ষষ্ঠ ভাগ – প্রথম অধ্যায়
‘স্ত্রীসাধন করিবে—বলা হইয়াছে; কিন্তু স্ত্রীসাধন-ব্যাপার শত্রুরাজ্যবিজয়-ব্যাপার অপেক্ষা কোন অংশে ন্যুন নহে; সুতরাং শাস্ত্রজ্ঞানহীন ব্যক্তির পক্ষে স্ত্রীসাধন নিতান্ত অসম্ভব ব্যাপার বলিয়া বোধ হয়। অতএব তাহার তত্ত্বনির্ধারণোপায় পূর্বে বলিয়া সাম্প্রয়োগিক তন্ত্রের কীর্তন করাই যুক্তিসঙ্গত। সাম্প্রয়োগিক তন্ত্র-পাঠে সুরত-ব্যাপারের প্রকৃত তথ্যজ্ঞান জন্মিলে যথাযথভাবে আলিঙ্গন প্রভৃতির প্রয়োগ অনুরাগার্থই হইবে। এই জন্য এই অধ্যায়ে প্রমাণ, কাল ও ভাব দ্বারা সুরতের ব্যবস্থাপন করা যাইতেছে। তাহার মধ্যে আবার লিঙ্গসংযোগসাধ্য হইতেছে ভাব ও কাল; সুতরাং তদুভয় নিরূপণের পূর্বে প্রমাণতঃ সুরতের ব্যবস্থাপন করা যাইতেছে।
লিঙ্গপ্রমাণানুসারে নায়কগণের তিন প্রকার ভেদ পরিলক্ষিত হয়—শশ, বৃষ ও অশ্ব। নায়িকারও সেই অনুসারে তিন প্রকার ভেদ আছে—মৃগী, বড়বা এবং হস্তিনী।।’১।।
লিঙ্গভেদেই সংজ্ঞাভেদ হয় বলিয়া পূর্বাচার্যগণ মৃগ্যাদির সহিত দৃষ্টান্তীকৃত করিয়াছেন, শশ-আদির সহিত নহে। পূর্বাচার্যগণ এইরূপ বলেন—শশ, বৃষ ও অশ্বের সাধনসংস্থান (লিঙ্গাকার) দৈর্ঘ্য যথাক্রমে ছয়, নয় ও দ্বাদশ অঙ্গুলি পরিমাণে; দৈঘ্যের (লম্বার) প্রমাণানুসারে বিস্তারও যথাক্রমে যথাক্রমে ছয়, নয় ও দ্বাদশ অঙ্গুলি পরিমাণে হইবে। কেহ কেহ বলেন—বিস্তার (ওসার বা চৌড়া) ঠিক দৈর্ঘ্যের প্রমাণানুসারে সমান নাও হইতে পারে, অতিরিক্তও হইতে পারে এবং ন্যূনও হইতে পারে। সেইরূপ, মৃগী, বড়বা, অথবা হস্তিনীর সাধনসংস্থান (যোন্যাকার) দৈর্ঘ্যে যথাক্রমে যথাক্রমে ছয়, নয় ও দ্বাদশ অঙ্গুলি পরিমাণে এবং প্রস্থে বা বিস্তারে (অর্থাৎ ওসারে বা চৌড়ায় ছয়, নয় ও দ্বাদশ অঙ্গুলি পরিমাণে হইবে। ইহাদিগের সাধনসংস্থানের বিস্তার ন্যূন হয় না; বরং অতিরিক্তই হয়।।১।।
‘তাহাদিগের সদৃশসম্প্রয়োগে সমরত তিন প্রকারের হইয়া থাকে।।’২।।
শশের মৃগীর সহিত, বৃষের বড়বার সহিত এবং অশ্বের হস্তিনীর সহিত রন্ধ্র (গর্ত) ও ইন্দ্রিয়ের সমানরূপে প্রাপ্তি-স্বরূপ সম্প্রয়োগ সমান; কারণ, পরস্পর সাধনস্থানের দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে সমতা আছে। এইরূপ হইলে সুরতও সমান তিন প্রকার হয়; কারণ, রন্ধ্র (ছিদ্র) ও সাধনের (উপস্থের) আশ্রয়াশ্রায়িভাব থাকায়, যন্ত্রদ্বয়ের সমতা আছে।।২।।
‘বিপর্যয় হইলে বিষমরত ছয় প্রকারের হইয়া থাকে। সেই বিষম-সুরত ছয় প্রকারের মধ্যে যদি লিঙ্গতঃ পুরুষের আধিক্য ও স্ত্রীর ন্যূনতা হয়, তবে অনন্তর বা ব্যবহিত-সম্প্রয়োগ হয়। তন্মধ্যে অনন্তর-সম্প্রয়োগ উচ্চরত দু’টি, ব্যবহিত-সম্প্রয়োগ উচ্চতররত একটি; তাহার বৈপরীত্য অনন্তর-সম্প্রয়োগ নীচরত দুইটি ও ব্যবহিত-সম্প্রয়োগ নীচতররত একটি। তাহার মধ্যে সমান সুরতই শ্রেষ্ঠ, তরশব্দচিহ্নিত দু’টি কনিষ্ঠ এবং অবশিষ্টগুলি মধ্যম।।’৩।।
বড়বা ও হস্তিনীর সহিত শশের, মৃগী ও হস্তিনীর সহিত বৃষের এবং মৃগী ও বড়বার সহিত অশ্বের বিসদৃশ সম্প্রয়োগ। সাধনের বিসদৃশতা হেতু এরূপ হইলে ছয়টি বিষমসুরতও হইবে; কারণ, যন্ত্রের বিসদৃশতা আছে। এই বিষম-সম্প্রয়োগের মধ্যেও উচ্চ-নীচভাব আছে। যথা—যদি পুরুষের লিঙ্গতা আধিক্য হয় ও স্ত্রীর ন্যূনতা হয়, তবে সেস্থলে অনন্তর বা ব্যবহিত-সম্প্রয়োগ হইবে। তন্মধ্যে অশ্বের বড়বার সহিত এবং মৃগীর সহিত বৃষের বিপরীতক্রমে অনন্তর-সম্প্রয়োগ হয়। তাহা হইলে, সম-সুরত অপেক্ষা এ দু’টি উচ্চ-সুরত হইবে; কারণ সাধন (লিঙ্গ), রন্ধ্র (ছিদ্র) অপেক্ষা উচ্চ বলিয়া রন্ধ্রকে দাবিয়া ব্যাপার করিতে থাকে। তদ্ভিন্ন মৃগীর সহিত অশ্বের ব্যবহিত-সম্প্রয়োগ হয়, কারণ, মধ্যের একটি ব্যবহিত করিয়া সম্প্রয়োগ হইতেছে। তাহা হইলে, উচ্চতর সুরত হয়; যেহেতু সাধনটি দ্বাদশাঙ্গুল বলিয়া, ছয় অঙ্গুল দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট রন্ধ্রেরই নিকট অত্যন্ত উচ্চ; সুতরাং রন্ধ্রকে নিষ্পীড়িত করিয়া কোনরূপে অতিকষ্টে ব্যাপার করিতে থাকে। ইহার বিপরীত হইলে, সমরত অপেক্ষা নীচরত দু’টি হইয়া থাকে। যদি স্ত্রীরন্ধ্রের আধিক্য ও পুংলিঙ্গের ন্যূনতা হয়, তবে বড়বার সহিত অশ্বের ও হস্তিনীর সহিত বৃষের অনন্তর-সম্প্রয়োগ হইলে, বিপরীতক্রমে প্রামাণানুসারে সমরত অপেক্ষা নীচরত দু’টি হয়; কারণ, সাধন ক্ষুদ্র বলিয়া রন্ধ্রের সম্পূর্ণ ভাগ পূরণ করিয়া ব্যাপার করে; সুতরাং সমরতই শ্রেষ্ঠ। ইহাতে উভয়েরই পরিতৃপ্তি হয়, কারণ, যন্ত্রের সমতা আছে। তর-শব্দাঙ্কিতগুলি একেবারে নীচ ও তাহাতে কাহারও পরিতৃপ্তি হয় না। কারণ, উচ্চতর ও নীচতর শব্দাঙ্কিত সুরতদ্বয়ে যন্ত্রের অতিপীড়া ও অতিশৈথিল্যাবশতঃ স্পর্শসুখলাভ সুদুরপরাহত। আর উচ্চরতদ্বয় ও নীচরতদ্বয় মধ্যম; কারণ, তাহাতে যন্ত্রের অতিপীড়ন ও অতিশৈথিল্য না হওয়ায় স্পর্শসুখ প্রায়ই সমান হয়।।৩।।
মধ্যমের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব না থাকিলেও কিছু বিশেষত্ব আছে। তাহা বলিতেছেন—
‘সমতা থাকিলেও নীচরত অপেক্ষা উচ্চরতই শ্রেষ্ঠ। এই প্রমাণানুসারে নয় প্রকার সুরত ব্যাখ্যাত হইল।।’৪।।
উচ্চরতে স্ত্রীর অত্যন্ত উৎফুল্লতা হয়। তজ্জন্য সে জঘনদ্বয় সম্প্রসারিত করিয়া সাধনকে সম্বিষ্ট (প্রবেশ) করাইয়া লয়। সাধনের আধিক্যবশতঃ কণ্ডূতি (চুল্কানি) প্রতীকার অধিকতর হইয়া থাকে। নীচরতে স্ত্রী জঘনদ্বয় সম্বিষ্টতাভাবে যন্ত্রের সোৎসাহ সঙ্কেত করিয়াও কণ্ডূতির প্রকৃত প্রতীকার করাইতে পারে না। কথিত হইয়াছে—অল্পসাধন ব্যক্তি কামী হইলেও বা চিরসত্য (কুক্কুরাদিবৎ বহুকালকর্মা) হইলেও কণ্ডূতির প্রতীকার করিতে পারে না বলিয়া স্ত্রীগণের অন্যন্ত প্রিয় হইতে পারে না।।’৪।।
ভাবানুসারে রতব্যবস্থাপন করিতেছেন—
‘সম্প্রয়োগ-কালে যাহার সম্প্রয়োগেচ্ছা বা রতি অল্প, সম্প্রয়োগ ব্যাপার মন্দীভূত বা শুক্রধাতু অল্প এবং নায়িকা নখদন্তাদিদ্বারা ক্ষত করিতে থাকিলে সহিতে পারে না, তাহাকে মন্দবেগ বা মৃদুরাগ কহে।।’৫।।
ভাব দুইপ্রকার—হেতু ও ফল। তন্মধ্যে হেতুভাবের নাম কামিতত্ব; ফলভাবকে ফলভাব নামেই বলা হয়। হেতুভাবদ্বারা সম্প্রয়োগ হয়। সেই রতান্তে যে ভাব হয় তাহাই ফলভাব; সুতরাং সম্প্রয়োগ-সমকালে বা সম্প্রয়োগের পূর্বে যে কামিতভাব হয়, সেটি মন্দীভূত হইলেই নায়ক মন্দবেগ নামে প্রসিদ্ধ হইবে। তাহার সহিত বীর্যের অল্পতা এবং ক্ষতসহনক্ষমতাও অল্প পরিমানে থাকে। এইরূপ হইলেই—অর্থাৎ একদিন এক সময়ে এরূপ হইলেই নায়ক মন্দবেগ নহে। যদি তাহার প্রকৃতিই এই মন্দবেগের হয়, তবেই সে মন্দবেগ হইবে।।৫।।
‘তাহার বিপর্যয় হইলেই মধ্যবেগ ও চণ্ডবেগ নামে নায়ক প্রখ্যাত হইবে। নায়িকাও ঐরূপে মৃদুবেগা ও চণ্ডবেগা জানিবে।।’৬।।
যাহার, সম্প্রয়োগকালে সুরতেচ্ছা বা রতি কিংবা বীর্য অথবা ক্ষতসহনক্ষমতা মধ্য হইবে, সে মধ্যবেগ এবং সম্প্রয়োগকালে যাহার সুরতেচ্ছা তীব্র, বীর্য অত্যধিক এবং ক্ষতসহনক্ষমতা অতিশয়, সে চণ্ডবেগনামক নায়ক। পুরুষের ন্যায় স্ত্রীও সম্প্রয়োগকালে সুরতেচ্ছা, বীর্য ও ক্ষতসহনক্ষমতার মন্দীভূততা, মধ্যতা ও তীব্রতা-অনুসারে মন্দবেগা, মধ্যবেগা ও চণ্ডবেগা-নায়িকা নামে বিখ্যাত হইবে; সুতরাং ভাবানুসারে নায়ক ত্রিবিধ ও নায়িকাও ত্রিবিধ।।৬।।
‘তাহার মধ্যে প্রমাণের ন্যায় ভাবানুসারেও সুরত নয় প্রকারেরই হইবে।।’৭।।
সদৃশসম্প্রয়োগে সমরত তিনটি এবং বিষম-রতে বিষমসুরতও ছয় প্রকার। অর্থাৎ মন্দবেগার সহিত মন্দবেগের, মধ্যবেগার সহিত মধ্যবেগের ও চণ্ডবেগার সহিত চণ্ডবেগের সমানসুরতই প্রশস্ত। তদ্বিপর্যয়ে, মধ্যবেগের সহিত মন্দবেগার ও চণ্ডবেগার; মধ্যবেগার সহিত মন্দবেগার ও চণ্ডবেগার এবং চণ্ডবেগের সহিত মন্দবেগার ও মধ্যবেগার সুরত ছয় প্রকার। তন্মধ্যে মন্দবেগের সহিত মধ্যবেগা ও চণ্ডবেগা সুরতদ্বয় কনিষ্ঠ এবং মধ্যবেগের সহিত মন্দবেগা ও চণ্ডবেগার, এবং চণ্ডবেগের সহিত মন্দবেগা ও মধ্যবেগার সুরত মধ্যম। সেই মধ্যম সুরতের মধ্যেও আবার চণ্ডবেগের সহিত মন্দবেগা ও মধ্যবেগার সুরতই প্রধান। ইহা পূর্বোক্ত প্রকারে বুঝিবার চেষ্টা করাই যুক্তিসঙ্গত; কারণ, ইহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ ব্যাপার, কথায় কেবল মানিয়া অবসর লইবার নহে।।৭।।
‘সেইরূপ কালানুসারেও নায়ক শীঘ্রকাল, মধ্যকাল ও চিরকাল নামে খ্যাত হইবে।।’৮।।
–এখানেও যেমন পূর্বে প্রমাণানুসারে ও ভাবানুসারে নায়ক ও নায়িকা তিন তিন প্রকার হইয়াছে এবং তাহাদিগের সুরত-ব্যাপার নয় নয় প্রকারে বিভক্ত হইয়াছে, এখানেও ঠিক সেইরূপ হইবে। যাহার শীঘ্রকালে রতি হয়, সে পুরুষ তাদৃশ নায়িকার সহিত সম্প্রযুক্ত হইলে, তাহাদিগের সুরত শীঘ্রকাল নামে প্রখ্যাত হয়। সেইরূপ মধ্যকালার সহিত মধ্যকালের মধ্যকাল সুরত এবং চিরকালার সহিত চিরকালের সুরত চিরকাল নামে বিখ্যাত হইবে। তাহার বিপর্যয়ে ছয় প্রকার হইবে; সুতরাং এখানেও সুরত নয় প্রকার পূর্বোক্তবৎ–অর্থাৎ শীঘ্রকালের সহিত মধ্যকালা ও চিরকালার, মধ্যকালের সহিত শীঘ্রকালা ও চিরকালার এবং চিরকালের সহিত শীঘ্রকালা ও মধ্যকালার সুরত ছয় প্রকার। অন্মধ্যে শীঘ্রকালৈর সহিত মধ্যকালা ও চিরকালার সুরত কনিষ্ঠ। আর শেষ চতুষ্টয় মধ্যম। তন্মধ্যে আবার চিরকালের সহিত শীঘ্রকালা ও মধ্যকালার সুরতই প্রধান জানিবে।।৮।।
‘তাহার মধ্যে আবার স্ত্রীর সম্বন্ধে বিবাদ, অর্থাৎ মতভেদ আছে।।’৯।।
–কালানুসারে স্ত্রীর রতি হয়,–এ কথা সকলেই স্বীকার করেন, তাহা নহে।।৯।।
প্রথমতঃ ঔদ্দালকির মত উদ্ধার করিয়া দেখাইতেছেন—
‘স্ত্রী, পুরুষের ন্যায় ভাব পায় না।।’১০।।
–রেতঃসেকে যাদৃশ সুখের অনুভব পুরুষ করিয়া থাকে, স্ত্রী তাদৃশ সুখের অনুভব করিতে পারে না; কারণ, তাহাদিগের শুক্র নাই।।১০।।
তবে পুরুষের সহিত সম্প্রযুক্ত হইবার কারণ এই যে—
–‘পুরুষ সর্বদার জন্যই ইহার কণ্ডুতির অপনোদন করিয়া থাকে।।’১১।।
–সদ্বাধকখানি (যোনি-যন্ত্র) স্বভাবতই নানাবিধ-কৃমি-পরিসেবিত; সুতরাং তাহার কণ্ডূতিও (চুল্কানি) স্বাভাবসিদ্ধ। এ বিষয়ে ঔদ্দালকি বলিয়াছেন—মৃদুশক্তি, মধ্যশক্তি ও উগ্রশক্তি-সম্পন্ন রক্তে জাত সূক্ষ্মতম কৃমিগণ নিজ নিজ বলানুসারে মদনগৃহে কণ্ডূতি জন্মাইয়া থাকে। পুরুষ তাহার অপনয়ন করে। অনবরত সাধনের উৎক্ষেপণ ও অবক্ষেপণের ব্যাপার দ্বারা কণ্ডূতির নিরাস হইয়া থাকে। অন্যথা তাহার প্রতিবন্ধ করিতে উৎকোপ (কামোম্মাদ) হইবার সম্ভাবনা।।১১।।
‘সেই অপনীয়মান কণ্ডূতি অভিমানিকসুখের অনুগমন করিয়া রসান্তর সুখবিশেষ জন্মায়। সেই রসান্তরে ইহার সুখবুদ্ধি থাকায়—‘আমি সুখিত হইয়াছি’—এইরূপ বোধ হয়; সুতরাং সে স্থান হইতে অনবরত কণ্ডূতির অপনোদন হইতে আরম্ভ হইয়াছে, সেই স্থান হইতেই সুখানুভব হওয়ায় স্ত্রীর অপেক্ষা পুরুষের সুখানুভব পৃথক। অতএব যখন তদুভয়ের সাদৃশ্য কিছুই নাই, তখন কাল ও ভাব অনুসারে সুরত নয় প্রকার হইতে পারে না।
অবশ্য বলিতে
পার—পুরুষের সুখানুভব পুরুষের
মনোগত, স্ত্রীর
সুখানুভব স্ত্রীরই চিত্তস্থিত;
পুরুষের সুখ
স্ত্রী বুঝিতে পারে না,
স্ত্রীর সুখ
পুরুষ বুজিতে পারে না। যখন
পুরুষের রেতঃসেকজনিত সুখ কি
প্রকার, তাহা
স্ত্রী জানিতে পারে না,
বা স্ত্রীর
কণ্ডূতিনিবৃত্তি-সুখ
কীদৃশ—তাহা পুরুষ জানিতে
অক্ষম, তখন
জিজ্ঞাসা করিয়া বাক্যের
সাহায্য কি বুঝিবে? যখন
পরস্পর বুঝিতে পারে না,
বা জানিয়া
বুঝিতেও সমর্থ হয় না,
তখন স্ত্রী,
পুরুষের ন্যায়
ভাবপ্রাপ্ত হয় না’—এ কথা কি
করিয়া বলিতেছেন? ‘পুরুষের
ন্যায় স্ত্রী ভাবপ্রাপ্ত হয়
না’—ইহা তুমি কিরূপে জানিতে
পারিতেছ?
যদি
এই কথা বল, তবে
বলি, কিরূপে
জানিতে পারা যায়? না—পুরুষ
রতিলাভ করিলে নিজের ইচ্ছানুসারে
ব্যাপার হইতে প্রতিনিবৃত্ত
হয়, স্ত্রীর
অপেক্ষা করে না; কিন্তু
স্ত্রী-ত
এরূপ নহে। ঔদ্দালিক এই কথা
বলেন।।’১২।।
স্ত্রীরও যদি পুরুষের ন্যায় রেতো-বিসৃষ্টি (ত্যাগজনিত)-সুখ অধিগত হয়, তবে সেই সুখ প্রাপ্ত হইয়া, পুরুষের অপেক্ষা না রাখিয়া, স্বেচ্ছানুসারে যন্ত্রবিশ্লেষপূর্বক বিরাম করিতে পারে; কিন্তু পুরুষের বিরাম ব্যতীত স্ত্রীর বিরাম-ত দেখা যায় না। আরও রহস্য এই যে—পুরুষ বিরত হইলেও স্ত্রী অন্য পুরুষের অপেক্ষা রাখে। কেবল তাহাই নহে, দেখিতে পাওয়া যায়—কোন পুরুষ ব্যাপারে বিরত হইয়া উঠিলে, তদবস্থায় অবস্থিতি করিয়াই সেই স্ত্রী অন্য বহু পুরুষের সম্প্রয়োগ ভোগ করিতেছে। এই জন্যই কথিত হইয়াছে—‘কাষ্ঠ অগ্নির, নদীসঙ্গমে সমুদ্রের, সমস্ত প্রাণীর গ্রাসে যমের এবং বহু পুরুষভোগে স্ত্রীর কখনও তৃপ্তি হয় না।’ অতএব স্বেচ্ছাক্রমে বিরাম না থাকায়, বিসৃষ্টিসুখের বিরাম স্ত্রীর পক্ষে নাই।।১২।।
নাই বা হইল। অনুরাগ দর্শনে ত তাহার জ্ঞান হইতে পারে।–
‘তাহাতে-ত এই হইতে পারে—নায়ক চিরবেগ হইলে স্ত্রীগণ অনুরঞ্জিত হয়, শীঘ্রবেগ হইলে ভাব না পাইয়া সুরতান্তে নায়ককে দ্বেষ করে। সে সব-ত ভাবপ্রাপ্তি ও ভাবের অপ্রাপ্তি জানিবার উপায়।।’১৩।।
অতএব তদ্বারা স্ত্রীগণের অনুরাগ ও বিরাগের উপলব্ধি হয় বলিয়া, তাহাদিগের যে বিসৃষ্টিসুখের অভিগম আছে, তাহা বুঝিতে পারা যায়।।১৩।।
‘তাহা নহে। দীর্ঘকাল ধরিয়া কণ্ডূতির প্রতীকার হওয়াই তাহাদিগের প্রিয় কার্য। যদি নায়ক অতীব অল্পকালে স্বকীয় ব্যাপারের পরিসমাপ্তি করিয়া লয়, তাহা হইলে স্ত্রী তাহার প্রিয় কার্যের সিদ্ধি না হওয়ায়, বিরক্তি প্রকাশ করে বা চিরকাল নায়কের সহবাসে অনুরাগ প্রকাশ করে মাত্র—ইহাই এতদ্বারা উপপন্ন হইতেছে; সুতরাং বিসৃষ্টিসুখের লাভবশতঃ অনুরাগপ্রকাশ বা কণ্ডূতিপ্রতীকার বশতঃ—এসম্বন্ধে সন্দেহ থাকায় তদুভয়ই, অর্থাৎ অনুরাগ ও বিরাগ বিসৃষ্টিসুখাধিগমের অনুম্যপক উপায় হইতে পারে না।–অর্থাৎ অনুরাগ সঙ্গমান্তর স্ত্রী, নায়কের উপর অনুরাগ বা বিরাগ করিতেছে দেখিয়া, সে বিসৃষ্টিসুখ পাওয়াছে, বা পায় নাই—এরূপ অনুমান করিতে পারা যায় না; কারণ, অনুরাগ ও বিরাগ, কণ্ডূতিপ্রতীকার ও কণ্ডূতি অপ্রতীকারদ্বারাও হইয়া থাকে; সুতরাং অনুরাগ ও বিরাগ সন্দিগ্ধ হেতু হওয়ায়, তদ্দ্বারা অনুমান হইতে পারে না। অনুমান করিলেও সন্দিগ্ধহেতুজনা সে অনুমান অপ্রমান হইবে; সুতরাং তদ্দ্বারা ইষ্টসিদ্ধি অসম্ভব।।’১৪।।
তাহা হইলে বলিতে হইবে, স্বেচ্ছানুসারে সম্প্রয়োগে বিরাম দেওয়া ও না-দেওয়াই সুখপ্রাপ্তি ও অপ্রাপ্তির অনুমাপক উপায়। সে দুইটি স্ত্রীগণেরও বর্তমান আছে; সুতরাং পুরুষের ন্যায় স্ত্রীলোক রতি পাইতে সমর্থ নহে।।১৪।।
এ সম্বন্ধে ঔদ্দালকি স্পষ্টই বলিয়াছেন যে,–
‘সংযোগকালে পুরুষ স্ত্রীলোকের কণ্ডূতি অপনোদিত করিয়া দেয়। সেই কণ্ডূতিপ্রতীকারকে আভিমানিক সুখের সহিত মাখাইয়া স্ত্রীরা ‘সুখ’ শব্দে ব্যবহার করিয়া থাকে।।’১৫।।
এ সম্বন্ধে বাভ্রব্য বলিয়া থাকেন—
‘সাধনের অনবরত ব্যাপার হওয়ায় যুবতী আরম্ভ-কাল হইতেই সুখানুভব করিতে থাকে। আর পুরুষ বিসৃষ্টির পরে সুখানুভব করে। ইহা সম্পূর্ণ প্রত্যক্ষসিদ্ধ। যদি তাহাই না হইবে, তবে গর্ভসম্ভব কি করিয়া হয়? ভাবপ্রাপ্তি না হইলে গর্ভসঞ্চার হয় না। এই কথা বাভ্রব্যের মতানুসারিগণ বলিয়া থাকেন।।’১৬।।
–স্ত্রী ও পুরুষ, উভয়েই সুখানুভব করিয়া থাকে। তন্মধ্যে স্ত্রী, যন্ত্রে সাধনযোগ হইতেই নিরবধি সুখলাভ করে। সে পুরুষের সম্প্রয়োগে প্রভিন্নজলভাণ্ডবৎ শনৈঃ শনৈঃ ক্লিন্নসম্বাধা (যন্ত্রে ক্লেদযুক্তা) হয়—ইহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ। পুরুষের ন্যায় বিসৃষ্টিজনিত বলিয়া রেতঃসেকের ন্যায় ক্লেদনির্গমনদ্বারা আরম্ভকাল হইতেই স্ত্রী সুখানুভব করে; পুরুষ কিন্তু শুক্রবিসর্গের পর সুখলাভ করে, ইহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ বলিয়া উপপন্নতর; সুতরাং ভিন্ন ভিন্ন কালে সুখপ্রাপ্ত হয় বলিয়া সাদৃশ্য নাই।–সেই জন্যই কালতঃ নয় প্রকার সুরত নহে। ভাবতঃ নয় প্রকার সুরত আছে বটে; কারণ, বিদৃষ্টিসুখ সাদৃশ্য আছে।
আচ্ছা, সম্বাধ-ত ব্রণময়; সেই ব্রণে বারংবার আঘাত করিতে থাকিলে তাহার অপনোদন দ্বারাই-ত ক্লেদের সঞ্চার হইতে থাকে। তবে ক্লেদের বিসৃষ্টিজনিত যে সুখ, তাহাই মাত্র হইতে পারে, ভাবপ্রাপ্তি বা রসভোগ কোথা হইতে আসিবে?
না; তাহা নহে। রসপ্রাপ্ত—রসভোগ—বিদৃষ্টিসুখলাভ বা সম্ভোগ করিয়া, স্ত্রী তৃপ্তি লাভ করে। তদ্দ্বারাই তাহার নিশ্চয় গর্ভধারণ হয়। চরককার ইহাই বলিয়াছেন—‘মুখে জল উঠিতে থাকা, অর্থাৎ বারংবার থু থু ফেলিতে ইচ্ছা ও ফেলিতে থাকা; গৌরব অর্থাৎ গাত্র ও জঘনদ্বয়ের গৌরব (ভারিত্ব) বোধ হওয়া; অঙ্গের অবসাদ, অর্থাৎ কোন কোন অঙ্গের যেন ঘোরতর আলস্য উপস্থিত হওয়া; তন্দ্রা, অর্থাৎ জাগিয়াই নিদ্রার আবেশে বিভোর হওয়া, অথচ জ্ঞানও কিছু থাকা; মন অত্যন্ত প্রফুল্ল হওয়া; হৃদয়ে যেন ব্যথার অনুভব হওয়া; তৃপ্তি—অর্থাৎ সম্বাধের লৌল্য আর না থাকা—চাঞ্চল্য যাওয়া—অভাবের পরিপূরণ হওয়া; স্ফূর্তি লাভ করা—উৎকন্ঠার উপশম হওয়া; এক কথায় সুখানুভব করা এবং নিজরন্ধে বীজগ্রহণ করা—এগুলি সদ্যোগর্ভধারণের লক্ষণ।’—তৃপ্তিই ভাব, তাহা-ত শুক্রের বিসৃষ্টি ব্যতীত হইতে পারে না,–এই অভিপ্রায়ে ভাবপ্রাপ্তি ব্যতীত গর্ভসম্ভব হয় না, বলিয়াছেন। কেহ কেহ বলেন—স্ত্রীগণের আর্তবই স্খলিত হয়, শুক্র নহে। তাঁহারা বলেন—‘কামরূপ অগ্নিদ্বারা তপ্তচিত্ত স্ত্রী ও পুরুষের পরস্পর দেহসংসর্গে অরণী (উচ্চস্থ ও নীচস্থ কাষ্ঠফলদ্ব) ও দণ্ড (তদুভয়ের মধ্যেস্থ) মথন হইতে অগ্নির ন্যায় শুক্র ও আর্তবের মথন হইতে গর্ভসঞ্চার হইয়া থাকে।’—যাহাই হউক, তৃপ্তির অবশ্যই একটি কারণ আছে। সেটি কি, তদ্বিষয়ের চিন্তা করা যাইতেছে।–যদি তাহা শুক্রই না হয়, তবে কি করিয়া স্ত্রী গর্ভ সম্ভব হইতে পারে? যেমন পুরুষসংসর্গে স্ত্রী গর্ভধারণ করে, সেইরূপ স্ত্রীসংসর্গেও স্ত্রীগর্ভধারণ করিয়া থাকে। সুশ্রুতকার বলিয়াছেন—‘যখন কোন নারী কোন নারীর সহিত মৈথুনে প্রবৃত্ত হয়, তখন তাহারা উভয়েই পরস্পর শুক্রবিসর্গ করিয়া থাকে। তাহাদ্বারা গর্ভ হইলে, সে গর্ভে অস্থিসঞ্চার হয় না। কেবল একটি সজীব মাংসপিণ্ড জন্মিয়া থাকে।’ অতএব রসধাতু হইতে উৎপন্ন শোণিতধাতুই কোন অবস্থায় আর্তবপদবাচ্য হয়। আর শুক্রধাতু চাতুরন্তরিক—অর্থাৎ শোণিতধাতু ও শুক্রধাতুর মধ্যে মাত্র চারিটি ধাতুর ব্যবধান থাকায় বস্তুগত্যা একই পদার্থ হইলেও আকার ও ফল পরস্পর অত্যন্ত ভিন্নাকারের দেখিতে পাওয়া যাইতেছে; সুতরাং আর্তব ও শুক্র এক নহে। শুক্র স্ত্রীলোকেরও আছে। তাহার স্খলনে স্ত্রীগণ সুখানুভব করিয়া থাকে।
আর্তব স্ত্রীলোকের শুক্র নহে। শুক্রবিসৃষ্টিই সুখের হেতু বলিয়া, যে সময়ে স্ত্রীর ঋতুকাল নহে, সে সময়েও তাহাদিগের শুক্রবিসৃষ্টিজনিত সুখানুভব হইয়া থাকে। আর্তবটি ঋতুকাল ভিন্নও স্ত্রীগণ শুক্রবিসৃষ্টিজনিত সুখ অনুভব করিয়া থাকে, তখন আর্তব ও শুক্র একই পদার্থ নহে। অবশ্য স্ত্রীলোকের সপ্তম-ধাতু শুক্র নাই; একথা বলিতে সাহস করাই অনুচিত; কারণ, যিনি ঐ কথা বলিতে চাহেন, তিনি কি তাঁহার সহায়তাকারী সমস্ত পুরুষের সমষ্টিতে যে বল বা শক্তি হইতে পারে, একটি স্ত্রীলোকেই তদপেক্ষা অধিক শক্তি ও বল প্রত্যক্ষসিদ্ধ, একথা অস্বীকার করিতে সমর্থ হইবেন না? তবে স্ত্রীগণের শুক্র ভিন্ন প্রকৃতির ও ভিন্নাকারের। ক্লেদটি শুক্র বা আর্তব নহে; কিন্তু ডিম্বগত শুক্র লালাকৃতি পদার্থবিশেষ। অবশ্য শক্র হইতে উত্থিত বর্জিত ভাগ। তাহা পুরুষেরও আছে। সময়ানুসারে কাময়মান-স্ত্রীকে সকামভাবে দর্শন করিলে, তাহা পুরুষের সাধনেরও আসিয়া উপস্থিত হয়। সেটি স্ত্রীগণের সম্বাধে অধিক মাত্রায় থাকায়, তাহাদিগের সম্প্রয়োগ প্রারব্ধ হইতেই ক্ষরিত হইতে থাকে। সম্প্রয়োগ পূর্ণমাত্রায় নিষ্পাদিত হইলে চরমধাতু শুক্র স্বয়ং স্খলিত হয়; কিন্তু গর্ভের কারণ অন্যরূপ। যখন স্ত্রীগণের শুক্র স্খলিত হয়, তখন ঋতুকাল থাকিলে, সেই শুক্রের স্খলনবেগে আর্তবেরও স্খলন হয়। আর্তবের সহিত ডিম্বকোষ হইতে একটি বা একাধিক ডিম্ব আসিয়াও স্ত্রী-শুক্রের সহিত সাধনপরিত্যক্ত পুরুষশুক্রে মিলিত হয়। পুরুষশুক্রে জীবকীট থাকায়, একটি বা একাধিক জীবকীট সেই হরিদ্রাভ ডিম্বকে আশ্রয় করে। ডিম্বকে আশ্রয় করিলেই প্রসূতিবায়ু দ্বারা সেই স্খলনপ্রবণ আবর্ত জীবকীটানুবিদ্ধ ডিম্বের সহিত পুংশুক্রবিন্দুকে অবলম্বন করিয়া, বিপরীতবেগে ধীরে ধীরে পিপীলিকার গমনের ন্যায় জরায়ুকোষে যাইয়া প্রবিষ্ট হয়। এই সময়ে জরায়ুকোষ যে মুদ্রিতভাব অবলম্বন করে, তাহা হইতেই স্ত্রীর তন্দ্রাবেশ আসে। আআর শুক্রদ্বয়ের স্খলন, আর্তবের স্রাব এবং সে তিনটির বিপরীত বেগে জরায়ু-কোষে পূনঃপ্রবেশ দ্বারা দ্বিগুনিতসুখের অনুভব হয়।–ইহাকেই তৃপ্তি বলে। যাহারা বিশেষ বুদ্ধিমতী, তাহারা এই ব্যাপারদ্বারা নিজের গর্ভসঞ্চারের বিষয় অবগত হইতে পারে এবং বলিতেও পারে, ইহা প্রত্যক্ষসিদ্ধ; সুতরাং বাভ্রব্য যে বলিয়াছেন—‘পরিপূর্ণ সুখপ্রাপ্তি না হইলে গর্ভসঞ্চার হইতে পারে না’—ইহা সম্পূর্ণ সত্য কথা।।১৬।।
‘বাভ্রব্যমতেও পূর্বকথিত আশঙ্কা ও তাহার পরিহারপ্রণালী অবলম্বন করিয়া আশঙ্কা ও পরিহার কর্তব্য।।’১৭।।
‘তাহাতে এই হয় যে, সাধনের অনবরত ব্যাপার দ্বারা নিরন্তরই সুখ প্রাপ্ত হয়, একথা বলিলে;–আরম্ভকালে মধ্যস্থচিত্ততা অর্থাৎ নখক্ষতাদিতে বিশেষ আগ্রহ না থাকা ও নখক্ষতাদির প্রয়োগ করিলে তাহা তত সহ্য করিতে না চাওয়া। তাহার পর, ক্রমশঃ অধিকরাগযোগ—অর্থাৎ নখক্ষতাদিতে অধিকমাত্রায় আগ্রহ হয় ও শরীরে নখক্ষতাদিপ্রয়োগ করিলে অত্যন্ত সহিষ্ণুতাসহকারে তাহা সহ্য করা হয় এবং বিসর্গান্তে ব্যাপার হইতে বিরামের অত্যধিক আগ্রহ জন্মে—এ সকল অবস্থান্তর, স্ত্রী যদি নিরবধিই সুখানুভব করিতে থাকে, তবে অনুপপন্ন হয়। আর যদি তাহারও বিসৃষ্টির পরেই সুখানুভব করিতে থাকে, তবে অনুপপন্ন হয়। আর যদি তাহারও বিসৃষ্টির পরেই সুখানুভব স্বীকার করা যায়, তবে অনুরাগের এই প্রকার তরতমভাব উপপন্ন হইতে পারে।।’১৮।।
‘তাহা নহে। কুলালচক্র (কুম্ভকারের চাকা) এবং ভ্রমরক (কাষ্ঠের খেলনা বিশেষ) এতদুভয় ভ্রমণ-ক্রিয়ায় বর্তমান থাকায় এতদুভয়ের ভ্রমণসংস্কার, আদি, মধ্য ও অবসানকালে সমান থাকিলেও প্রারম্ভকালে মন্দবেগতা এবং ক্রমেই তীরবেগতা বা বেগ ক্রমশঃই পরিপূর্ণ হইতে থাকে। সেইরূপ ঐস্থলেও উপপন্ন হইতে পারে। তবে ব্যাপারে বিরামেচ্ছা ধাতুক্ষয়জনিত হয়। অতএব বিসৃষ্টিপ্রভব সুখাধিগম নিরবধি হইতে থাকিলে, তাহার অবস্থান্তর হইতে পারে না বলিয়া যে আপত্তি করিয়াছিলে, তাহা নিতান্ত অসম্ভব। সে আপত্তি হইতেই পারে না।।’১৯।।
এসম্বন্ধে বাভ্রব্য যে শ্লোক বলিয়াছেন, তাহাই এখন দেখান যাইতেছে—
‘সুরতের অবসানে পুরুষের সুখোদয় হয়; কিন্তু স্ত্রীগণের সর্বদাই সুখানুভব হইয়া থাকে। উভয়েরই সম্প্রয়োগে বিরামেচ্ছা একমাত্র ধাতুক্ষয়বশতই হয়।।’২০।।
এই দুইটি পক্ষ দেখাইয়া এ বিষয়ের সিদ্ধান্ত যে কি, তাহা প্রদর্শন করিতেছেন—
‘অতএব পুরুষের ন্যায় স্ত্রীলোকেরও রতির উৎপত্তি ও অন্তে বিসৃষ্টি দ্রষ্টব্য।।’২১।।
পুরুষের সুখের সহিত স্ত্রীর সুখের বৈসাদৃশ্য স্বরূপতঃ ও কালতঃ উভয়তই আছে—এইরূপ আশঙ্কা করিতেছেন। অবশ্য নির্ণয়ার্থেই আশঙ্কা হইতেছে—
‘যাহার আকৃতিগত (জাতিগত) সাম্য আছে, অথচ একই ফলের উদ্দেশে একই কার্য্যে প্রবৃত্ত, তাদৃশ ব্যক্তিদ্বয়ের কার্য্যবৈলক্ষণ্য কিরূপে হয়? হয়, যদি উপায়ের বিভিন্নতা ও অভিমানের পার্থক্য থাকে।।’২২।।
দেখা যায়, ভিন্নজাতীয় পুরুষ ও বড়বার বিজাতীয় কার্য যে ভাবসুখ, তাহা স্বরূপতঃ ও ফলতঃ ভিন্ন হয় না; কিন্তু এখানে স্ত্রীপুরুষ উভয়েই মনুষ্যজাতি; তথাপি কিন্তু তদুভয়ের ভাবসুখ স্বরূপতঃ কালতঃ ভিন্ন ভিন্ন; ইহা কিরূপে উপপন্ন হয়?—অবশ্য একজাতীয় মেষদ্বয় পরস্পর যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে, পরস্পরের অভিঘাতরূপ কার্য্য ফলতঃ ও স্বরূপতঃ ভিন্ন ভিন্ন হয় না। শাস্ত্রকার ইহার উত্তরে বলিতেছেন—সেস্থানে ভেদ হইতে পারে, যদি উপায় পরস্পর পৃথক থাকে।।২২।।
‘কি করিয়া উপায়ের পার্থক্য হয়?—সৃষ্টির স্বভাববশেই উপায়ের বৈলক্ষণ্য ঘটে। সৃষ্টির স্বভাবই এই যে, পুরুষ কর্ত্তা, যুবতী আধার। অন্যপ্রকার ক্রিয়া কর্ত্তার—অর্থাৎ সাধন উন্নত ও স্ত্রীযন্ত্রের প্রাপ্য, তাহার ক্রিয়া উত্থান ও পতন বা আপীড়িত করিয়া অন্তর্গমন; সুতরাং স্ত্রীর যন্ত্র নিম্ন ও পুংসাধনের গ্রাসক। তাহার ক্রিয়া আগম্যমান সাধনকে গ্রাস করা বা সাধনের অন্তর্ধারণ। এই জন্য কর্ত্তা যে পুরুষ, তাহার ক্রিয়া, এবং আধার যে স্ত্রী, তাহার ক্রিয়া এতদুভয় পরস্পর ভিন্ন। এই উপায়ের বিভিন্নতাসৃষ্টিবশতঃ অভিমানের বিভিন্নতাও স্বাভাবিক। পুরুষ মনে করে, আমি ইহার রমণের জন্য অনুযুক্ত—এই মনে করিয়া পুরুষ অনুরক্ত হয়; আর যুবতী মনে করে—পুরুষ কর্ত্তৃক আমি রমণের জন্য অভিযুক্ত; অর্থাৎ আমার যৌবনরসের উপভোগের জন্য আমি ইহার দ্বারা আহূত—এই মনে করিয়া যুবতী অনুরক্ত হয়। সুতরাং উপায় ও অভিমান পরস্পর অত্যন্ত বিভিন্ন হইলেও, এবং সেই আভিমানিক অনুরাগ সুরতব্যাপারে ক্রিয়া করিতে থাকিলেও কালতঃ ও স্বরূপতঃ উভয়ের ভাব সমানই হইয়া থাকে।–এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন।।’২৩।।
যেমন ক্রিয়ার ভেদ আছে; সেইরূপ সেই ক্রিয়াজনিত সুখের ভেদ নাই। ক্রিয়া-ভেদে ফলের বৈজাতা হইতে পারে না, তদ্দ্বারা কেবল অভিমানেরই ভেদ হইতে পারে।।২৩।।
যেমন এতদুভয়ের ক্রিয়াভেদ স্বীকার করিতেছ, সেইরূপ সুখরূপ কার্যফলের ভেদ কেন না হইবে?—এই আশঙ্কা করিতেছেন।
‘তাহাতে এই হইতে পারে যে, ফলও ভিন্ন হয়। উপায়ের যেমন বৈলক্ষণ্য আছে, সেইরূপ কার্যরূপ ফলের পার্থক্যও কেনা না হইবে? না, তাহা হইতে পারে না। উপায়ের যে বৈলক্ষণ্য আছে, তাহা অকারণ নহে, অর্থাৎ উপায় কিছু একটি হয় না, বহু বিধই-ত হইয়া থাকে; কিন্তু তাহার কার্য তাহা হইতে জন্মিয়াছে বলিয়া কি উপায়ের ন্যায় ভিন্ন হইবে? কখনই নহে; কারণ, একটি কার্যের উৎপত্তির প্রতি বহুবিধ কারণের সাহায্য আবশ্যক হয়, তদ্ব্যতীত কার্যই হইতে পারে না; কিন্তু তাই বলিয়া কার্যের বৈলক্ষণ্য-ত দেখা যায় না। কর্তা ও আধার ভিন্ন ভিন্ন লক্ষণাক্রান্ত বলিয়া তজন্য সুখকার্যের বৈলক্ষণ্য হইতে পারে না; কারণ, উপায়ের বৈলক্ষণ্য অনুসারে কার্যের বৈলক্ষণ্য হইবার কোন কারণ নাই এবং তাহা নিতান্তই ন্যায়বিগর্হিত। যেহেতু, স্ত্রী ও পুরুষের জাতিগত ভেদ নাই। কেবল তাহাই নহে। স্ত্রী-পুরুষের ব্যাপার পরস্পরসাপেক্ষ। যাহা পরস্পরসাপেক্ষভাবে কার্য করে, তাহা কখনই বিভিন্নফলের কারণ হইতে পারে না। এতএব কালতঃ ও স্বরূপতঃ স্ত্রীপুরুষের রতিসুখ সমানই জন্মিয়া থাকে।।’২৪।।
‘সেখানে ইহা হইতে পারে, যেখানে কারকগণ পরস্পর মিলিয়া একই বিষয় পরিনিষ্পন্ন করে। এখানে ত স্ত্রী ও পুরুষ পৃথক পৃথক স্বার্থসাধনে ব্যতিব্যস্ত দেখা যায়; সুতরাং কালতঃ ও স্বরূপতঃ তাহাদিগের সুখকার্যের ঐক্য অসম্ভব ও যুক্তিহীন।।’২৫।।
তদ্ভিন্ন আকৃতিগতই বা সমতা কোথায়? স্ত্রীর যে আকৃতি, পুরুষের কি ঠিক তদনুরূপ? সুতরাং সুখ কখনই এক আকারের হইতে পারে না।।২৫।।
‘না, তাহা হইতে পারে না; যেহেতু একই কালে অনেকার্থ সিদ্ধ হইতে দেখা যায়। যেমন মেষদ্বয়ের অভিঘাতে, কপিত্থদ্বয়ের (কৎবেল দুইটির) ভেদে, মল্লদ্বয়ের যুদ্ধে ইত্যাদি। সেখানে-ত কারকভেদ নাই—সেখানে যে উভয়েই কর্তা, আর এখানে পুরুষ কর্তা, স্ত্রী অধিকরণ; সুতরাং কারকের ভেদ আছে, যদি ইহা বলা যায়, তবে ইহার উত্তরে বলিতে পারি, এখানেও-ত বস্তুভেদ কিছুই নাই। স্ত্রী ও পুরুষ, উভয়েই সুরতব্যাপারের কর্তা, সুরতক্রিয়াকে তাহারা উৎপন্ন করিয়া থাকে। কেবল করণ ও অধিকরণআদি ভেদ বুদ্ধিকল্পিমাত্র—ব্যবহারার্থে ব্যবস্থাপিত মাত্র। ইহা পূর্বে-ত বলাই হইয়াছে যে, উপায়ের বৈলক্ষণ্য সৃষ্টির স্বভাববশতঃ হইয়াছে। হ্যাঁ—বলা হইয়াছে। তাহা বলাই হইয়াছে মাত্র; বাস্তবিক, কর্তা ও অধিকরণ-কল্পনা প্রকৃত নহে। যদি কর্তা ও অধিকরণ-কল্পনা বাস্তবিক না হয়, উভয়েই সমানভাবে সুরতক্রিয়ার কর্তা হয়, তবে উভয়েরই সুখানুভব সমান হইবে বা সমানই হইয়া থাকে।।’২৬।।
শাস্ত্রকার এই বিষয়টি সংগ্রহ করিয়া শ্লোকে গ্রহণ করিতেছেন—
‘জাতিগত ভেদ নাই বলিয়া, দম্পতির সুখ সমান হইয়া থাকে, এইরূপ বলিতে ইচ্ছা করি; সুতরাং যাহা হইলে স্ত্রী অগ্রেই রতিলাভ করিতে পারে, সেরূপ উপচর্যা (চুম্বনালিঙ্গাদি) করিবে।।’২৭।।
ইহা দ্বারা কথিত হইতেছে যে, স্ত্রী ও পুরুষ-জাতির পরস্পর অবান্তররূপে যে কিছু পার্থক্য আছে, তজন্য স্ত্রীর একটু অধিক ফল—কণ্ডূতির প্রতীকার-সুখ, সম্বাধে বারংবার উপমর্দিত ও আঘৃষ্ট হইলে শুক্রের স্খলন হয়; কিন্তু মনুষ্যজাতি বলিয়া সমতা থাকায়, তাহার ফলে বিসৃষ্টি-সুখ পুরুষের ন্যায় সুরতান্তেই উপভোগ করিয়া থাকে। কথিত হইয়াছে যে—‘স্ত্রীগণের সুখ হয় দুইরূপে, কণ্ডূতিপ্রতীকার ও শুক্রক্ষরণ জনিত। শুক্রক্ষরণও দুই প্রকার, স্যন্দন (গা বাহিয়া পড়া) ও বিসৃষ্টি (পূর্ণবেগে স্তরে স্তরে পড়া); কেবল সুন্দিত হইলে সম্বাধ ক্লিন্ন হয়, আর মথনদ্বারা বিসৃষ্টি হইতে সুখ হয়। সুরতান্তে বেগের আক্ষেপ (বেগকে উত্তেজিত বা উচ্ছলিত করিয়া দেওয়া) বশতঃ পুরুষের ন্যায়ই শুক্রের বিসৃষ্টি হইয়া থাকে। পূর্বাচার্যগণ এইরূপ স্মরণ করিয়া থাকেন। সমরতস্থলে উভয়েরই রসপ্রাপ্তি সমান হয় বলিয়া, এপক্ষ ভালই। রসপ্রাপ্তি যদি ভিন্নকালে হয়, আর সেস্থলে যদি পুরুষ অগ্রে ভাবপ্রাপ্ত হয়, তবে স্ত্রীর-ত আর ভাবপ্রাপ্তি ঘটিয়া উঠে না। এই জন্য সেখানে অগ্রে এতাদৃশভাবে চুম্বনালিঙ্গনাদি করিতে হইবে যে, তদ্বারা স্ত্রী যেন ভাবপ্রাপ্ত হয়। পরে পুরুষ যন্ত্রযোগে বেগ দিয়া নিজের ভাব নির্বতিত করিয়া লইবে। অন্যথা প্রীতিহানি হইবার সম্ভাবনা।।’২৭।।
‘রসপ্রাপ্তি সমানরূপে সিদ্ধ বলিয়া প্রমাণানুসারে সুতর নয় প্রকারের ন্যায় কালতঃ ও ভাবতঃও কালযোগী সুরত নয় প্রকার এবং ভাবযোগী সুরত নয় প্রকার।।’২৮।।
‘রস, রতি, প্রীতি, ভাব, রাগ, বেগ ও সমাপ্তি—এই কয়টি রতির পর্যায়বাচী শব্দ। রতি ফলাবস্থা। কারণাবস্থা বা ব্যাপারাবস্থাকে সুরতকেলি বলা হয়। তাহার পর্যায়বাচী শব্দ হইতেছে—সম্প্রয়োগ, রত, রহঃ, শয়ন ও মোহন।।’২৯।।
‘প্রমাণ, কাল ও ভাবজনিত সম্প্রয়োগের এক-একটি নয়প্রকারের বলিয়া তাহাদিগের পরস্পর সংযোগে সুরতের অনেক বহু সংখ্যা হইয়া পড়ে; সুতরাং সুরতসংখ্যা নির্ধারণ করিতে হইলে গ্রন্থ-গৌরব হইয়া যায়। এজন্য তাহা ত্যাগ করা গেল।।’৩০।।
প্রমাণ, কাল ও ভাবজ সুরত তিন প্রকার। তাহার প্রত্যেক সুরতটি নয় প্রকার বলিয়া (৩*৯=২৭) সমুদায়ে সপ্তবিংশতি প্রকার। সুরত দ্বিবিধ—শুদ্ধ ও সঙ্কীর্ণ। তাহার মধ্যে শুদ্ধ সুরত অসম্ভব বলিয়া, সঙ্কীর্ণ সুরতের গণনা করাই যুক্তিসঙ্গত। সেই সঙ্কীর্ণ-সুরত সম ও বিষম ভেদে দুই প্রকার। তন্মধ্যে সদৃশ-সম্প্রয়োগে নয়টি সমসঙ্কীর্ণ সুরত। এই নয় প্রকার, শশের প্রত্যেকের সদৃশী একটি মৃগী ছাড়িয়া শেষ আটটির সহিত সম্প্রয়োগে (৮*৯=৭২) সমূদায়ে দ্বাসপ্ততি প্রকার বিষমসঙ্কীর্ণ সুরত। যেমন শশ নয়প্রকার বলিয়া তথাবিধ বড়বার সহিত সম্প্রয়োগে নয়প্রকার বিষমসঙ্কীর্ণ সুরত এবং অতথাবিধ আটটির সহিত সম্প্রয়োগে দ্বাসপ্ততি; এইরূপ ততগুলি হস্তিনীর সহিত সম্প্রয়োগে ততগুলি বিষম ও অতিবিষমসঙ্কীর্ণ সুরত; সুতরাং সমূদয়ে শশের ত্রিচত্বাবিংশ অধিক শতদ্বয়-(২৪৩) প্রকার বিষমসঙ্কীর্ণ সুতর। আবার ততগুলি বৃষের বা অশ্বের। তবেই সমূদায়ে (২৪৩*৩=৭২৯) একোনত্রিংশাধিক সপ্তশতপ্রকার বিষমসঙ্কীর্ণ সুরত।।৩০।।
‘তাহার মধ্যে তর্ক করিয়া যথোপযুক্ত উপচার প্রয়োগ করিবে, যাহাতে বিষমে বিষমেও সমতা জন্মে।–এই কথা বাৎস্যায়ন বলেন।।’৩১।।
সঙ্কীর্ণসুরত মধ্যে বুদ্ধি দ্বারা তাহার ক্রিয়মাণ সুরত কোন্ জাতীয়, তাহা স্থির করিয়া তদনুসারে উপচারেরও প্রয়োগ করিতে হইবে। যেমন প্রমাণ, কাল ও ভাবজ সুরতে যে আলিঙ্গনাদি যেমন যেমন ভাবে উপচার কল্পিত হইয়াছে, তাহা পরিত্যাগ করিয়া সঙ্কীর্ণ উপচারের যোজনাই করিবে, যাহা হইলে তাহা সমরত হইতে পারে। ইহা অবশ্য প্রযত্নসাধ্য সমতা। এস্থলে বাভ্রব্যের কিছু শ্লোক আছেঃ—যেস্থলে পুরুষের মেহন (সাধন) স্ত্রীর মেহনে (যন্ত্রে) সম্পূর্ণভাবে ঘর্ষিত হয় এবং ভাব ও কাল সমান, সেই রতই শ্রেষ্ঠ। আর যেখানে মেহনের ভেদ (ছোট-বড় ভাব) আছে, ঘর্ষণটা ভালরূপে হয় না এবং ভাব ও কাল বিষম, সেই রতই কনিষ্ঠ বলিয়া কথিত হয়। সকল বিষয়ের সাম্যে সুরত, অর্থাৎ যে রত-ব্যাপার বিলক্ষণ শোভন হয় এবং সকল বিষয়ের সাম্যে সুরত, অর্থাৎ দুঃখকর রতব্যাপার হয়, ইহা আচার্যেরা স্মরণ করিয়া থাকেন। তদ্ভিন্ন সমস্তই মধ্যম। সেই মধ্যেমের মধ্যে বলাবল কথিত হইয়াছে। এসকলের মধ্যে কালই সম্পূর্ণভাবে বলবান্। কালে নায়ক শশ হইলেও হস্তিনী-মেহন-যন্ত্রের সর্বত্রই সংস্পর্শ করিতে পারে। এইরূপ, নায়ক অশ্ব হইলে, যদি বিসৃষ্টিকাল ও রতব্যাপারকালসম্বন্ধে অভিজ্ঞ নাও হয়, তবে মৃগীর বিসৃষ্টিকাল উত্তমরূপে জানাইয়া দিতে পারে ও তদ্দ্বারা প্রিয় হইতেও পারে, ইহা কথিত হইয়াছে; সুতরাং প্রমাণকেই কেহ কেহ বলবত্তম বলিয়াছেন; কেহ কেহ বলেন, বেগই বলীয়ান, যেহেতু নায়ক অশ্ব হইলেও যদি বেগবান না হয়, তবে মৃগীকে সাধিত করিতে সক্ষম হয় না; সুতরাং বেগই কালাপেক্ষা প্রকৃষ্টতম। এইরূপ হইলে, নায়িকা যদি মন্দবেগাও হয়, তথাপি খেদপ্রাপ্ত হয় না। অতএব ইহাদিগের বিষয়বিভাগানুসারে বলাবল জানা উচিত। ভাব ও প্রমাণহীন কালবর্জিত নায়ক বেগের সাহায্যে স্ত্রীসাধন করিবে। আর কাল ও প্রমাণহীন নায়ক শেষ (ভাব) দ্বারা স্ত্রীসাধন করিতেও সক্ষম হইতে পারে।।৩১।।
ইহার মধ্যে স্বাভাবতঃ যাহার যে ভাব ও কাল এবং যে সময়ে সে ভাবান্তর ও কালান্তর প্রাপ্ত হয়, তাহা বলিতেছেন,–
‘প্রথমতে পুরুষের বেগ অত্যন্ত চণ্ড ও শীঘ্রকাল থাকে, তাহার বিপরীত তৎপরবর্তী রতে হয়। স্ত্রীর পক্ষে আবার যতক্ষণ ধাতুক্ষয় না হয়, ততক্ষণ ইহার বিপরীত ভাব ও কাল হইয়া থাকে। স্ত্রীর ধাতুক্ষয়ের পূর্বেই পুরুষের ধাতুক্ষয় হয়, ইহা প্রায়িকবাদ—অর্থাৎ প্রায়শঃ দেখা যায়। পুরুষের ধাতুক্ষয়ই অগ্রে হইয়া থাকে, পরে স্ত্রীর ধাতুক্ষয় হয়।।’৩২।।
নায়ক ও নায়িকার ভোগানুসারে ঐ চণ্ডবেগতা ও শীঘ্রকালতাও ভিন্ন হয়, তাহা ভার্যাদিতে দ্রষ্টব্য।।৩২।।
‘স্ত্রীগণ স্বভাবতঃ কোমলাঙ্গী হইলে অতি সত্বরই প্রীতিলাভ করে। যদি স্বভাবতঃ কোমলাঙ্গী না হয়, তবে চুম্বনালিঙ্গনাদি ও আন্তরোপায় অঙ্গুলিকর্মাদি দ্বারা উপমুদিত হইলেও অতি সত্বরই প্রীতিলাভ করিয়া থাকে। এবিষয়ে সকল আচার্যই একমত।।’৩৩।।
‘এই পর্যন্ত যাহা কথিত হইল, তাহা অত্যন্ত সংক্ষেপ বলিয়া শাস্ত্রাভিজ্ঞ পণ্ডিতগণের পক্ষেই উক্ত জানিতে হইবে। অতঃপর অল্পধী জনগনের সুখাববোধার্থ সাম্প্রয়োগিকপ্রকরণ বিস্তরভাবে বলা যাইতেছে।।’৩৪।।
শাস্ত্রানুসারে আলিঙ্গনাদি উপচার জানিয়া, কাহার পক্ষে কোন উপচার প্রযোজ্য, তাহার উন্নয়ন করিয়া প্রয়োগ করিতে হইবে। ইহা অবশ্য মন্দবুদ্ধিজনের পক্ষে অসম্ভব; সুতরাং তাহাদিগের সুখাববোধার্থ অতঃপর গ্রন্থ প্রচার করিতে হইতেছে।।৩৪।।
যেমন রতব্যাপার তিন প্রকার অবস্থাপিত হইয়াছে, সেইরূপ প্রীতিও স্থূল-সূক্ষ্ণরূপে ব্যবস্থাপিত হইয়াছে; কিন্তু তদ্ব্যতিরেকেও অন্য প্রকার প্রীতিও এ-শাস্ত্রে থাকা সম্ভব। তাহা দেখাইবার জন্য প্রীতিবিশেষ বলিতেছেন—
‘কামসূত্রাভিজ্ঞ পণ্ডিতগণ প্রীতিকে চারিপ্রকার বলিয়া থাকেন। অভ্যাসবশতঃ, অভিমানবশতঃ, প্রত্যভিজ্ঞাবশতঃ এবং বিষয়সেবাবশতঃ প্রীতি হয়।।’৩৫।।
এই চারি প্রকার প্রীতির লক্ষণ করিতেছেন—
‘শব্দাদি বিষয় অবলম্বন করিয়া কর্মের বারংবার অনুষ্ঠানবশতঃ যে প্রীতি বহির্মুখী হয়, তাহাকে অভ্যাসিকী প্রীতি কহে। যেমন মৃগয়াদি কর্মের বারংবার অনুষ্ঠানে সুখলাভ হইয়া থাকে।।’৩৬।।
আদিশব্দদ্বারা নৃত্য-গীত-বাদ্য-চিত্রপত্রচ্ছেদ্য প্রভৃতি সংগ্রাহ্য। ব্যায়ামিকী বিদ্যাও আভ্যাসিকী প্রীতির কারণ জানিবে।।৩৬।।
‘কর্মের বারংবার অনুষ্ঠান না করিলেও শব্দাদিবিষয়কে অবলম্বন করিয়া মনে মনে সঙ্কল্পবশে যে প্রীতি উৎপন্ন হয়, তাহাকে মানসী কহে।।’৩৭।।
‘তৃতীয়া প্রকৃতি ক্লীব ও মুখচপনা স্ত্রীর যে ঔপরিষ্টক,–অর্থাৎ মুখে জঘনকর্মের অভ্যাস করিলেও প্রয়োগকারীর পক্ষে সে প্রীতি কায়িকী বিষয়প্রীতি। তদ্ভিন্ন, সেই সেই চুম্বনাদি কর্ম প্রযোজিত হইলে, মনে মনে যে প্রীতি জন্মায়, তাহাকে মানসী প্রীতিই বলিয়া থাকে; কারণ, স্পর্শমাত্র জ্ঞানলাভ করিয়াই তাহার উদ্ভব।।’৩৮।।
‘যে কোন অন্য স্ত্রী বা পুরুষে ‘এই লোক অন্য নহে, কিন্তু সে-ই’ এই প্রকার চিন্তা করিয়া সম্প্রয়োগ করিলে যে প্রীতি উৎপন্ন হয়, তন্ত্রজ্ঞগণ তাহাকেও সম্প্রত্যয়াত্মিকী প্রীতি নামে আখ্যাত করেন।।’৩৯।।
‘লোকতঃ প্রত্যক্ষসিদ্ধ বিষয়কে অবলম্বন করিয়া যে প্রীতি উদ্ভুত হয়, সাক্ষাৎ বিষয়োপভোগরূপ ফল তাহারই বলিয়া, তাহাকে বিষয়প্রীতি বলা যায়। অন্য তিনটি তাহারই অঙ্গ মাত্র।।’৪০।।
‘শাস্ত্রনির্দিষ্ট এইসকল প্রীতিকে শাস্ত্র-অনুসারে বিবেচনা করিয়া, যে ভাব যেমন প্রবর্তিত হয়, তাহাকে সেই ভাবের প্রবর্তিত করিবে।।’৪১।।
ইতি
শ্রীমদ্-বাৎস্যায়নীয়কামসূত্রে
সাম্প্রয়োগিকনামক ষষ্ঠ-অধিকরণে
প্রমাণ, কাল
ও ভাবানুসারে রতের ব্যবস্থাপন
নামক প্রথম অধ্যায়।।১।।
এ
অধ্যায়ে প্রীতিবিশেষও ব্যাখ্যাত
হইয়াছে।