পঞ্চম ভাগ – দ্বিতীয় অধ্যায়
সঞ্জাত ইচ্ছাকে ক্রিয়ার দ্বারা পরিবর্ধিত করিতে হইবে, এই কথা কথিত হইয়াছে। সম্প্রতি সেই সকল ক্রিয়া কি, তাহাই এখন বলা যাইতেছে। তাহার নির্ণয় করিতে হইলে, নিশ্চয়ই প্রথমে পরিচয়কারণ প্রদর্শণ করা আবশ্যক, এজন্য প্রথমে পরিচয়কারণ প্রদর্শন করা যাইতেছে—
‘আচার্যগণ বলেন—কন্যাগণ যেমন নিজের অভিযোগসাধ্য, সেরূপ দূতী দ্বারা সাধ্য নহে, কিন্তু প্রবৃত্তসংযোগ পরস্ত্রীগণ সূক্ষ্মভাব পোষণ করে বলিয়া, তাহারাই যাদৃশ দূতীসাধ্য, তাদৃশ আত্মসাধ্য নহে।।’১।।
‘বাৎস্যায়ন বলেন—যোগ্যতায় কুলাইলে সর্বত্রই নিজের সাধন উপপন্নতর। তবে যেখানে নিতান্ত দুরুপপাদ, অর্থাৎ যেখানে নিজে সাধন করিতে অক্ষম, সেইখানেই তাহার পক্ষে দূতী প্রয়োগ যুক্তিসঙ্গত।।’২।।
‘যাহারা প্রথমে সাহস করিয়াছে, চরিত্রখণ্ডনে এবং কথাবার্তা করিলে যাহাদিগের সহিত কোনই প্রতিবন্ধকতাই নিয়া। নিজেরই তাহাদিগকে প্রতারিত করা উচিত। যাহারা তাহার বিপরীতভাবা, তাহাদিগকে দূতী দ্বারা প্রতারিত করিবে। ইহা প্রায়িকব্যবহারসিদ্ধ দেখা যায়।।’৩।।
‘যেখানে নিজেকেই অভিযোগ করিতে হইবে, সেখানে প্রথমেই পরিচয় করিবে।।’৪।।
পরিচয় বা সন্দর্শন দ্বিবিধ, ইহা কথিত হইতেছে—
‘নায়িকার পরিচয়কর সন্দর্শন স্বাভাবিক ও প্রাযত্নিকভেদে দ্বিবিধ।–তন্মধ্যে স্বাভাবিক সন্দর্শন যদি নিজের বাটীর নিকটে ক্বচিৎ আগমন করে, তবেই ঘটিবে; তদ্ভিন্ন মিত্র, জ্ঞাতি, মহামাত্র, বৈদ্য ইত্যাদির বাটীতে আসিলে বা বিবাহ, যজ্ঞ, উৎসব, ব্যসন ও উদ্যান গমনাদি কালে সন্দর্শন প্রযত্নকৃত হইবে।।’৫।।
উক্ত দ্বিবিধ সন্দর্শনে পরিচয়কারণও দ্বিবিধ; বাহ্য অ আভ্যন্তর। তন্মধ্যে বাহ্যপরিচয়কারণের লক্ষ্য করিয়া কোন বিধান করা যাইতেছে—
‘নায়িকাকে দেখিতে পাইলে সকল সময়েই সাকার (ভাবসূচক নুখনয়নগত আকারের সহিত) প্রেক্ষণ করিবে। মাথার চুল খুলিয়া ফেলিয়া আবার বন্ধন করিবে। সেইরূপে, নিজেরই অঙ্গে নখের দ্বারা ‘আচ্ছুরিতক’ প্রয়োগ করিবে। আভরন গুলির প্রহ্লাদন (শব্দ), অঙ্গুষ্ঠসম্পুট দ্বারা অধরোষ্ঠ যুগলের বিমর্দন বা পরিঘর্ষণ, বয়স্যের সহিত গুণসম্বর্ধনপ্রধান সেই সেই কথা, নায়িকা ফিরিয়া দর্শন করিতে থাকিলে, নায়িকাকে ছলে বুঝাইবার জন্য অন্যকে লক্ষ্য করিয়া নায়িকাসম্বন্ধীয় কথা, দাতৃত্বভোগিত্বখ্যাপনার্থ ত্যাগ ও ভোগের প্রকাশন, কোন সখার ক্রোড়ে নিষণ্ণ অর্থাৎ শায়িত বা উপবিষ্ট হইয়া অঙ্গস্ফোটনের সহিত জৃম্ভণ, সেই নিষণ্ণ অবস্থাতেই একভ্রুক্ষেপণ, সগদ্গদভাষণ, তাহার কথা শ্রবণ, তাহাকে উদ্দেশ্য করিয়া গর্ভরূপ বালক বা অন্যের সহিত অন্য সুহৃদের উপদিষ্ট দ্ব্যর্থঘটিত কথা কথন, (যে কথায় বালক বা অন্যকে ও নায়িকাকেও বুঝাইতে পারে)। সেই কথায় নিজের মনোগত ভাবের অভিব্যক্তীকরণ, (‘দেখ ভাই! আমার মনোরথ বড়ই দুর্ঘট! জানি না, কি হইবে, না হইবে?’ আচ্ছা একবার বিশ্বাস করিয়াই দেখ না, আমি-ত আর অপাত্র নহি।’ ‘দেখ ঠিক ব’লো, তুমি আমাকে কি ভাবে দেখ?’ ‘আমি কিন্তু তোমাকে প্রাণের সহিত ভালবাসি, তবু তোমার মন পাই না।’—ইতাদি প্রপঞ্চ), নায়িকাকে উদ্দেশ্য করিয়া কোনও বালককে চুম্বন, আলিঙ্গন, জিহ্বা দ্বারা তাম্বুল দান, তর্জনী দ্বারা হনুদেশের ঘট্টন, (চোয়াল বা চক্ষুর নিম্নে, গণ্ডোস্থলের উচ্চে অস্থিখণ্ডস্থ স্থান, তৎপরে কপোল বা টেয়ো, তার নিম্নে হনুস্থল), এই সমস্ত যেমন যোজন করিতে পারে ও যেমন অবকাশ পাইবে, সেই ভাবে ও সেই অনুসারে প্রয়োগ করিবে। নায়িকার ক্রোড়স্থিত বালকের লালন, তাহাকে বালক্রীড়নক দান, গ্রহণ, তাহার সন্নিকট হইয়া কথা বলা, তাহার সহিত যে সম্ভাষণক্ষম, তাহার সহিত প্রীতিসংস্থাপন করিয়া কার্যের প্রয়োগ ও সেই কার্যের সিদ্ধির জন্য গমনাগম যোজন এবং যেখানে থাকিয়ে সে নায়িকা শুনিতে পায়, সেই স্থানে থাকিয়া অন্যের সহিত নায়িকাকে না দেখিয়া, বিজ্ঞত্বখ্যাপনার্থ কামসূত্রের আলাপ ও চর্চা করিবে।।’৬।।
অন্যথা নায়কের বিজ্ঞতাহানি ও বিদগ্ধতার অর্থাৎ নৈপুণ্য বা রসিকতার বিলোপ ঘটিবে।।৬।।
এখন আভ্যন্তরপরিচয়কারণ নির্ণয় করিতেছেন—
‘এইরূপে সর্বথা পরিচয় জন্মিলে, তাহার হস্তে চিরকালগ্রাহ্য ন্যাস ও অল্পকালগ্রাহ্য নিক্ষেপ স্থাপন করিবে। (ঐ সকল প্রত্যহ দিবে ও প্রত্যহই লইবে।)—যাহা নিক্ষেপ স্থাপন করিবে, তাহা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ অল্প অল্প করিয়া লইবে। সুগন্ধি দ্রব্যসমূহ, পান, সুপারি, এলাইচ ইত্যাদি। সেই নায়িকাকে নিজের পত্নীর সহিত নির্জন প্রদেশে বিশ্বাসকর গোষ্ঠীতে আপানকার্য মিলিত করিয়া দিবে। তদ্দ্বারা প্রত্যহ তাহার দর্শনেও ক্রমশঃ তাহার বিশ্বাস জন্মাইয়া দেওয়া হইবে। সে নায়িকা যদি সুবর্ণকার, মণিকার, বৈকটিক (রত্নপরিশোধক), নীলীরঞ্জক, কুসুম্ভরঞ্জক ও ত্বষ্টৃ-কাংস্যাকারাদির নিকট কিছু প্রয়োজন বোধ করে, তবে নিজের বশীভূত সেই সকল লোকদিগকে আনাইয়া তাহার সেই কল্পনাপূরণার্থ নিজে প্রযত্ন করিবে। তাহার অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইলে সাধারণের বিদিতভাবে দীর্ঘকাল নায়িকার সন্দর্শনযোগ ঘটাইতে পারিবে। সেই কর্মের অনুষ্ঠান শেষ হইবে হইবে হইলে, আবার অন্যান্য কর্মের সাধন করিবে। নায়িকা যে কর্মের, যে দ্রব্যের ও যে কৌশলের প্রার্থনী হইবে, তাহার প্রয়োগ, উৎপত্তি, আগম, উপায় ও বিজ্ঞান আত্মায়ত্ত দেখাইবে। পূর্বপ্রবৃত্ত লোক পরিচিত বা দ্রব্যগুণ-পরীক্ষার বিষয় লইয়া তাহার ও তাহার পরিজনের সহিত বিবাদ উপস্থাপিত করিবে। তাহাতে যে পণ নির্দিষ্ট হইবে, তাহা তাহাদিগের মধ্যে ইহাকেই প্রশ্নার্থ নির্ণেত্রী নিরূপণ করিয়া প্রদান করিবে। যখন নায়িকার সহিত বিবাদ উপস্থিত হইবে, তখন বলিবে,–বাহবা! বড়ই অদ্ভুত কথা-ত! ঠিক বলিয়াছ, ঠিক বলিয়াছ।।’৭।।
ইতি পরিচয়কারণপ্রদর্শননামক প্রকরণ।
অভিযোগপ্রকরণ।
এইরূপে পরিচয় করিয়া পরিচিত হইলে, পরে অভিযোগ প্রয়োগ করিতে হইবে;–এইজন্য এখন অভিযোগনামক প্রকরণের আরম্ভ করা যাইতেছে—
‘প্রবৃত্তসংযোগ পরস্ত্রীগণকে নিজায়ত্ত করিতে হইলে, যেমন কন্যার পরিচয় করিয়া ঈঙ্গিত ও আকার দেখাইয়া উপায়ানুসারে অভিযোগ করিতে হয়, সেইরূপ ভাবেই অভিযোগ করিতে হইবে। তবে এস্থলের অভিযোগ প্রায়শই সূক্ষ্মভাবের; কারণ, কন্যাগন অসম্প্রযুক্ত। তদ্ভিন্ন পরস্ত্রী যুবতীর প্রতি,–অর্থাৎ যাহার সংযোগ পূর্বে সাধন হইয়াছে, তাহার প্রতি সেই সকল অভিযোগ পরিস্ফুটরূপে উপস্থিত করিবে; কারণ, তাহারা সম্প্রযুক্ত। আকারাদি দেখাইলে যে ভাব পোষণ করে, তাহাও নায়িকা নিশ্চয় প্রকটিত করিবে; তখন নায়িকার বস্তু সকল স্বয়ং উপভোগ করিবে ও নিজবস্তু সকল তাহাকে উপভোগ করাইবে। সেই পরিবর্তন ব্যাপারে নিজের বস্তু এই সকল হইবে, মহার্হ অঙ্গুলীয়ক, গন্ধ, উত্তরীয় ও কুসুম ইত্যাদি। যদি নায়িকা নায়কহস্ত হইতে তাম্বুল গ্রহণ করে, তবে গোষ্ঠীগমনে উদ্যত নায়ক-নায়িকার কেশকলাপস্থ কুসুমের প্রার্থনা করিবে। এটি সিদ্ধকরের পক্ষে। আর যখন নায়ক অন্যের হস্ত দিয়া মহার্হগন্ধ, যাহা অন্যেরও স্পৃহণীয়, নায়িকাকে দিবে, তখন তাহার নিজনখদশনপদচিহ্নিত করিয়ে দিবে। আর যখন স্বয়ং হস্তে করিয়া দিবে, তখন আকারের সহিত দিবে। এইরূপে ক্রমশঃ ক্রমশঃ অধিক পরিমানে ভয় অন্তর্হিত হইবে।।’৮।।
আন্তর অভিযোগ নির্দেশ করিতেছেন—
‘ক্রমশঃ নির্জন দেশে গমন, আলিঙ্গন, চুম্বন, তাম্বুল নেওয়া ও দিবার পর আবার দ্রব্যের লওয়া এবং গুহ্যদেশের অভিমর্ষণ ইত্যাদি করিবে।।’৯।।
গুহ্যদেশাভিমর্ষণ,–কক্ষোরুমূলবিমর্দন ও উৎক্ষিপ্তক দ্বারা জঘনে অভিমর্ষণ করিবে।।৯।।
যাহারা অভিযোগের বিষয় নহে, তাহাদিগের কথা কথিত হইতেছে—
‘যে গৃহে একটি নায়িকা অভিযুক্ত হইবে; সে গৃহে আর অপরকে অভিযুক্ত করিবে না। সেই গৃহে যে বৃদ্ধা অনুভূতবিষয়, তাহাকে তাহার প্রিয় বস্তুর উপহার দিয়া হস্তগত করিবে। নতুবা তাহার জ্ঞানের অতীর হইতে নাও পারে। সে বক্র থাকিলে সকলরূপ অভিযোগই ব্যর্থ হইতে পারে।।’১০।।
এ বিষয়ে দুইটি শ্লোক আছে—
‘যে গৃহে নায়িকার ভর্তা অন্য স্ত্রীতে সঞ্চারিত বলিয়া দেখিতে পাইবে; সে বাটিতে কোন নায়িকা সুপ্রাপ্তা হইলেও তাহাতে অভিগমনের চেষ্টা করিবে না। যে নায়কা অভিযোগকারীর প্রতি আশঙ্কা প্রকাশ করে, যে নায়িকা শস্ত্রধারী দ্বারা রক্ষিত, যে নায়িকা পতির ভয় করে, যে নায়িকার শ্বশ্রূ আছে ও যে শ্বশ্রূ নিজে পুত্রবধূকে সর্বদা চক্ষূর উপরে রাখে সেই সকল নায়িকাকে মেধাবী ব্যক্তি নিজের বিশ্বাস জানিয়া, অর্থাৎ আমি এস্থলে কৃতকার্য হইতে পারিব কি না, ইহা নিশ্চয় করিয়া, পাইবার জন্য চেষ্টা করিবে।।’১১।।
ইতি অভিযোগনামক প্রকরণ।
ইতি শ্রীমদ্বাৎস্যায়নীকামসূত্রে পারদারিকনামক পঞ্চম অধিকারণে পরিচয়কারণ ও অভিযোগনামকপ্রকরণের দ্বিতীয় অধ্যায় সমাপ্ত।।১।।