বামী ভারি চপল, অন্যাতে আসক্ত; তাহার এমন কি গুণ আছে যে, তুমি তাহার উপর কূপিত না হও? আমি কিন্তু এরূপ ভালবাসি না।–এইরূপ কথা দ্বারা নিজের ঈর্ষ্যা দেখাইবে। আর বলিবে—আমি যাহা বলি, তাহা কর; দেখিবে ও ‘আলোদোষ’ আর থাকিবে না। এই কথা শুনাইবে। স্বয়ং নখদশনপদচ্ছেদ্য নিবর্তিত করিবে ও তদ্দ্বারা নায়ককে আকারিত করিবে। ইহাকে—অর্থাৎ এতাদৃশ নায়কভার্যাকে মূঢ়দূতী বলিয়া অভিহিত করা যায়।।’১৮।।

নায়ক এইরূপে অভিযোগ করিলে, তাহার প্রত্যভিযোগ সেই নায়িকা বা স্ত্রীদ্বারাই দিবে।।’১৯।।

মূঢ়া স্বভার্যাকে প্রযুক্ত করিয়া তাহার দ্বারা নায়িকার বিশ্বাস উৎপাদন করাইয়া ভার্যাদ্বারাই আকারিত করাইবে। নিজের বৈচক্ষণ্য প্রকাশ করিবে। যে ভার্যা এই প্রকারে দৌত্যকর্ম করিয়া থাকে, তাহাকে ভার্যাদূতী বলা যাইতে পারে। আর সেই ভার্যাদ্বারাই নায়িকার প্রদর্শিত আকার গ্রহণ করিবে।।’২০।।

যদি স্বীয় ভার্যা দ্বারা সাধিত করিতে না পারে, তবে কি করিবে? তাহা কথিত হইতেছে—
কোন অদোষজ্ঞা বালিকা পরিচারিকাকে অদুষ্ট উপায় দ্বারা নায়িকার নিকট পাঠাইবে। তাহার সহিত পরিচয় হইলে ক্রমশঃ মালার মধ্যে বা কর্ণ পত্রের মধ্যে গূঢ়ভাবে মদনলেখ বা নখদশনপদচ্ছেদ্য করিয়া তদ্দ্বারা পাঠাইবে। তাহাকে মূকদূতী কহে। নায়িকার নিকট তদ্দ্বারাই প্রার্থনা করিবে।।’২১।।

যদি বালিকা-পরিচারিকার সাহায্য না পাওয়া যায়, তবে কি করিবে, তাহা বলা যাইতেছে—
নায়ক ও নায়িকার পূর্ব-প্রস্তাবিত বিষয়ের চিহ্নসম্বদ্ধ অথচ অন্যের গ্রহনযোগ্য নহে, সাধারণ লোকের পরিজ্ঞাত বিষয়ের প্রকাশকর বা দ্ব্যর্থঘটিত বাক্য যে উদাসীনা নায়িকা বা নায়ককে শ্রবণ করায়, তাহাকে বাতদূতী কহে। তদ্দ্বারাই নায়ক বা নায়িকার নিকটে উত্তর প্রার্থনা করিবে।।’২২।।

বাভ্রব্যের মতাবলম্বীরা বলিয়া থাকেন—
পত্রিকা, চিত্ররূপসকল, পশুসকল, শূক ও সারিকা প্রভৃতি তির্যক্‌জাতি গূঢ়ভাব নায়ক-নায়িকার দূতকর্ম করিতে পারে।।’২২।।

ইতি দূতীগণের বিশেষত্ব

পূর্বে যে তিনটি দূতীর কথা কথিত হইয়াছে, তাহারা কি প্রকার, তাহা বলা যাইতেছে—
এ বিষয়ে কতকগুলি শ্লোক আছে—
বিধবা, ঈক্ষণিকা, দাসী, ভিক্ষুকী ও শিল্পকারিকা, ইহারা অতি সত্বরই বিশ্বাসের সহিত গৃহপ্রবেশ করিতে পারে ও দূতীকর্ম ও ভালরূপে করিতে পারে।।’২৩।।

সংক্ষেপে দূতীকর্ম বলা যাইতেছে—
পতির উপর বিদ্বেষভাব গ্রহণ করাইবে। তাহার উপায়—নায়িকার রূপ, গুণ ও সৌভাগ্যের বৈপরীত্যদর্শন। নায়কের চরিত্র রমণীয় ও নায়ক অনুকূল ইত্যাদি বর্ণনা করিবে। নায়কের চিত্রসুরতসংযোগ তাহার ও তাহার সখীদিগের নিকট প্রত্যক্ষভাবে দর্শন করাইবে। নায়কের অনুরাগ ও রতিকৌশল বর্ণনা করিবে। নায়কের প্রার্থনা শুনাইবে। অনেক স্ত্রীই যে নায়ককে কামনা করে ও লাভ করিয়া অনেকে কৃতার্থও হইয়াছে, ইহা শ্রবণ করাইবে। নায়ক হয় তোমাকে পাইবে, না হয় শ্মশানেই যাইবে, এরূপ স্থিরসঙ্কল্প শুনাইবে।।’২৪।।

নায়ক আপানকযোগ্য নহে—ইত্যাদি দোষবশতঃ যদি নায়িকা তাহার সংসর্গে যাইতে ইচ্ছা না করে বা একেবারে সে সংকল্প পরিত্যাগ করিয়া থাকে, তবে দূতী বচনকৌশলে আবার নায়কের উপর আসক্ত করিয়া ফিরাইয়া দিবে, যাহাতে সে যাইয়া মিলিত হইতে চাহে।।’২৫।।

ইতি দূতীকর্মনামক প্রকরণ।
ইতি শ্রীমদ্‌বাৎস্যায়নীয় কামসূত্রে পারদারিকনামক পঞ্চম অধিকরণে
দূতীকর্মনামক চতুর্থ অধ্যায় সমাপ্ত।।৪।।



Post a Comment

Previous Post Next Post

POST ADS1

POST ADS 2