পঞ্চম ভাগ – তৃতীয় অধ্যায়
পূর্বকথিতরূপে অভিযোগ প্রযুক্ত হইলেও যে সকল স্ত্রী প্রগল্ভপরিক্ষীণা ও ধীরপ্রকৃতি, তাহাদিগের সদ্ভাব কোন রূপেই নির্ভিন্ন হইয়া উঠে না; সুতরাং তাহাদিগের উপর বিশেষাভিযোগ কখনই প্রযুক্ত হইতে পারে না। অতএব সেখানে ভাবপরীক্ষা একান্ত প্রয়োজন বলিয়া, এখন ভাবপরীক্ষাপ্রকরণের আরম্ভ করা যাইতেছে—
‘নায়ক অভিযোগ করিয়া নায়িকার প্রবৃত্তি পরীক্ষা করিবে। প্রবৃত্তি পরীক্ষা দ্বারাই ভাবপরীক্ষা হইয়া যাইবে। তদ্ভিন্ন অভিযোগের প্রতিগ্রহ করিতে ত্রুটি করিবে না।।’১।।
‘যে নায়িকা সাম্প্রয়োগিকভাব প্রকাশ করিতে যত্ন করে না, তাহাকে দূতী দ্বারা সাধিত করিবে।।’২।।
‘নায়ক কর্তৃক ক্রিয়মান অভিযোগের প্রত্যাখ্যান করিয়া আবার কিছু দিন পরে নায়কের সংসর্গে আসিলে, তখন নায়ক তাহাকে দ্বিধাভূতমানসা বলিয়া জানিবে। ক্রমশঃ তাহাকে সাধিত করিবে।।’৩।।
এ বিষয়ে একটু
বিশেষ আছে—
‘প্রযুজ্যমান
অভিযোগের প্রত্যাখ্যান করিয়া
যদি তৎক্ষণাৎ আবার সবিশেষভাবে
অলঙ্কৃত হইয়া দেখা দেয়;
তবে আবার সেইরূপই
অভিযোগ প্রয়োগ করিবে। যদি
নির্জন প্রদেশে সেইরূপে পাওয়া
যায়, তবে
জানিবে সে বলাৎ-গ্রহণীয়া,–অর্থাৎ
তাহাকে বলপূর্বক গ্রহণ করিলেই
সিদ্ধা হইবে।।’৪।।
‘ধীরতাপ্রযুক্ত বহু অভিযোগ বিসহ্য করে; কিন্তু অবিলম্বে আত্মসমর্পণ করিতে কুণ্ঠিত হয়।–এরূপ স্থলে জানিবে, সে শুষ্কপ্রতিগ্রাহিণী,–অর্থাৎ নিরর্থক বহু অভিযোগ প্রতিগ্রহ ভালবাসে; সুতরাং সে পরিচয়ের অপনয়নসাধ্যা।।’৬।।
কি করিয়া পরিচয়
অপনয়ন করিবে?—
‘মনুষ্যজাতির
চিত্ত নিয়ত নহে। এই হেতু।।’৫।।
‘অর্থাৎ কদাচিৎ মনের চাপল্যবশতঃ পরিচয় বিচ্ছিন্ন হইলেও আবার পরিচয়ের সন্ধান করে। আবার কখন বা সঞ্চিত পরিচয়ের বিচ্ছেদ করিয়া বসে; সুতরাং অভিযোগ গ্রহণ করিয়াও তাহার আত্মপরিচয় সে সময়ে উদ্ভাবিত হওয়ায় সে অভিযোগ কার্যকর হইতে দেয় না। এই জন্যই বহু অভিযোগ প্রতিগ্রহ করিতে ভালবাসে ও কোন কোন স্থলে বহু অভিযোগ গ্রহণ করিয়াও একেবারে কার্যকর হইতে দেয় না; সুতরাং সে সকল স্থলে তাহার আত্মপরিচয়ের অপনোদন করিয়া দিবে।।’৬।।
‘অভিযুক্ত হইলেও অভিযোগের পরিহার করে; সংসর্গ করিতে চাহে না; কারণ নিজের উপর একটি কোন প্রবল অভিমান থাকে; কিন্তু নায়ককে একেবারে প্রত্যাখ্যানও করে না; কারণ, নিজের উপর প্রবলতর কিছু গৌরবের অভিমান থাকে। সে নায়িকা অত্যন্ত পরিচয় দ্বারা কষ্টসাধ্যা। মর্মজ্ঞ দূতী দ্বারা তাহাকে সাধিত করিবে।।’৭।।
তাহার কিছু
বিশেষ আছে—
‘অভিযোগ
প্রযুক্ত করিলে, যদি
সে নায়িকা অত্যন্ত নিষ্ঠুরবাক্যে
ভর্ত্সনা করিয়া প্রত্যাখ্যান
করে, তবে
তাহাকে উপেক্ষা করিবে।।’৮।।
‘যদি পুরুষ, অর্থাৎ কর্কশ ভাষার প্রয়োগ করিয়া আবার প্রীতিযোজনা করে, তবে আবার তাহাকে অভিযুক্ত করিতে চেষ্টা করিবে।।’৯।।
‘কোনও কারণ বশতঃ সংস্পর্শনাভিযোগ সহ্য করে; কিন্তু যেন নায়কের অভিপ্রায় না জানিয়া সংস্পর্শন সহ্য করে। সে দ্বিধাভূতমানসা। তাহাকে অবিচ্ছেদভাবে সংস্পর্শনক্ষম করিবে।।’১০।।
‘নিকটে শায়িত থাকিলে নায়ক সুপ্তব্যক্তির ন্যায় নিজহস্ত নায়িকার দেহোপরি বিন্যস্ত করিবে। সে সুপ্তার ন্যায় উপেক্ষা করিবে। যদি জাগিয়াই থাকে, তবে হাতখানি সরাইয়া দিবে; কারণ, তাহার সন্দেহ হইতে পারে যে,–এ ব্যক্তি নিদ্রিত থাকিয়াই হস্ত বিন্যাস করিয়াছে, কি অভিযোগার্থ কৃতকসুপ্তের ন্যায় বিন্যাস করিয়াছে? সেই সন্দেহ অপনোদনার্থ আবার অভিযোগের আকাঙ্খা করিয়াই হাত সরাইয়া দিবে।।’১১।।
‘ইহাদ্বারা পাদোপরি পাদবিন্যাস ব্যাখ্যান হইল।।’১২।।
‘সেই হস্তন্যাস ও পাদবিন্যাস সহ্য করিলে, আবার সুপ্ত-সংশ্লেষণের উপক্রম করিবে। যদি তাহা সহ্য না করিয়া উঠিয়া সরিয়া যায় ও পর দিন যদি কোনরূপ কোপ প্রকাশ না করিয়া প্রকৃতিস্থ থাকে; তবে সে নিশ্চয়ই অভিযোগার্থিনী জানিবে। যদি পরদিন তাহাকে প্রকৃতিস্থ দেখিতে পায় ও তাহার পর আর দেখিতে না পায়, এরূপ হয়, তবে সে দূতী দ্বারা সাধ্যা জানিবে।।’১৩।।
‘যদি তাহার পর বহুদিন যাবৎ কুপিত থাকিয়া, পরে আবার প্রকৃতিস্থ হইয়া সেই নায়কের সহিত কোনও প্রকার সংসর্গ করে; তবে সেই কৃতলক্ষণা দর্শিতাকারা নায়িকাকে আবার অভিযোগ করিবে।।’১৪।।
‘যে অভিযুক্ত না হইয়াও ভাবসূচক দেখায়। নির্জন প্রদেশে নিজেকে অনাবৃত করিয়া দেখায়। কম্পের সহিত গদ্গদভাবে কথা বলে। কর ও চরণাঙ্গুলি স্বিন্ন হয় এবং স্বিন্ন (ঘর্মাক্ত) মুখী হয়। নিজের শিরঃ পীড়ন ও ঊরুর সম্বাহনবিষয়ে নিজেকে নায়কের নিকট নিযুক্ত করে। পীড়িতা নায়িকা বা সম্বাহিকা একহস্ত দ্বারা সম্বাহন করে, ও অন্য বাহু দ্বারা স্পর্শ সুখের আবেদন করে এবং আশ্লেষ করে। বিস্মিতভাব প্রকাশ করিয়া আবার সেইরূপ আশ্লেষ করে। ঊরু ও বাহুযুগল দ্বারা পরিস্পৃশ্যা হইয়াও নিদ্রান্ধার ন্যায় অবস্থান করে। অলিকের (ললাটের) একদেশ (অগ্রভাগ) ঊরুযুগলের উপর পাতিত করে। ঊরুমূল সম্বাহনে নিযুক্ত হইয়া প্রতিকুলকার্য্য করে না, অর্থাৎ স্বীকার করে। সেস্থানে একখানি হস্ত অবিচলরূপে স্থাপন করে। ঊরুদ্বয়ের সন্দংশদ্বারা সে হস্ত পীড়িত হইলে বিলম্বে সরাইয়া লয়। নায়কের নিকট এইরূপ অভিযোগ পাইয়াও আবার দ্বিতীয়দিনে সম্বাহনের জন্য গমন করে। অত্যান্ত সংসর্গ করে না। পরিহারও করে না। নির্জন প্রদেশ ব্যতীতও প্রকাশ্যভাবে এবং নির্জন প্রদেশেও নিষ্কারণে ভাবদর্শন করায়। যাহারা পরিচারক ও উপভোগ্য স্বচ্ছন্দরূপ থাকিলেও পূর্বোক্তপ্রকারে যদি আকারিত হইয়াও সেইরূপই অবস্থান করে, সিদ্ধ না হয়; তবে সে নিশ্চয়ই মর্মদূতীদ্বারা সাধিত হইবে। যদ্যপি ব্যাবর্তমানা হইয়া (প্রত্যাখান করিয়া) প্রকৃতিস্থ না হয়; তবে তাহার সম্বন্ধে বিবেচনা করা উচিত।।’১৫।।
ইতি ভাবপরীক্ষানামক প্রকরণ।
‘এ বিষয়ে
কতকগুলি শ্লোক আছে;–
প্রথমে
পরিচয় করিবে। তারপর,
পরিভাষণ করিবে।
পরিভাষণের সহিত পরস্পর আকার
দর্শন করাইবে। যখন অভিযোগ
করিবে, তখন
মানব ভয়হীন হইয়াই স্ত্রীকে
অভিযুক্ত করিবে। প্রথম দর্শনেই
যে নারী নিজের আকার দ্বারা
ভাবপ্রদর্শন করিবে,
তাহাকে অতি
শীঘ্রই অভিযোগে অভিযুক্ত করা
উচিত। যে স্ত্রী সামান্য
আকারিত হইলেই পরিস্ফুটভাবে
উত্তর দেয়, সে
নারীর অত্যান্ত রতিলালসার
বিষয় বুঝিতে হইবে। সেও তৎক্ষণাৎ
সিদ্ধ হয় জানিবে। ধীরপ্রকৃতি
অপ্রচণ্ডস্বভাবা পরীক্ষিণি
স্ত্রীতে এই সূক্ষ্ণবিধি
প্রয়োগের কথা কথিত হইল। এতাদৃশ
স্ত্রীগণ প্রকাশ্যভাবেই
সিদ্ধা বলিয়া জানিবে।।’১৬।।
ইতি
ভাবপরীক্ষাসংগ্রহপ্রকরণ।
ইতি
শ্রীমদ্বাৎস্যায়নীয় কামসূত্রে
পারদারিকনামক পঞ্চম অধিকরণে
ভাবপরীক্ষানামক তৃতীয় অধ্যায়
সমাপ্ত।।৩।।